ঘুরে আসুন ৬০০ বছরের পুরোনো ইরোকুইন গ্রামে

ইরোকুইন গ্রাম থেকে রেটল স্নেক পয়েন্টে ফেলা ক্যাম্পে ফেরার পথে লেখক ও তাঁর দল
ইরোকুইন গ্রাম থেকে রেটল স্নেক পয়েন্টে ফেলা ক্যাম্পে ফেরার পথে লেখক ও তাঁর দল

চোখ খুলতেই দেখি একটা মশা চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেল। ইয়া বড় মশা। মুহূর্তে সমস্ত অলসতা হারাম করে এক লাফে উঠে বসলাম। আমার বড় ছেলের গলা, বাবা ওটা গ্রিন ফ্লাই। এদিকে গ্রিন ফ্লাই শব্দটা শোনামাত্র লাফ দিয়ে আমার ছোট ছেলেটাও উঠে বসেছে। মানুষের ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে, শব্দে; আর আমার ঘুম ভাঙল মশার আতঙ্কে। তাঁবুর চারদিকে চোখ বোলালাম। লম্বা একটা তাঁবু; চট করে মনে হলো, এ রকম কিছু একটা তো আজ দেখতে যাওয়ার কথা। মনটা আস্তে আস্তে ঘুমের ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে আসছে। আমরা রেটল স্নেক পয়েন্ট নামের একটি পার্কে শুয়ে আছি।
গতকাল দুপরে তাঁবু ফেলেছিলাম। সারা রাত ঝুম বৃষ্টি। তাঁবুর ভেতর আমি ও আমার মামাতো ভাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত ভূতের গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে আছে তাঁর দুই ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে, আর আমার সঙ্গে আমার গ্রেড ইলেভেনে পড়া ছেলে। সবগুলো পিঠাপিঠি, যেন একটা গ্রুপ। তবে একটা বাচ্চাও আছে, সে আমার ছোট ছেলে, থ্রিতে পড়ে।
নাশতা করে সকাল সকাল রওনা দিলাম। রেটল স্নেক পয়েন্ট থেকে ক্রোফোর্ড লেক, মাত্র নয় কিলোমিটার ড্রাইভ। প্ল্যানটা হলো—ক্রোফোর্ড লেক থেকে রেটল স্নেকে আমাদের তাঁবু পর্যন্ত হেঁটে ফিরব, আর পথে ইরোকুইন গ্রামটাও দেখে আসব। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী মামাতো ভাই আমাদের পাঁচজনকে ড্রাইভ করে ক্রোফোর্ড লেকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে এলেন। ক্রোফোর্ড লেকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ইরোকুইন গ্রাম। ক্রোফোর্ড লেকটা কিন্তু খুবই ছোট, বাংলায় যাকে দিঘি বলে। চারদিক ঘিরে শত শত বছরের পুরোনো বন। এই দিঘিকে কেন্দ্র করেই ইরোকুইন গ্রামের জন্ম। এই দিঘির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এর পানিতে অক্সিজেন খুবই কম। এত কম যে, এখানে কিছু ডুবে গেলে সেটা পচে যায় না। আর তাই এখানে শত শত বছরের পুরোনো একটা গ্রাম আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। প্রথমে পানির নিচে ওদের অনেক ব্যবহৃত জিনিস পেয়ে পর্যায়ক্রমে দিঘির পাশে আস্ত একটা গ্রামের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়।
