বাংলাদেশ থেকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ভয়ংকর আমেরিকা অভিযাত্রা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আমেরিকার স্থলসীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ বাড়ছে। বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিয়ে এসব অভিযাত্রী অনেকেরই স্বপ্নের দেশে আশার পথে স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা ঘটছে। অনেকের পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটছে, অনেকেই দালালদের খপ্পরে পড়ে নিগৃহীত হচ্ছেন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেকে আবার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় এলেও আটকা পড়ছেন নির্জন ডিটেনশন কেন্দ্রে।

এঁদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি মানুষও আছে। বয়স ১৮ বছরের নিচে—এমন শতাধিক অপ্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি আমেরিকা অভিযাত্রীর বয়স নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে খোদ আমেরিকায়।

সাধারণত যাদের বয়স ১৮ বছরের কম, তাদের ফেডারেল সরকার অফিস অব রিফিউজি সেটেলমেন্টের (ওআরএস) হেফাজতে রাখে। ওআরএসের কাজ হচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীদের দেখাশোনা করা। পরবর্তী সময়ে যেন তারা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারে, তা নিশ্চিত করা। আর যেসব অভিবাসীর বয়স ১৮ বছরের বেশি, তাঁদের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইস) কারাগারে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে কারাবন্দী রাখা হয়।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর অভিবাসী কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আমেরিকার ফেডারেল সরকার দাঁত পরীক্ষা এবং হাড়ের এক্স-রে করে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে বয়স নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে। ফলে, বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীর আইসের কারাগারে হস্তান্তর করা হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে।

ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের তথ্যমতে, গত বছর আমেরিকার বর্ডার পুলিশ সর্বমোট ১ হাজার ২০৩ জন বাংলাদেশি অভিবাসীকে আটক করে। এঁদের মধ্যে ১৫০ জন নিজেদের অপ্রাপ্তবয়স্ক দাবি করেছে। কিন্তু ফেডারেল সরকার সে দাবির তোয়াক্কা না করে দাঁতের পরীক্ষা ও হাড়ের এক্স-রে করে বয়স নির্ধারণ করে আইসের কারাগারে সমর্পণ করেছে। এ কারণে অনেকেই কারাগারে মাসের পর মাস মানবেতর জীবনযাপন করছে।

আমেরিকার ফেডারেল আইনে শুধু দন্ত পরীক্ষা ও হাড়ের এক্স-রে করে বয়স নির্ধারণ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু সে আইন এসব বাংলাদেশি অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীর ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। ফরেনসিক পরীক্ষা করে বয়স নির্ধারণ করা সন্দেহাতীত নয়। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে, দাঁতের পরীক্ষা এবং হাড়ের এক্স-রে করে নির্ভুলভাবে বয়স নির্ধারণ করা যায় না।

ইউটি হেলথ স্যান অ্যান্টোনিয়োর ডিরেক্টর অব দ্য সেন্টার ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ড. ডেভিড সিন বলেছেন, ‘ফরেনসিক পরীক্ষা করে সঠিক বয়স নির্ধারণ করা অসম্ভব। আমরা শুধু আগের পরিসংখ্যান বিচার করে একটি ধারণার কথা বলি।’

অপ্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশিদের কারাবাস, সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের মরণপণ অভিযাত্রা এসব নিয়ে এলএ টাইমস সম্প্রতি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশিদের জন্মসনদ থেকে শুরু করে আদম পাচারকারী, ভুয়া পাসপোর্ট—এসবের কথাও বলা হয়েছে।

আমেরিকায় বসবাসরত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজ এলএ টাইমসকে বলেন, বাংলাদেশিরা নানা কারণে দেশ ছাড়ছে। এর মধ্যে জনসংখ্যার আধিক্য, যুব কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক বেকারত্ব, রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি এবং উন্নত জীবনের প্রত্যাশাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আলী রীয়াজ।

দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে আমেরিকায় ঢোকার অপেক্ষায় আছেন বাংলাদেশি শিরিল আলম (২৪)। তিন মাস আগে দালালের মাধ্যমে তিনি ব্রাজিল থেকে আমেরিকায় আসার অভিযানে নেমেছেন। নানা বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে শিরিল পানামা থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। জানিয়েছেন, ভয়ংকর যাত্রাপথে অনেককেই মারা যেতে দেখেছেন। বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে এসেছেন। এসব দালাল দেশের পর দেশে হাতবদল করছে। সর্বত্র মৃত্যুর ভয়, গ্রেপ্তারের ভয়। দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশের কারাগারে বহু আমেরিকা অভিযাত্রী আছেন বলে শিরিল জানালেন। দালাল বলেছেন, আমেরিকা সীমান্তে আসার পরই তিনি গ্রেপ্তার হবেন এবং সেখানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবেন।

দেশে যেমন আমেরিকা অভিযাত্রী লোকজনকে ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নেই, তেমনি বন্ধুর যাত্রাপথে জীবন–মরণ সংকটে পড়া ব্যক্তিদেরও খোঁজ করার কেউ নেই। ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব অভিযাত্রী মারা পড়ছেন নদীতে ডুবে, পুলিশ-সীমান্তরক্ষীর তাড়া খেয়ে। আমেরিকার ডিটেনশন কেন্দ্রে থাকা অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও আইনগত সহযোগিতা দেওয়ার কেউ নেই।

এ নিয়ে নিউইয়র্কে নাগরিক সংগঠন ড্রামের অন্যতম পরিচালক কাজী ফৌজিয়া বলেন, ‘আমরা বারবার বলে আসছি, দেশের যেসব এলাকা থেকে দালালেরা এসব লোককে স্বপ্নের দেশে নিয়ে আসার প্রলোভন দেখাচ্ছেন, তাঁদের দমন করতে হবে। আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এসব নিয়ে কোনো তথ্য জানা আছে কি না, খোঁজ নিতে গিয়ে প্রথম আলো ২৮ জুন একাধিকবার লস অ্যাঞ্জেলেসের বাংলাদেশ কনস্যুলেটে ফোন করলেও কেউ ফোন ধরেননি।

ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার শামীম আহমেদের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। কিন্তু তিনি এ বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাননি। এ বিষয়ে কথা বলতে তিনি শামীম আলম চৌধুরী নামের একজনের নম্বর দেন। কিন্তু ওই নম্বরে ফোন করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।