ফোবানা সম্মেলন নিয়ে প্রবাসীর আত্মকথন

ফোবানা সম্মেলনে দর্শক সারিতে প্রবাসীরা
ফোবানা সম্মেলনে দর্শক সারিতে প্রবাসীরা

‘যত গর্জে তত বর্ষেনা’—এই প্রবাদের সঙ্গে আমরা কম বেশি অনেকেই পরিচিত। তীব্র গর্জনের পরে আপনাকে ভেজানো দূরের কথা, বৃষ্টির কণাটুকুও অনুভব করতে না পারলে, একে আপনি কি বলবেন? ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শেষ হয়ে গেল ৩০ আগস্ট থেকে তিন দিনব্যাপী ৩৩তম ফোবানা সম্মেলন। এক পক্ষ নাসাউ কলিসিয়াম এবং অন্যপক্ষ লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট হোটেলে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল।

ফোবানা সম্মেলন মূলত উত্তর আমেরিকার প্রবাসীদের মিলনমেলা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেই মিলনমেলা মিলনের না হয়ে এবার আলাদা হওয়ার নির্লজ্জ উপস্থিতি প্রকাশ করল। এর কারণ হিসেবে অনেকেই বলেন ও মনে করেন, নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব। আহারে নেতৃত্ব! গত দুই বছরে নিউইয়র্কের বাসিন্দা হয়ে একটি মাত্র খাঁটি বাঙালিয়ানা খুঁজে পাই। আর তা হচ্ছে দলাদলি- কোন্দল! সেই সঙ্গে নেতৃত্বের দখল নিয়ে মামলা। সে আপনি রাজনৈতিক দল বা সাহিত্য সংস্কৃতি আসরে হোক, যেকোনো সংগঠনে যান এমনকি জেলা বা উপজেলা সমিতির বেশির ভাগেই একতার বদলে বিভক্তির চরম নগ্ন প্রকাশ।

নিউইয়র্ক শহরে এখন ঠিক কত বাঙালি আছে, তা সঠিকভাবে জানা নাই। তবে এটা বোঝা কষ্ট নয়, এ শহরে বাঙালির উপস্থিতি একেবারে কম নয়। আপনি যদি ভুল করে কখনো সন্ধ্যা বা শেষ বিকেলে ১৬৮ স্ট্রিট হিলসাইড, ৭৪ জ্যাকসন হাইট্‌স/ডাইভার্সিটি প্লাজা এবং এর আশেপাশে, স্টার্লিং অ্যাভিনিউ ব্রঙ্কস অথবা চার্চ অ্যাভিনিউ ম্যাকডোনাল্ড, ব্রুকলিন এখন ভিন্ন জনারণ্য। আপনার মনে হতেই পারে, আপনি আমেরিকা নয়, ঢাকা শহরের শাহবাগ, কারওরান বাজার বা ফার্মগেটের কোনো এক জায়গায় এসে পড়েছেন। চারপাশে বাংলা সাইনবোর্ডে রেস্টুরেন্ট, দোকান, সুপারশপ আর বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। এরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা-সিগারেট খাচ্ছে আর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তর্ক, গপ্প করে চলেছে। এদের বেশির ভাগই মধ্যবয়সী।

ওপি-ওয়ান, ডিভি লটারি, পারিবারিক ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা, ভিজিট ভিসা এমনকি সীমান্ত পাড়ি দিয়েও কেউ কেউ এ দেশে এসে বসতি গড়েছেন। এদের মধ্যে কাগজপত্রবিহীন মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। বছরের পর বছর এসব কাগজপত্রবিহীন মানুষ দেশে থেকে পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন। একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় এরা পড়ে আছেন এই প্রবাসে, কিন্তু এদের বুকের মধ্যে বাংলাদেশ। অন্তরের অন্তস্তল থেকে এরা বাংলাদেশের আবহাওয়া, নদী, প্রকৃতি আর আপনজনকে ধারণ করেন এবং এরা সবাই শ্রমিক শ্রেণি। দিন রাত কঠোর শ্রম দিচ্ছেন একটা ডলার পাওয়ার আশায়, সেই সঙ্গে আড্ডা বা আনন্দের খোরাক জুগিয়ে নিচ্ছেন দেশি স্টাইলে। এদের এসব সহজ সরল বাঙালি বাসনাকে পুঁজি করে একদল মানুষ দিনের

