নয়নরঞ্জন অনাদিনিধন নিসর্গ

শরৎকে কৃষাণের হাতে দিয়ে বর্ষা চলে গেছে

কর্দমাক্ত পিচ্ছিল মেঠো পথ রয়েছে এখনো,
খালি পায়ে নিবিষ্ট মনে হেঁটে চলি
পায়ের আঙুলের ফাঁকে কাদাপানি করে খেলা
টের পাই মাটির হৃৎস্পন্দন;
নয়নশোভন খালে-বিলে জল করে টলমল
হাঁসা-হাঁসি করে নিবিড় কানাকানি
দীর্ঘ হয় নয়নবাণ, দীর্ঘ হয় মধুর মিলন,
তারপর ওরা প্রশান্তির ডুব-সাঁতার কাটে
সজোরে ডানা ঝাপটায় বাড়ে জলের হৃৎকম্পন।

জগন্মাতার সবুজ ধানের পাতায় পাতায় শরতের নাচন জাগে
সকালের বিশুদ্ধ বাতাস শরীরে জড়িয়ে জগতীর নির্জন পথে
শিশিরে ভেজা মাঠে আমি নগ্ন পায়ে হেঁটে চলি,
পায়ের পাতায় শিশিরের শীতল পরশে
নির্মোহ সুখানুভব জাগে।
কাশবনে সাদা ফুলে ফুলে সকালের মিষ্টি স্নিগ্ধ আলোয়
দীর্ঘ পুণ্যস্নান শেষে আমার মনে হয়—
চিত্রলেখা সিঁথিতে সিঁদুর আর দুর্বা ঘাস দিয়ে
কোমরে শাড়ির আঁচলে হাত ভর্তি শাঁখা-চুরিতে,
ঝিনিকিঝিনি তালে তালে এলোমেলো চুল উড়িয়ে হাওয়ায়—
নলিনাক্ষ দিয়ে আমায় ডাকে ইশারায়।

চোখে স্বপ্ন নিয়ে ইক্ষুখেতে পরিশ্রান্ত ইক্ষুচাষি
কাঁঠালগাছে কাঠঠোকরার অক্লান্ত পরিশ্রম দেখে থমকে দাঁড়াই
কাঠের ভেতরে একটি ঘরের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা
বৃক্ষের ব্যথায় আমিও ব্যথিত হই, কাছে যাই,
বৃক্ষের রক্তক্ষরণ দেখি
ক্ষতচিহ্নে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিই
বৃক্ষের কান্না শোনার জন্য কান পেতে থাকি
একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কাঠঠোকরার
ধারালো ঠোকরের যন্ত্রণার ভেতরে নতুন অতিথির
আগমনী বার্তায় দুলে ওঠে কাঁঠালবাগান।
প্রসবযন্ত্রণায় অস্থির মা শিশুকে কোলে নিয়ে যেমন যন্ত্রণা-কষ্ট ভোলে
তেমনি ভোরের আলো-বাতাস গায়ে মেখে আমিও আজন্ম
দুঃখ-কষ্ট ভুলতে থাকি প্রিয় জন্মভূমি বসুন্ধরাকে বুকে নিয়ে।

আচমকা চমকে দেবে বলে কদম গাছে এখনো ফোটে কদমফুল
তাল গাছে পাকা তাল, আতা গাছে পাকা আতা
নারকেল গাছে পাকা নারকেল;
আমার বুকের জমিনে জাগে জগদীশ্বরের নামকীর্তন ও মহিমাকীর্তন
আর নিসর্গের সবুজ বসতবাটীর নিরুপম সমারোহে
বাঁশবাগানের ঝোপে-ঝাড়ে বয়ে যাওয়া নিরন্তর মৃদু-মন্দ বাতাসে
সারিবান্ধা সুপারি বাগানের ঝিরিঝিরি পাতায় পাতায়
নিরন্তর জ্যোতিময়ী জাদুর কাঁপনের ভেতরে
আমার একান্ত নির্জনবাস, এই আমার শারদীয় মধুমাস।
নর্মসঙ্গিনী বসুধা এখন আমার কষ্ট ভোলার ও ভালোবাসার দীক্ষাগুরু
নয়নরঞ্জন অনাদিনিধন এই নিসর্গের প্রতি আমার প্রগাঢ় প্রণতি ও প্রেম।