ট্রাম্পের বক্তব্য শুধু বর্ণবাদীই নয়, তিনি 'ফ্যাসিস্ট': ইলহান ওমর

ইলহান ওমর।
ইলহান ওমর।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ‘ফ্যাসিস্ট’, এমন মন্তব্য করেছেন দেশটির মুসলিম নারী কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মার্কিন কংগ্রেস ভবনের সামনের সড়ক পার হচ্ছিলেন ইলহান ওমর। এ সময় তাঁকে ঘিরে ধরেন সাংবাদিকেরা। একজন জানতে চান, তিনিসহ (ইলহান ওমর) চার নারী কংগ্রেস সদস্যকে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার যে কথা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তা কি বর্ণবাদী মন্তব্য?

জবাবে বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে ইলহান ওমর বলেন, ‘আমরা সবাই এই বক্তব্য বর্ণবাদী বলেছি। তার নিন্দা করেছি। আমার মনে হয় তিনি একজন ফ্যাসিস্ট।’

ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী অবস্থান আমেরিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর হামলা, এমনটা জানিয়ে ইলহান ওমর বলেন, ‘এই প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর সমর্থকেরা দেশটাকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে এসেছেন যে এখন ভিন্নমত প্রকাশ করাও এঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’ ট্রাম্পের ওই টুইটের পর ওমরের জীবনের ওপর হামলার হুমকি এসেছে। সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা মোটেই আমার একার কোনো ব্যাপার নয়। আমরা নিজের দেশকে কেমন দেখতে চাই, এটি হলো সেই লড়াইয়ের একটা অংশ।’

পরে সন্ধ্যায় ওমর মিনেসোটায় তাঁর নিজ শহরে ফিরে আসেন। মিনিয়াপোলিস বিমানবন্দরে শতাধিক সমর্থকের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক আমেরিকা চাই, যেখানে সব বর্ণের ও ধর্মের মানুষ তাদের মর্যাদা ও মানবিকতার পূর্ণ স্বীকৃতি পাবে। আর ট্রাম্প ঠিক সেই আমেরিকাকেই ভয় করেন। এই প্রেসিডেন্টের অনুসৃত নীতি এক দুঃস্বপ্নের মতো। সে নীতির প্রতিবাদ করে আমরাই তাঁর দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠব।’

সোমালিয়া থেকে কিশোর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেন ইলহান ওমর। ১৭ বছর বয়সে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন তিনি। ২০১৮ সালে মিনেসোটা থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য হিসেবে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন।

গত রোববার একাধিক টুইটে ইলহাম ওমরসহ অশ্বেতকায় চারজন নারী কংগ্রেস সদস্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করেন ট্রাম্প। এমনকি তাঁদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শও দেন তিনি। ওই সব টুইটে ট্রাম্প বলেন, ‘আমেরিকার সমালোচনা করার আগে নিজ দেশে ফিরে যাও, সেখানে অবস্থা ভালো করে ফিরে এসে আমাদের পরামর্শ দিয়ো কী করা উচিত।’

ট্রাম্পের এই মন্তব্য নিজ সমর্থকদের উজ্জীবিত করলেও বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। গত বুধবার কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ ট্রাম্পের বক্তব্য বর্ণবাদী বলে নিন্দা জানায়। ‘ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য’, এমন প্রস্তাব দেন তাঁরা। সব ডেমোক্র্যাট এই প্রস্তাব সমর্থন দেন। তবে মাত্র চারজন রিপাবলিকান ও একজন স্বতন্ত্র সদস্য এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্প আকস্মিক বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সব ‘বহিরাগতের’ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন, সে কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। নিজের পুনর্নির্বাচনের রণকৌশল হিসেবে তিনি পরিকল্পিতভাবে অভিবাসন বিরোধিতা ও অশ্বেতকায়দের প্রতি বর্ণবিদ্বেষ কেন্দ্রীয় বিষয় করে তুলতে চান। ২০১৬ সালে এই রণকৌশল ব্যবহার করে তিনি সফল হয়েছিলেন। প্রাথমিক জনমত গণনায় দেখা গেছে, এই টুইটঝড়ের পর রিপাবলিকানদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা সামান্য হলেও বেড়েছে।

এটি যে তাঁর নির্বাচনী রণকৌশল, গত বুধবার নর্থ ক্যারোলাইনায় এক নির্বাচনী জনসভায় তাঁর ভাষণ থেকেও তা স্পষ্ট হয়। সে ভাষণে ট্রাম্প তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। ওমরের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘যদি এই দেশ ভালো না লাগে, ফিরে যাও।’ কথাটা ভেবেচিন্তে বলা, কারণ টেলিপ্রম্পটার দেখে লিখিত বক্তব্য পড়ছিলেন ট্রাম্প। তাঁর সে কথা শুনে হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক ‘দেশে ফেরত পাঠাও, দেশে ফেরত পাঠাও’ বলে সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠেন।