পর দিন প্রতারণা আর ঠকবাজির ব্যবসা করে যাচ্ছেন অবলীলায়। কখনো সমিতির নামে, কখনো অ্যাসোসিয়েশনের নামে কখনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে।

প্রতিটা সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম চোখে পড়ে বছরে একবার পিকনিক বা নেতা নির্বাচনের সময়। সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশনগুলো প্রচারণার পেছনে বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে নির্বাচনের সময় নিজেদের প্রার্থিতা নিশ্চিত ও ভোটে জয়লাভ করতে। দুই বছরের বেশি সময় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা হওয়ার পরেও মামলার কারণে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন হয়নি, কিন্তু প্রচারণার কমতি ছিল না। এসব অ্যাসোসিয়েশন মূলত কমিউনিটিতে কী ভূমিকা রাখছে, সেটা বোধ করি কেউ জানে না।

অথচ এই মুহূর্তে আমেরিকার অভিবাসীরা সবচেয়ে দুঃসময় পার করছে। ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে বেপরোয়াভাবে কালো ও বাদামি অভিবাসীদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আইসের ধরপাকড়ের হাত থেকে কাগজপত্রওয়ালা বা কাগজপত্রবিহীন—কেউই রেহাই পাচ্ছে না। সামান্য ছুতোয় বহিষ্কার হয়ে যাচ্ছে কত শত মানুষকে।

এর ওপরে এসেছে পাবলিক চার্জের খড়্গ! অভিবাসীদের বেশির ভাগ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপরে নির্ভরশীল। কেউ ফুডস্টাম্প, কেউ সরকারি আবাসন আবার কেউ স্বাস্থ সেবা নিচ্ছেন। নতুন আইনের কারণে এদের অনেকেই এসব সেবা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। এসব সেবা গ্রহীতাদের অনেকেরই পরিবার-পরিজনের অভিবাসী হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া চলমান আবেদনে অনুমোদন বা অভিবাসী কাগজ পাওয়ার ক্ষত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। ফলে তারা ঝুঁকি নিয়েও এসব সেবা থেকে সরে আসছেন। এ দেশে সাধারণ কায়িক শ্রম করে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো বা ওষুধের ব্যয় মেটানো দুঃসাধ্য।

এ রকম হাজারো জাতীয় সমস্যার পাশাপাশি আছে সামাজিক সমস্যা। কিন্তু কখনই কোনো অ্যাসোসিয়েশন বা সমিতিকে এসব সমস্যা নিয়ে কাজ করতে দেখা যায় না। এমনকি নতুন যারা অভিবাসী হয়ে আসেন, তাদের কর্মসংস্থান বা অভিবাসন ক্ষেত্রেও নেই কোনো নির্দেশনামূলক কার্যক্রম।

এই যে এত বাঙালি নিউইয়র্কে বা পুরো আমেরিকায়, কিন্তু সাবওয়ে বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলায় নির্দেশনা নাই। তবে আপনি চাইলে দোভাষীর সাহায্য নিতে পারেন সিটি বা রাষ্ট্রীয় কাজে। দু-একটা অফিশিয়াল কাগজ বাংলায় পাওয়া যায়, কিন্তু তার ভাষা দেখে আপনি ভিরমি খাবেন। এসব নিয়ে কোনো উচ্চ বাচ্য নেই।

এত বড় জনগোষ্ঠীর একটা শহরে নেই কোনো বাংলা সংস্কৃতি কেন্দ্র। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সংগীত আয়োজনের নামে যা হয়, তা নিয়ে কথা বলতে গেলে আসলে ভাষা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রায় প্রতিটি দেশের জাতীয় দিবসে বড় বড় রাস্তায় কি অসাধারণ শোভাযাত্রা দেখা যায়! কিন্তু আমাদের জাতীয় দিবসগুলোতে সেই ভাগাভাগি, যে যার মতো অনুষ্ঠান করে, কেউ কারওটায় যায় না, দেখেও না।

