বর্ণবাদী নাকি সাদা সন্ত্রাসী!

দেয়াল আপনার ভেতরের আসল রোগ ঠিক করে দেবে না। আজকের আমেরিকানরা মনে করছে, তাদের হাজারো সমস্যা বিদ্যমান, যা শুধু দেয়াল নির্মাণের মাধ্যমে ঠিক হয়ে যাবে না।
ওপরের ছবি দুটো ভালো করে দেখুন। একজন সাদা চামড়ার প্যাট্রিক। আরেকজন কালো চামড়ার ডেভিড।
এই প্যাট্রিক ক্রুসিয়াসের বয়স ২১। তিনি এল পাসোতে জনাকীর্ণ চেইন শপ ওয়ালমার্টে কমপক্ষে ১৯ জনকে একে-৪৭ স্টাইলের রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছেন। ১০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। তিনি অভিবাসী বা তিনি মুসলমান নন। এমনকি আইএসও নন। তিনি এ দেশেরই একজন হোমগ্রোন সাদা সুপরিমিস্ট টেররিস্ট।
ছবি দুটো ভালো করে খেয়াল করুন। প্যাট্রিক ক্রুসিয়াসকে খুব সাবধানে কোন রকম মারধর ছাড়াই শুধু হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। দেখে মনে হয়, সামান্য কোন অপরাধ করছে। আর দেখুন ডেভিডকে।
মিসিসিপির ট্র্যাফিক লাইটে না থামার অপরাধে ডেভিড লোগানকে পুলিশের সঙ্গে থাকা টর্চলাইট দিয়ে কেমন করে পিটিয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ এমন বেধড়ক পিটিয়েছে যে, ডেভিডের একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে এবং চোখের দুটো হাড় ভেঙে গেছে। ডেভিডের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। এই দুটি বিষয়ে কয়েকজন আমেরিকানের সঙ্গে কথা বলে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, তারা বিষয়টি কেমন করে দেখছে।
সাধারণ আমেরিকানরা বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আমি যদি সাদা আমেরিকান হই, তাহলে আমি যেকোনো স্কুল বা পাবলিক চেইন স্টোর, পাবলিক প্লেস, এমনকি চার্চেও গুলি চালিয়ে মানুষ মেরে ফেলতে পারি। আমাকে আইএস বা টেররিস্ট বলা হয় না, বলা হয় বর্ণবাদী। অথবা মানসিক রোগী নাম দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কেউ কেউ বলেছে, আপনি যদি ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে থাকেন বা আবারও দেবেন ভাবছেন, তাদের আজ এই মুহূর্তে আবারও ভেবে দেখার সময় এসেছে, তাঁকে ভোট দেবেন কিনা। আমরা এই ভোটারদেরও এসব হত্যার জন্য দায়ী করতে চাই।
আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধে ও তা হয় না।
মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটাই বর্ণবাদ (রেসিজম) নামে পরিচিত। এর সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। ‘ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা জন্মগতভাবেই উৎকৃষ্ট’—এই মতাদর্শ তৈরি করা হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির শেকড় এতটাই গভীরে রোপণ করা, যার এখনো অবসান হয়নি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ বাবা হওয়ার সময়ই জানতেন বা এখনো স্বীকার করেন, এখানে সারভাইভ করতে হলে ছেলেকে শেখাতে হবে পুলিশের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয়। আরও শেখাতে হবে, গ্রেপ্তার এড়ানোর ফন্দি-ফিকির। কৃষ্ণাঙ্গ হলে যেকোনো সময় আপনার মৃত্যু হতে পারে। জেলে যেতে পারেন বা জরিমানা গুনতে হতে পারে। রোজকার জীবনে এ ভীতি তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
মার্কিন বিচার বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিকদের ট্রাফিক তল্লাশির জন্য অন্তত পাঁচ ভাগ বেশি থামানো হয়। প্রতি তিনজন আফ্রিকান আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। শ্বেতাঙ্গ সহপাঠীদের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হয় কৃষ্ণাঙ্গ স্কুল শিক্ষার্থীরাও।
বর্তমানে আমেরিকায় মোট প্রাপ্ত ডিগ্রিগুলোর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ৭৬ শতাংশ ব্যাচেলর ডিগ্রি, ৮১ শতাংশ মাস্টার্স ডিগ্রি এবং ৬৫ শতাংশ ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। কলেজে যাওয়ার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের। আগের তুলনায় ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে শ্বেতাঙ্গদের কলেজ যাওয়ার হার অনেকটাই কমেছে। আগের ৮৪ শতাংশ থেকে নেমে এখন ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের কলেজের জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে চীনারা।
