'ড্রিবল মিশিগান' ও মিশিগান প্রবাসী বাংলাদেশি ফুটবলারদের ইতিকথা

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বনভোজনে ড্রিবল মিশিগানের সদস্যরা
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বনভোজনে ড্রিবল মিশিগানের সদস্যরা

বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত খেলা ক্রিকেট হলেও সেই আদিকাল থেকে বেশির ভাগ বাংলাদেশির প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। একটা সময় ছিল, যখন দেশের মানুষের বিনোদনের মাধ্যম ছিল খুব সীমিত। সেই সময় ফুটবলের মতো জনপ্রিয় খেলা তাদের বিনোদনের খোরাক জোগাত বহুলাংশে। দেশের জাতীয় দল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তেমন সফলতা দেখতে না পারলেও মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো জাতীয় পর্যায়ের ফুটবল ক্লাবগুলো ভক্ত ছিল দেশজুড়ে। গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলাগুলোয় দেশের সবচেয়ে বড় ক্লাব মোহামেডান ও আবাহনী যখন মুখোমুখি হতো, তখন প্রায় সারা দেশ দু ভাগে ভাগ হয়ে যেত। ঢাকা স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত দর্শকে। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, বিচ্ছিন্ন মারামারির মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে দেখা যেতো প্রায়ই। এসব এখন শুধুই ইতিহাস।

কালের আবর্তে ক্রিকেট দেশের সবচেয়ে আলোচিত খেলা হয়ে ওঠায়, ফুটবল তার জৌলুশ হারায়। ফুটবলের সেই জমজমাট যুগে কিছু বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমী আসেন মিশিগানে। তাঁরা দেশের ফুটবলের সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেই স্বল্প পরিসরে স্থানীয় জেইসি পার্কসহ বিভিন্ন মাঠে খেলা শুরু করেন। তবে যথেষ্ট খেলোয়াড় না থাকায় বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়ের সমন্বয়ে তাঁরা নিয়মিত খেলতে শুরু করেন। সময়ের আবর্তে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তাঁরা শুধু বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের নিয়েই খেলা শুরু করেন। তখন থেকে এটা মূলত বাংলাদেশিদের ফুটবল দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তবে সেই সময় যোগাযোগ এত উন্নত না থাকায় সমন্বিত টিমওয়ার্ক ছিল না। এই সমস্যা উপলব্ধি করে ২০০৭-০৮ সালের দিকে কন্টিনেন্টালে কর্মরত সফটওয়্যার প্রকৌশলী কর্মকর্তা জিন্নু রাইনের (রাজীব) উদ্যোগে ‘ড্রিবল মিশিগান’ নামে একটি ই-মেইলভিত্তিক গ্রুপ তৈরি করে প্রতি সপ্তাহের খেলার মাঠ ও সময়সূচি জানানোর একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্ম যাত্রা করে। তখন থেকে শুরু হওয়া সেই গ্রুপের অধীনেই আজও প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত বাংলাদেশি ফুটবল খেলোয়াড়দের জমজমাট আসর বসে মিশিগানের ট্রয় অঞ্চলের বিভিন্ন মাঠে।

প্রায় ১৮ বছর আগে শুরু হওয়া সেই বাংলাদেশি ফুটবল আসরের অনেক সদস্য বিভিন্ন কারণে অন্য অঙ্গরাজ্যে চলে গেলেও অনেক সদস্য এখনো মিশিগানে রয়ে গেছেন। প্রথম পর্যায়ে যারা খেলা শুরু করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ফেরদৌস গাজী, আবিয়া নেতা মনির জামান, ফোর্ড মোটর কোম্পানির প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট ও বুয়েট টিমের সাবেক ফুটবলার গোলাম মুস্তাফা, মিশিগানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার ও ফোর্ড মোটরসের প্রকৌশলী আলমগীর হোসাইন, জেনারেল মোটরসের প্রকৌশলী ফুটবলার জিয়া হক ও সোহেল আহমেদ, ময়মনসিংহ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক ফুটবলার প্রকৌশলী তারিক মাহমুদ (সজু), ট্রয়ের ব্যবসায়ী আরিফ শাকুয়া, টিআরডাব্লিউর প্রকৌশলী এবং সাবেক ফুটবলার মো. আরিফ ইসলাম (নাজমুল) প্রমুখ।