এই গ্রামের নতুন নাম, ইরোকুইন। গ্রামটি সম্বন্ধে অবশ্য খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তবে এটা ঠিক, এরা উইডাট সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। উইডাট একটা সাম্রাজ্যের নাম; একটা জাতির নামও। ইরোকুইআন ওদের ভাষার নাম। ইউরোপীয়রা যখন অন্টারিওতে আসে, তখন এরা এই উইডাট সাম্রাজ্যের মুখোমুখি হয়। এদের জনসংখ্যা তখন ছিল ত্রিশ হাজারের বেশি। তারপর সবই ইতিহাস। আজ কয়েকটা মাত্র পরিবার এখানে-সেখানে ফাস্ট নেশন রিজার্ভে মুখ লুকিয়ে থাকে। ওরা ওদের বাপ-দাদার ভাষা ভুলে গেছে, সংস্কৃতি ভুলে গেছে। এরা না ঘরকা না ঘাটকা। সে যাই হোক, ধারণা করা হচ্ছে, এই গ্রামটা ৬০০ বছরের পুরোনো। এখানে দুই থেকে তিন শ লোক থাকত। চাষাবাদই ছিল মূল বৃত্তি। এদের বাড়িগুলো ছিল বিশাল বড়। একটা বাড়িতে ২০ থেকে ৩০টি পরিবার পর্যন্ত একসঙ্গে থাকতে পারে। আর এভাবে কতগুলো বাড়ি মিলে একটা গ্রাম। প্রতিটা গ্রাম অনেক জায়গা ঘিরে গাছের গুঁড়ি দিয়ে উঁচু করে দেয়াল ঘেরা। এই গ্রামটাও তাই। চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন গ্রামটা, টরন্টো থেকে মাত্র ২০ মিনিটের ড্রাইভ। ঠিকানা? ৩১১৫, কনজারভেশন আরডি, মিল্টন, ওএন।
গ্রাম দেখে, দিঘি দেখে, চার ছেলে নিয়ে পায়ে হেঁটে তাঁবুর দিকে রওনা দিলাম। পুরো হাঁটা রাস্তাটা বনের ভেতর দিয়ে গেছে। খুবই গভীর বন। ব্রুসট্রেইল ধরে হেঁটে এলে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরত্ব। তবে ব্রুস পেনিনসুলা ধরে হাঁটা এই পথটা কিন্তু বেশ দুর্গম। ঘন বনের ভেতর দিয়ে আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু এ পথ। পেনিনসুলা মানেই খাড়া দেয়ালের মতো উঁচু একটা প্রাকৃতিক দেয়াল। এখানে এটা কয়েক শ মিটার উঁচু। তাই এই দেয়াল বেয়ে নামা আর ওঠা, আর এভাবে ৫ কিলোমিটার হাঁটা বেশ কঠিন। আছে পথ হারানোর ভয়ও। সবচেয়ে বড় ভয়, বিষাক্ত রেটল স্নেক ও বিষাক্ত ধুতরা পাতার। পথের দুই ধারেই বিভিন্ন ধরনের ধুতরা গাছের ছড়াছড়ি।
অবশ্য সঙ্গে আছে ফাস্ট এইড কিট, মাসাটি, বাঁশি ও অনেক অনেক পানি। সবার আগে আমার পনেরো বছর বয়সী বড় ছেলে, এরপর মামাতো ভাইয়ের দুই ছেলে, সবার শেষে আমার সাত বছরের ছোট ছেলে ও সব শেষে আমি—লাইন ধরে হাঁটছি। কেউ ভুল পথে হাঁটা দিলেই আমি বাঁশি বাজিয়ে ধমক দিই। ম্যাপ দেখে দেখে সাবধানে আমরা এগোতে লাগলাম। কোথাও কোনো সমস্যায় না পড়েই অনেক ছবি তুলতে তুলতে অবশেষে রেটল স্নেক পয়েন্টে আমাদের তাঁবুতে ফিরে এলাম। মাত্র দু ঘণ্টায় পথটা শেষ হয়ে গেল। আমার সাত বছরের ছোট ছেলেও ক্লান্ত হয়নি। সবাই খুশি। বিকেলে বাসায় গিয়ে আমার বউ, মামাতো ভাবি আর দুই মেয়েকেও নিয়ে এলাম। সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত বন ফায়ার হলো। চাইলে আপনারাও যেতে পারেন সবুজের মাঝে এমন ক্যাম্পিংয়ে।