ইলহান ওমর ও অন্য তিন নারী সদস্য ট্রাম্পের অভিবাসন ও অন্যান্য নীতির কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। বামপন্থী অবস্থানের কারণে তাঁদের নিয়ে নিজ দলের ভেতরেও সমালোচনা রয়েছে। ওমর ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরও সমালোচনা করেছেন। সে কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা এখন পুরো বিষয়টিকে একটি ‘আদর্শগত বিতর্ক’ বলে চালানোর চেষ্টা করছেন।

সিনেটর লিন্ডসি গ্রাহাম বলেছেন, এই চারজন শুধু অতি বামপন্থীই নন, তাঁরা কমিউনিস্ট।

সিনেটর মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, ট্রাম্প সম্ভবত একটা ঠিক জায়গায় হাত দিয়েছেন।

প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান গ্রুপের নেতা কেভিন ম্যাকার্থি বলেছেন, ট্রাম্পের কথায় বর্ণবাদ নেই, তিনি এই চার উগ্রপন্থীর রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা করেছেন মাত্র।

তবে সবাই বিনা প্রতিবাদে এটা মেনে নিয়েছেন, তা নয়। একজন নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্যকে ‘নিজ দেশে ফিরে যাও’ বলা যে নিন্দনীয়, রিপাবলিকান দলের লোকেরাও সে কথা বোঝেন। এমনকি ট্রাম্পের মেয়ে ও উপদেষ্টা ইভাঙ্কা ট্রাম্পও ‘বক্তব্যের উত্তাপ’ কমানোর জন্য প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিয়েছেন।

সম্ভবত সে পরামর্শের কারণেই গতকাল হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, জনসভায় ‘ফিরে যাও’ স্লোগান তিনি সমর্থন করেন না। সভায় সে স্লোগান ওঠায় তিনি ‘কিছুটা খারাপ বোধ করেছেন’ এবং দ্রুত বক্তৃতায় ফিরে যান বলে দাবি করেন।

তবে সিএনএনসহ অন্যান্য টিভি নেটওয়ার্কগুলো ভিডিও প্রমাণ হাজির করে বলছে, ট্রাম্পের এই দাবি মোটেই সত্য নয়। জনসভায় মোট ১৩ সেকেন্ড দর্শক ‘ফিরে যাও’ স্লোগান দেন। এই সময়ে ট্রাম্প তাঁদের ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই করেননি।

‘“ফিরে যাও” বলা আমি সমর্থন করি না’, ট্রাম্পের এই বক্তব্য মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, সে কথা উল্লেখ করে ওবামা প্রশাসনের সাবেক উপদেষ্টা ডেভিড এক্সেলরড বলেছেন, ‘নিজে আগুন ধরিয়ে ও হাতে কেরোসিনের বোতল নিয়ে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলছেন, না না আমি আগুন ধরিয়ে দিইনি।’

বর্ণবাদ আমেরিকার রাজনীতিতে কোনো নতুন ব্যাপার নয়। আমেরিকার শাসনতন্ত্রেই কৃষ্ণকায়দের পূর্ণ মানুষ না বলে মাত্র তিন-পঞ্চমাংশ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমেরিকার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বহিরাগত অভিবাসীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ইহুদি, আইরিশ ও ইতালীয়ও রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ আটক রাখা হয়েছে। অ্যান্ড্রু উইলসন থেকে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট পর্যন্ত অনেক প্রেসিডেন্টই খোলামেলা বর্ণবাদী নীতি অনুসরণ করেছেন। নিক্সন ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধীদের মোকাবিলায় ‘এই দেশকে ভালোবাসো নয়তো দেশ ছাড়ো’ স্লোগান দিয়ে নির্বাচনে জিতেছিলেন। তবে ট্রাম্পের মতো এমন প্রকাশ্য বর্ণবিদ্বেষী ও শ্বেত আধিপত্যবাদী অবস্থান আগে কেউ গ্রহণ করেননি। জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের কারণে আমেরিকা ক্রমে একটি অশ্বেতকায়প্রধান দেশে পরিণত হচ্ছে। শ্বেতকায়, বিশেষত কৃষিপ্রধান অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে এটি একটি প্রধান হুমকি। ট্রাম্প শ্বেতকায়দের এই উদ্বেগ ও ভীতিকে নিজের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করছেন।