কিন্তু এসবের মধ্যে তাদের সন্তানদের তেমন দেখা যায় না। কোনো কমিউনিটি অনুষ্ঠানেও এই প্রজন্ম যারা নিউইয়র্কে জন্ম বা বেড়ে উঠেছে, তাদের কেউ তেমনভাবে অংশ নেয় না বা নিতে চায় না। দু-একটা ব্যতিক্রম যেমন বাফা বা বিপার মতো সংগঠনগুলো পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালি আমেরিকান ছেলে-মেয়েদের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার একটা অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এ ছাড়া মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলা একটা আকর্ষণীয় ঐতিহ্যগত সুনাম থাকলেও সেটিও প্রশ্নের বাইরে নয়।

হ্যাঁ, নতুন প্রজন্ম আমেরিকান বাঙালি, বিশাল একটা সম্ভাবনা নিয়ে যারা পড়াশোনাসহ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে চলছে, এদের শিকড় কিন্তু তেমনভাবে বাঙালি বা বাংলাদেশ কেন্দ্রিক নয়। এরা তাদের পূর্বসূরিদের কাজ-কর্মে বড়ই বীতশ্রদ্ধ।

এবারের ফোবানা সম্মেলনের স্লোগান ছিল ‘আমার সন্তান আমার অহংকার’। অবশ্যই আমাদের সন্তান আমাদের অহংকার, কিন্তু সেই সন্তানের অহংকারের ভিত্তি আমরা তাদের পূর্বসূরি। আমরা কি আদৌ এমন কিছু করতে পারছি যা তাদের অহংকার এনে দেয়, গর্বিত করে একজন বাঙালি-আমেরিকান বা একজন বাঙালির উত্তরাধিকার হিসেবে?

৩০ আগস্ট শুক্রবার থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত দুই দুইটা ফোবানা সম্মেলনে ঠিক কত টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছে, তা মনে করতেই আমার ভিরমি খাবার জোগাড়। অনেকে বলবেন, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে নেওয়ার কি দরকার? হ্যাঁ, আমি আদার ব্যাপারী, এই শহরে, এই দেশে হাজারো শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষ যাদের এক একটা ডলার রক্ত ঘামের বিনিময়ে অর্জন, তারা আপনাদের এই নেতাগিরি আর শো–আপ টিকিয়ে রাখার কুট-কৌশলের জালে বন্দী হয়ে আছে। সারা সপ্তাহ বা বছর এরা পরিশ্রম করে, এদের বিনোদন দেওয়ার নাম করে সেই রক্ত ঘামের ডলার আপনি, আপনারা যা ইচ্ছা তাই করে যাবেন দিনের পর দিন, সেটা কি চলতে দেওয়া যায়?

আমি জানি, নিজেরা নিজেরা চায়ের আড্ডায় অনেকেই এসব নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ সাহস পান না বা বলতে চান না।​ কারণ এদের অনেকেরই অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। নাসাউ কলিসমিয়াম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভেন্যু, সে বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। আমি সবিনয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই, ১৫ হাজার লোকের ধারণ ক্ষমতার এই ভেন্যুতে দুই হাজার লোকও আপনারা জমায়েত করতে পারেননি কেন? সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ন্যূনতম টিকিট মূল্য ছিল ৩০ ডলার। আর সেই টিকিট বেচে দর্শকদের আপনারা যা দেখিয়েছেন, তা আসলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে কতটা প্রতিনিধিত্ব করে বা আমাদের অহংকার কতটা উচ্চ হয়? অথবা স্টল মালিকেরা যখন ক্ষুব্ধ হয়ে আয়োজকদের মারতে উদ্যত হয় এবং নাসাউ কর্মচারীদের মধ্যস্থতায় তা মীমাংসা হয়, তখন আসলে আমরা কতটা সম্মানিত হই?