আমেরিকায় বর্ণবাদী উত্তেজনা দিনদিন বেড়েই চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাবেক এক উগ্র বর্ণবাদী পুলিশ কর্মকর্তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিবাদে একই সময়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে বর্ণবাদবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। তারপরও থেমে নেই বর্ণবাদী আচরণ। বাস–ট্রেন সব জায়গা–ই খেয়াল করলে চোখে পড়ে সাদাদের দাদাগিরি। আমেরিকার শেকড় থেকে শিরায় শিরায় বর্ণবাদ। আমেরিকার বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার শেকড়েই গভীরভাবে গেঁথে আছে বর্ণবাদ। সাদা-কালো বিদ্বেষ। ওবামা বলেছিলেন, বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজে গভীরভাবে গাঁথা। এটা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজের আদি প্রবাহ। এটা আমাদের ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়।
বর্তমান আমেরিকান বলেছে, এখন তাদের উপলব্ধিতে এসেছে এটা অত্যন্ত অমানবিক একটা যন্ত্রণার ব্যাপার। গত ৫০ বছর ধরে যা চলছে, তা আর চলতে দেওয়া যায় না। আমেরিকার ইউসিএলএ বিশ্ববিদ্যালয়ে নাগরিক অধিকার বিষয়ক একটি গ্রুপের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আমেরিকার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবারও বর্ণবাদ জোরদার হচ্ছে। যেমন, নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া ও টেক্সাসের মতো অঙ্গরাজ্যগুলোর অর্ধেকের বেশি ল্যাটিন-আমেরিকান বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীরা। তারা এমন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে বাধ্য হচ্ছে যেসব প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই হলো ল্যাটিন-আমেরিকান। ইলিনয়, নিউইয়র্ক, ম্যারিল্যান্ড ও মিশিগান অঙ্গরাজ্যের কৃষ্ণাঙ্গরাও একই পরিস্থিতির শিকার। আমেরিকার আবাসন বিভাগেও আবার ফিরে এসেছে বর্ণবাদ। ফলে কৃষ্ণাঙ্গরা শহরের অভিজাত অঞ্চলে বসবাস করতে পারছে না। তাই বড় বড় শহর ছাড়া ছোট ছোট শহরে বহু-বর্ণভিত্তিক শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
সাদা সন্ত্রাসীদের ট্রাম্প প্রায়ই বলেন সমস্যাকবলিত ব্যক্তি। যারা বন্দুকের সহিংসতার হুমকি দেয়, তাদের জন্য মানসিক চিকিৎসার আরও কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একই কাজ মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক করলে তাকে আইএস বলা হয়। সম্প্রতি টুইটারে কঠোর ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের প্রয়োজন আছে এমন দাবি ট্রাম্প এখন মেনে নিতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। বর্ণবাদীদের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নমনীয় নীতি সারা আমেরিকায় সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
যদিও বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ ও উগ্র ডানপন্থীদের কট্টর সমর্থকেরা হোয়াইট হাউসে শক্ত আসন গেঁড়ে বসেছে। আমেরিকার দীর্ঘ ইতিহাসে বর্ণবাদকেন্দ্রিক সহিংসতার বহু নজির রয়েছে। তবে অনেক বছর ধরে আমেরিকায় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ও বর্ণের মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রয়েছে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিশেষ করে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়া বর্ণবাদের দৈত্য আবারও জেগে উঠেছে। উগ্র বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গরা সহিংসতার মাধ্যমে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে।
নতুন প্রজন্ম উগ্র বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সহমর্মিতার প্রতিবাদে আমেরিকার বিভিন্ন শহরের জনগণ বিক্ষোভ করছে এবং বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ক্রমেই বাড়ছে।