ভয় পেলে কি চলে

সাবধানের মার নেই। তারপরও বিপদ হতে পারে। শাফকাত অনেক চেষ্টা করেও এই সত্যটা বোঝাতে পারেননি। অবশেষে তিনিই হার মেনেছেন। এখন এসব বিষয়ে তেমন আর‌ কথা বলেন না। টিভির সামনে বসে নেগেটিভ নিউজ দেখতে দেখতে তিনি কি আসলেই বাস্তব থেকে হারিয়ে গেছেন? বোঝার চেষ্টা করেন। লাখ লাখ মানুষের মাঝে দু-একটা দুর্ঘটনা হতেই পারে। এ নিয়ে এত ভাবনার কী আছে?
-বাবা তুমি এসব নিউজ-টিউজ দেখা বন্ধ কর। ওদের কাজই হলো তোমাকে ভয় পাইয়ে দেওয়া। ওদের কথায় কান দিলে কেউ আর রাস্তায় বের হবে না।
শাফকাত তবুও নিউজ দেখেন। ছেলেমেয়েরা ঘরে থাকলে নাটক বা মুভি দেখার চেষ্টা করেন। তবে ইংলিশ মুভি দেখা শুরু করলে একটার পর একটা দেখতেই থাকেন। বাংলা নাটকের বেলায়ও তাই। সে সময় কেন যেন নিজের দায়িত্ববোধের কথা বেমালুম ভুলে যান। কাজে যেতে ইচ্ছে করে না। কাজে না যাওয়া মানে বিরাট গচ্চা। মনে মনে ভাবেন পরের দিন পুষিয়ে নেবেন। সেটা যে আদৌ সম্ভব নয়; নীলিমা ভালো করে বোঝেন। তখন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। ‘তাহলে আজকে আর কাজে যাচ্ছ না?’, স্ত্রীর উৎকণ্ঠা।
এভাবে অনেক দিন কাজ মার দিয়েছেন শাফকাত। স্বাধীন পেশা। ফায়ার হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
সেদিন নীলিমা এসে বললেন, ‘জান, দু তলার মেজো ছেলে একটা লোককে দেখেছে ফায়ার এক্সিটের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে। ওর মা বাবা তেমন পাত্তা দেননি। নিশ্চয়ই মাকে ভয় দেখানোর জন্য এই গল্প ফাঁদা।’
শাফকাতও জানেন, তাদের নেইবারহুড অনেক নিরাপদ। এ দেশের ছেলেমেয়েরা যে কী হয়েছে! এমন ভয় কি কেউ মাকে দেখায়? হরর মুভি দেখতে দেখতে সবকিছুতেই দুষ্টুমি।
আগে প্রায়ই ছাদে পায়ের আওয়াজ শুনতেন, যেন কেউ হাঁটছে। হয়তো ওপরে উঠে কেউ গল্প করছে। ছাদ থেকে পুরো ম্যানহাটনের আকাশছোঁয়া দালানগুলো দৃষ্টিসীমায় থাকে। অপূর্ব আলোকসজ্জায় সজ্জিত দালানগুলোতে মনে হয় এলিয়েনরা বাস করে। পাশের বিশাল ঝুলন্ত সেতুর রশি কখন যে ছিঁড়ে যাবে, এই ভয়ে অনেক দিন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। সেতু দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় মাঝেমধ্যে একটা ভয় কাজ করে। রাতে ব্রিজটি এত মায়াবী হয়ে ওঠে যে, কেউ সেটা উপভোগ করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাদে থাকতেই পারে।
রাতের এই পায়চারি নিয়ে খুব বেশি ভাবতেন না শাফকাত। শহরে চব্বিশটি ঘণ্টাই মানুষ তিন শিফটে কাজ করে যাচ্ছে। কে কখন কোন সময় রিলাক্স মুডে রয়েছে বোঝা মুশকিল। রাতের একটু-আধটু শব্দকে তাই তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন।
সেদিন সন্ধ্যায় নীলিমা রান্না করছিলেন। হঠাৎ কিচেনের জানালার কাছে ফায়ার এক্সিট দিয়ে সাদা চামড়ার এক যুবককে নিচে নামতে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘হু ইজ দিস?’ চিৎকার শুনে মেয়ে লিভিং রুম থেকে দৌড়ে এল, ‘কী হলো আম্মু?’
