প্রধান বিভেদ সৃষ্টিকারী হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প?

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে বরাবরই দেশের প্রেসিডেন্ট সংকটকালে প্রধান সান্ত্বনা দানকারীর ভূমিকা নিয়ে থাকেন। নাইন–ইলেভেনের পর জর্জ ডব্লিউ বুশ এই ভূমিকা নিয়েছিলেন। বারাক ওবামা তাঁর আট বছরে একাধিকবার এই ভূমিকা নেন। গত সপ্তাহে টেক্সাস ও ওহাইওতে পরপর দুটি নির্বিচার গুলির ঘটনায় প্রায় ৮০ জন হতাহত হওয়ার পর অনেকে আশা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও একই ভূমিকা পালন করবেন। তবে তাঁদের হতাশ হতে হয়েছে। প্রধান সান্ত্বনা দানকারীর বদলে তিনি প্রধান বিভক্তকারী হয়ে উঠেছেন।

গতকাল বুধবার ট্রাম্প টেক্সাসের এল পাসো ও ওহাইওর ডেটনে এসেছিলেন এই দুই শহরে হতাহত হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে। শুশ্রূষাকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের সেবার জন্য ধন্যবাদ দিতে। এই সময় বিভক্তি ও বেদনা উপশমের একটি সুন্দর সুযোগ ছিল ট্রাম্পের সামনে। কিন্তু সে সুযোগের সঠিক ব্যবহারের বদলে ট্রাম্প বিভক্তি আরও বাড়িয়েছেন।

সফরের আগেই উভয় শহরের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন, এই দুঃসময়ে ট্রাম্প সফরে আসুন, তাঁরা তা চান না।

এল পাসো থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য ভেরোনিকা এস্কোবার প্রেসিডেন্টের সফরের আগে নিজের উদ্বেগের কথা জানাতে টেলিফোনে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। ট্রাম্প রাজি হননি। পরে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ট্রাম্পের মোটর শোভাযাত্রার সঙ্গী হতে। সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে এস্কোবার মেক্সিকান ও অন্য অভিবাসীদের প্রতি যে ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য ট্রাম্প দিয়েছেন, সে জন্য তাঁকে প্রথমে ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দেন। এই শহরের ২১ হাজার মানুষ এক আবেদনপত্রে অনুরোধ করেন, ট্রাম্প যেন এল পাসোতে না আসেন।

ট্রাম্প আসছেন—এ কথা জানার পর থেকে দুই শহরের (এল পাসো ও ডেটন) মানুষ বিক্ষোভের আয়োজন করে। কোনো শহরেই ট্রাম্প নিজে বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হননি। তবে টিভির পর্দায় তাঁদের তিনি অবশ্যই দেখেছেন।

এল পাসোর ৮০ শতাংশ মানুষ মেক্সিকান বংশোদ্ভূত। তাদের অনেকেই হাতে প্লাকার্ড নিয়ে ট্রাম্পের উপস্থিতির প্রতিবাদ জানায়। একাধিক প্লাকার্ডে লেখা ছিল, ‘বাড়ি ফিরে যান, এখানে আপনি স্বাগত নন’।

ডেটনে ট্রাম্পের সফরের সময় শহরের ডেমোক্রেটিক মেয়র ন্যান হোয়াইলি ও ডেমোক্রেটিক সিনেটর শ্যারড ব্রাউন তাঁর (ট্রাম্প) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের বিবরণ দেন। তাঁরা জানান, শুশ্রূষাকারী ও পুলিশ সদস্যরা ট্রাম্পের উপস্থিতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁরা ট্রাম্পের বর্ণবাদী বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে হোয়াইলি মন্তব্য করেন, তিনি নিশ্চিত নন ঠিক এই সময়ে ট্রাম্পের এই শহরে আসা ঠিক হয়েছে কি না।

ডেটন থেকে এল পাসো যাওয়ার সময় উড়োজাহাজে বসে টিভিতে হোয়াইলি ও ব্রাউনের সংবাদ সম্মেলন দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ট্রাম্প। একাধিক টুইটে ও পরে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্যে এই দুই ডেমোক্র্যাটকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন ট্রাম্প। হোয়াইলি ও ব্রাউনকে তিনি ‘অসৎ মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। ব্রাউনকে একজন ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বলেও ঠাট্টা করেন তিনি।

গতকাল সকালে হোয়াইট হাউস ছেড়ে আসার আগে ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, তিনি রাজনৈতিক বিতর্ক এড়িয়ে চলতে চান। তার আগের দিন এক লিখিত বিবৃতিতে তিনি বিভক্তি ভুলে দেশের মানুষকে এই দুঃসময়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্পষ্টই সেই পরামর্শ ভুলতে তাঁর নিজের খুব বেশি সময় লাগেনি।

এল পাসোর সাবেক কংগ্রেস সদস্য ও ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বেটো ও’রুরক শ্বেত-শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উত্থানের জন্য ট্রাম্প দায়ী বলে অভিযোগ করেছিলেন। জবাবে ট্রাম্প একাধিক টুইটে ও’রুরককে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। তাঁকে মুখ বুজে থাকার পরামর্শ দেন ট্রাম্প।

সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ট্রাম্পের রোষানল এড়াতে পারেননি। গতকাল এক ভাষণে বাইডেন ট্রাম্পকে তাঁর বর্ণবিদ্বেষী বক্তব্যের জন্য কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কথা ও কাজে ট্রাম্প শ্বেত-শ্রেষ্ঠত্ববাদের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন।

টিভিতে বাইডেনের ভাষণ শুনে ট্রাম্প টুইটে লেখেন, ‘ঘুমকাতুরে বাইডেনের ভাষণ দেখলাম। ওহ্‌, কী ভয়ানক ক্লান্তিকর!’

সফর শেষে ট্রাম্পের কথা থেকে স্পষ্ট যে নির্বিচারে গুলিতে হতাহত হওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশের পরিবর্তে তিনি উভয় শহরে কী বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছেন, সে কথা প্রমাণেই অধিক আগ্রহী ছিলেন।

ডেটন সফর শেষে ট্রাম্পের বিদায় মন্তব্য ছিল, এই শহরের মানুষ তাঁকে প্রচণ্ড ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, এই সফর ছিল বিস্ময়কর।

ট্রাম্পের সামাজিক মাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা ড্যান স্ক্যাভিনো এক টুইটে জানান, শহরের মানুষ প্রেসিডেন্টকে একজন রক তারকার মতো স্বাগত জানিয়েছেন।

হতাহত ব্যক্তিদের ব্যাপারে একটি বাক্যও ব্যবহার না করায় একজন ভাষ্যকার মন্তব্য করেছেন, শহরের মানুষ যখন শোকে আচ্ছন্ন, তখনো ট্রাম্প শুধু নিজের কথাই ভাবছেন।