বাবা বেঁচে থাকুক তৃপ্তির স্বাদ নিয়ে

‘বাবা, আমি কি খুব বড় হয়ে গেছি?
মনে পড়ে কি সেই দিন, সেই ক্ষণের কথা,
স্কুলের কাঁদা মাখা পথে চড়েছি তোমার কাঁধে
রাতের জোছনার আলোয় ঘুমিয়েছি
তোমার বিশাল বক্ষে!
মনে পড়ে কি?
জ্বর কিংবা সামান্য ব্যথায় আমি কেঁদেছি,
আর তুমি চোখের জল ফেলেছ নীরবে-নিভৃতে!
আমি অবাক হয়ে তোমার ভালোবাসা
আমার কচি হৃদয়ে অনুভব করেছি।’

সময়টা খুব দ্রুত চলে যায়। আগামী দিনগুলো উঁকি মারে বারবার। পেছনে ধূসর স্মৃতি অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। তার পরেও স্মৃতির পাতাটা উল্টিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।
বাবার প্রাথমিক শিক্ষার দৌড় প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত হলেও জ্ঞানের পরিধি নেহাত কম নয়। স্মৃতি রোমন্থনে বাবা সেদিন বলছিলেন, এখন সন্তানেরা স্কুলে না গেলে পিতা-মাতা রাগ করেন, ‘আর আমাদের সময়ে স্কুলে গেলে পিতা-মাতা রাগ করতেন। স্কুলে না গিয়ে গরু-ছাগলের জন্য ঘাস কাটা মানে কপালে ছিল দুধের সর ও মাংসের বড় টুকরা।’
দিন পাল্টেছে, পাল্টেছে মানুষের ধ্যান ধারণা। যুগে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। সেই হাওয়ার পাল তুলেছে এ প্রজন্ম। ১৩ বছরে বাবা হারানো বাবা অনেকটা অবহেলায় বেড়ে ওঠেন। যে বয়েসে স্কুলে পেনসিল ধরার কথা, সেই বয়সে তুলে নিলেন কর্মযজ্ঞের সরঞ্জাম। কাজের তাগিদে ছুটে গেছেন কলকাতা, আবার কলকাতা থেকে করাচি। টাকার অভাবে অনেকের কাছে হাত পেতে জাহাজে করে করাচির বন্দরে নোঙর ফেলে শুরু করেন বাস্তবতার কঠিন সময়।
তারপর বাস্তবতার কঠোর কশাঘাতে ফিরে আসেন গ্রামে। চলে সংগ্রাম লাঙলের সঙ্গে। সময়ের টানে বাঁধেন ঘর। নিয়মের তাগিদে। আলাদা সংসার। মায়ের হাতে সংসারের চাবি। বাবা অনাগত সন্তানদের কথা ভেবে ঢাকার কংক্রিট জীবনযুদ্ধে বইঠা ধরেন। সামান্য আয়ের বেশির ভাগ ব্যয় করেন সন্তানদের শিক্ষা সাগরে।
বাবাকে বাড়িতে খুব বেশি না পেলেও যতটুকু সময় পেয়েছি, নিয়েছি বাবার আদর-স্নেহ-ভালোবাসা। চড়াখোলা থেকে কালীগঞ্জ বাজারের পাঁচ মাইল দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি পায়ে হেঁটে। বাবার হাতে ব্যাগ, কাঁধে আমি। ঘর্মাক্ত বাবার কপালে ঘামের বিন্দু এই তো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
দুপুরে জোয়ারের জলে বাবার হাত ধরে সাঁতার শেখা। এক পা দুই পা করে গভীর জলে নামা। শিখেছি গভীরের বাস্তবতার প্রতিকূলতার যুদ্ধে কীভাবে লড়তে হয়। ২০০৭ সালে দেশ ছাড়ার মুহূর্তে প্রিয়জনদের বিদায়ে কষ্টটা বেড়ে গিয়েছিল। বাবা জানতেন বিদেশ মানেই পরাধীনতাকে বরণ করে নেওয়া। আগেই বলেছিলেন, প্রতিটি সময়, কাজ ও মানুষকে নিজের করে নিতে হয়। এতে কষ্টের লাঘব ও তৃপ্তির স্বাদ পাওয়া যায়। চেষ্টা করেছি।
বাবা-মা দুজনের খুব ইচ্ছে ছিল আমেরিকার বাতাসের স্বাদ নেওয়ার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। মা শয্যাশায়ী। দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন বিছানায়। কাউকে চিনতেন না। ২০১৭ সালে চলে গেলেন মা। বাবা আর আসতে চাইলেন না।
এক প্রকার জোড় করেই ভাতিজা বাবু পাসপোর্ট, ভিসা সব ঠিক করে দিলে বাবা আমেরিকার বুকে পা রাখেন ৮৬ বছর বয়েছে। এখানকার অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ হন বাবা। পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি, সুন্দর ছিমছাম বাড়ি দেখে বাবা আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন।
সিলভার স্প্রিংয়ের মাদার তেরেসা পাড়ায় পরিচিত মানুষ। কথার ছলে হারিয়ে যাওয়া দিনের স্মৃতি রোমন্থন, বাবাকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। মনের অজান্তে বাবা বলেন, এ যেন ছোট বাংলাদেশ। বাবা লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে বেড়ান। বাবাকে দেখাই এই দেশের স্থাপত্য শিল্প, ধর্মীয় উপাসনালয়, সবুজ অরণ্য, বাজার ও বিশাল বিপণি। বাবার হাত ধরে ছেলেবেলায় হেঁটেছি, বাবা আজ আমার হাত ধরে হেঁটে বেড়ান।
বাবা প্রথম আলোর নিয়মিত পাঠক। গ্রামের চায়ের দোকানে বসে প্রথম আলোর পাতা ওল্টান আমার লেখার পড়ার জন্য। আমার লেখা ছাপা হলে সেই কপিটা সবাইকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই যে আজকের প্রথম আলোতে আমার ছেলের লেখা ছাপা হয়েছে।’ বাবার পরম তৃপ্তির কথা শুনে আমি তৃপ্তির স্বাদ নেই। এভাবেই বাবা বেঁচে থাকুক তৃপ্তির স্বাদ নিয়ে।