ড্রিবল মিশিগানের ইতিহাস সম্পর্কে জেনারেল মোটরসের টেকনিক্যাল লিড ইঞ্জিনিয়ার ও ড্রিবল মিশিগানের সিনিয়র সমন্বয়কারী মো. শহিদুল আলম খান (রুবেল) বলেন, ‘মিশিগানের ট্রয় ও এর আশপাশের শহরে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের আগমন সেই ২০০০ সাল থেকেই। সেই সময় এদিকে টিম করে খেলার মতো যথেষ্ট খেলোয়াড় না থাকায় ক্যান্টন শহরের ওদিকে গিয়ে খেলতে হতো। সময়ের আবর্তে অনেক ফুটবলার ট্রয়ের আশপাশের শহরে বসবাস শুরু করলে আমরা নিজেরাই স্থানীয় জেইসি পার্কে খেলা শুরু করি। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ড্রিবল মিশিগান আজ বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীদের একটি সুপরিচিত গ্রুপে পরিণত হয়েছে, যা এখন শুধু একটি ফুটবল গ্রুপই নয়, বিভিন্ন পেশাজীবীদের একটা নেটওয়ার্কিং গ্রুপ হিসেবেও কাজ করছে। অসংখ্য সদ্য পাস করা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে ড্রিবল মিশিগান।’

নিজেদের পেশার পাশাপাশি নিয়মিত ফুটবল খেলার এই অনুশীলন ধরে রাখা সম্পর্কে ফিয়াট-ক্রাইসলারের প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ার ও ড্রিবল মিশিগানের সিনিয়র সদস্য ইমরান হোসাইন বলেন, ‘অনেক ছোটবেলা থেকেই ফুটবল আমাদের প্রিয় খেলা। সে হিসেবে খেলাধুলার চর্চাটা ধরে রাখার চেষ্টা করি। নিয়মিত জিমে গিয়ে ট্রেডমিলে দৌড়ানোর চেয়ে মাঠে গিয়ে সবাই ফুটবল খেলার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না। তা ছাড়া মিশিগানের গ্রীষ্মকাল খুব সংক্ষিপ্ত। তাই আমরা চেষ্টা করি এ সময়টা একটু ভালোভাবে কাজে লাগাতে।’

বর্তমানে সপ্তাহে নিয়মিত দু দিন, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার বিকেলে ট্রয় সিটির ব্রিন্সটন পার্কে ড্রিবল গ্রুপের ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ২০/২৫ জন বাংলাদেশি ফুটবলার নিয়মিত অংশ নেন। কখনো ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, কখনো আন্ডার ৩৫ বনাম ওভার ২৫-এ ভাগ হয়ে, কখনোবা পূর্বাঞ্চল বনাম পশ্চিমাঞ্চল, কখনো ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা, আবার কখনো মোহামেডান বনাম আবাহনী সমর্থক দলে ভাগ হয়ে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলা শেষে প্রায়ই বিরিয়ানি, শিঙাড়া, সমুচাসহ দেশি মজাদার খাবারের ব্যবস্থা থাকে, যেখানে খেলোয়াড়দের পরিবার-পরিজনও অংশগ্রহণ করে।

প্রতি বছরের মতো এবারও আমেরিকার মিশিগান অঙ্গরাজ্যের বৃহত্তর ট্রয় অঞ্চলে বসবাসরত বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ড্রিবল মিশিগান’-এর বার্ষিক পিকনিক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৪ আগস্ট শেলবি টাউনশিপের স্টোনিক্রিক মেট্রো পার্কে এ বনভোজন অনুষ্ঠিত হয়। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি তাঁদের পরিবার-পরিজনের উপস্থিতির কারণে পিকনিকটি হয়ে ওঠে ফুটবলপ্রেমী বাংলাদেশিদের এক মিলনমেলা। বনভোজনে ঝালমুড়ি, শিঙাড়া, বারবিকিউ, বার্গার, দেশি স্বাদের বিরিয়ানি, হাতে বানানো বুন্দিয়াসহ বিভিন্ন রকম মিষ্টান্ন এবং মৌসুমি ফলের সমারোহ ছিল। ছিল ভলিবল, ক্রিকেটসহ নানা রকম খেলাধুলার ব্যবস্থাও।

ড্রিবলের কোনো ফরমাল কমিটি না থাকলেও প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক দায়িত্ব এক-এক সময় এক-একজন স্বেচ্ছায় পালন করেন। বর্তমানে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক দায়িত্বে রয়েছেন দুই তরুণ প্রকৌশলী ও ফুটবলার অভি বিশ্বাস ও প্রণব চৌধুরী (শাওন)। এ দুই তরুণ সংগঠক গত দুই সেশনে সাফল্যের সঙ্গে ড্রিবলের প্রতি সপ্তাহের ম্যাচ আয়োজনের পাশাপাশি বার্ষিক পিকনিকসহ বেশ কিছু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ইভেন্টের আয়োজন করেন। শুধু তাই নয়, ড্রিবল আগে শুধু সামার ফুটবল গ্রুপ থাকলেও এখন এটি শীতের সময়ও ইনডোর ফুটবলের আয়োজন করে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আগামী শীতেও ইনডোর ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।