পুলিশ এসে বলে গেল উইন্ড বন্ধ রাখতে। এ পর্যন্তই। ট্রেসপাসিং একটা বড় ধরনের অপরাধ। অভিযোগের ভিত্তিতে ধরতে পারলে নিশ্চিত হাজতবাস।
কয়েক দিন পর দু তলায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি। পুলিশ এসে বলে গেল মানসিক ভারসাম্যহীন একটা লোককে এই নেইবারহুডে ট্রেসপাসিংয়ের জন্য গ্রেপ্তার করেছিল কিছুদিন আগে। হয়তো তাঁরই কাজ। কদিন পর শাফকাত নিচতলায় মূল দরজার কাচে সাঁটানো একটা সতর্কীকরণ নোটিশ দেখলেন, ডেলিভারি দেওয়া প্যাকেজ নিচতলায় মেইন ডোর ভেঙে যে লোক নিয়ে গেছে, সেই ছিঁচকে চোরের দুটো ছবি সিকিউরিটি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ। দাঁড়ি আছে। মাত্র দুটো বিল্ডিং পরেই এই প্যাকেজ চুরির কাহিনি। তাদের বিল্ডিংয়ে এমন প্যাকেজ মিসিং হয়েছে মাঝেমধ্যে। কিছুদিন আগে দুতলার অ্যানির অনেকগুলো প্যাকেজ খোয়া গেছে। ল্যান্ড লর্ডকে ক্যামেরা ইনস্টলেশনের কথা বললে লাভ হয়নি। আইনগত বাধা আছে নাকি।
শাফকাতের প্ল্যান, নিজেই আরেকটা ক্যামেরা উইন্ডোতে লাগাবেন। এই যখন অবস্থা ঠিক তখনই নীলিমা আরেকটা ভয়াবহ খবর দিলেন। দু তলার বড় ছেলে বাসার কাছেই গাড়ি পার্ক করার সময় পিস্তল উঁচিয়ে তার কাছ থেকে সব ডলার নিয়ে গেছে। বয়স বাইশ-তেইশ হবে, কালো। সেলফোনটা রাস্তায় ফেলে দিতে বলেছে, যাতে পুলিশ কল করতে না পারে। কালবিলম্ব না করে আদেশ পালন করেছে। মাত্র দু-ব্লক দূরে। পুলিশ এসে নিচতলার ছেলেকে নিয়ে পুরো এলাকা চষে বেড়িয়েছে। কোথাও কালো লোকটির টিকিটিও খুঁজে পায়নি। ওর মা নিষেধ করেছিলেন রাত একটার দিকে বের না হতে। তবুও ব্যাংকে যাবে। কথা শোনেনি। পরদিন সকালে ডলার লাগবে। ভাগ্য ভালো গুলি করেনি। বেঁচে গেছে।
নীলিমা ও শাফকাত দু তলায় গিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন। রাতে প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন বের না হয় সে পরামর্শও দিয়েছেন। এই শহরে রাতদিন বলতে কিছু নেই। অভিবাসী সবাইকে রাতে কাজ থেকে ফিরতে হয়। টিকে থাকার এই অভিযাত্রায় ভয় পেলে কি চলে।
অনেক বছর ধরে শাফকাত রাস্তায় গাড়ি রাখেন না। পার্কিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে। বাড়তি কিছু ডলার গুনতে হয় এই যা। তবুও ভালো রাতে পার্কিংয়ের জন্য ঘোরাঘুরি করতে হয় না। ছেলেটার কথা ভেবে অনেকটা চিন্তিত হয়ে পড়েন। খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। ভীষণ ভয় পেয়েছে।
কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছে ক্রাইম রেট বেড়ে গেছে অথচ সিটির পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে কমেছে। শাফকাত এই শুভংকরের ফাঁকি বুঝতে পারেন না। শহরের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসাধারণ দক্ষতায় সব ধরনের অপরাধের হাত থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। তাই নিশ্চিন্তে তিনি বাসায় ফেরেন এখনো মধ্যে রাতে। গাড়িটা পার্ক করেই পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে ঘরে পৌঁছে যান। কখনো ভয়ের লেশমাত্র মনে উদয় হয়নি।
ইদানীং যেন অনেকটা দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসেছে। একবার কেউ অপরাধে জড়িয়ে গেলে স্বাভাবিক রাস্তা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও চাকরি পাবে না। রেকর্ডে উঠে আসবে তার জীবন বৃত্তান্ত। তখন বিকল্প কিছু থাকে না। হয় ভিক্ষাবৃত্তি নয়তো চুরিচামারি। এদের পরিণতি দেখে শাফকাতের খুব কষ্ট লাগে। অভিভাবকদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য এ রকম হয়। বেশির ভাগ কালো ও স্প্যানিশ ফ্যামিলির মধ্যে এমন হয়। তাদের অভিভাবক হয়তো নেই। আজকাল স্বদেশি ছেলেমেয়েদের মধ্যেও এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
কিছুটা কঠোর হতে হয়। এসব ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইলে ওরা বলবে, ‘বাবা তুমি বর্ণবাদী হয়ে যাচ্ছ।’ শাফকাত দেখেছেন ম্যানহাটনের আপার ইষ্ট সাইডের পরিবারগুলো সন্তান লালন-পালনে‌ কত স্ট্রিক্ট। তারা প্রচুর ডলার ব্যয় করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠায়। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত যা বলবে, তারা তা দেববাক্যের মতো পালনে বাধ্য; টুঁ শব্দটিও করবে না।
নীলিমা ইদানীং প্রয়োজন ছাড়া কিচেনের জানালা খোলেন না। কিছুটা ভয় পেয়ে বসেছে। শাফকাত অভয় দেন। কিচ্ছু হবে না। এত ভয় পেলে কি জীবন চলে।