নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে

বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এখন শিশু নির্যাতনের খবর নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ১ হাজার ২৩টি শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ১৩০টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে নৃশংসতার মাত্রাও বেড়ে গেছে। বড়দের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে শিশুরা খুন, অপহৃত হচ্ছে। এক দোকান ছেড়ে আরেক দোকানে কাজ করতে যাওয়ার মতো কারণে শিশুরা হত্যার শিকার হয়েছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানিও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।

কিছুদিন আগে দুই ভাইবোন যখন বাড়িতে মারা গেল (ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মা তাদের হত্যা করেছেন), তখন গণমাধ্যমের মন্তব্য ছিল, ‘শিশুরা তাদের নিজেদের বাড়িতেও নিরাপদ নয়।’ প্রশ্ন হলো, শিশুরা কি কখনো তাদের বাড়িতে নিরাপদ ছিল? মা-বাবা ও যত্নকারীদের দ্বারা শিশু নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা তো নতুন কিছু নয়, সব সময় ঘটছে। ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক ২০১৫ সালের মার্চে প্রকাশিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১২-১৩ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের ১-১৪ বছর বয়সী ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু জরিপের পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে মানসিক কিংবা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে।

২০১০ সালে এক সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সব ক্ষেত্রে শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তারপরও বিদ্যালয়ে শিশুরা নিয়মিতভাবে শারীরিক ও অবমাননাকর শাস্তির মুখোমুখি হয়। এই যে এত শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে অল্প কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, বিশেষ করে যখন নির্যাতনের ঘটনাগুলো ভয়ংকর ধরনের হয়। আরও লক্ষ করা যায় যে যৌন নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে নির্যাতনকারী শিশুদের পরিচিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।

নির্যাতনের ক্ষেত্রে শিশুদের কোনো কোনো গ্রুপ অন্যদের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। যেমন পাচার হওয়া শিশু, যৌনকর্মীদের সন্তান, প্রতিবন্ধী শিশু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশু, শরণার্থী শিশু, এইডসে আক্রান্ত শিশু এবং দলিত শিশুরা নানান বৈষম্যের শিকার হয়। কর্মজীবী শিশুরা নিয়োগকারীদের সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়।

শিশু নির্যাতন বাড়ার অন্যতম কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। অপরাধীদের শাস্তি হয় না বললেই চলে। এ ছাড়া শিশুদের মানুষের মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের সমাজ এখনো পিছিয়ে আছে। অনেকে এমনটাও ভাবেন যে যেহেতু শিশুরা বড়দের ওপর নির্ভরশীল, অতএব বড়রা শিশুদের নিজস্ব মতামত উপেক্ষা করে তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী শিশুদের চলতে বাধ্য করতে পারেন। বড়রা কখনো কখনো নিজেদের জীবনের জটিলতাগুলো থেকে তৈরি হওয়া হতাশা ও রাগ-ক্ষোভ শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেন। এর ফলে সন্তান হত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে।

প্রশ্ন হলো, শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার সমস্যা মোকাবিলায় কী করা যেতে পারে? কিছুদিন আগে দেখা একটি চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ছে, স্পটলাইট সিনেমায় একজন আইনজীবী থাকেন, যিনি যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আন্তরিকতার সঙ্গে লড়াই করেন। তিনি বোস্টন গ্লোব-এর এক সাংবাদিককে একটি প্রবাদবাক্য স্মরণ করিয়ে দেন, ‘একটি শিশুকে গড়ে তুলতে পুরো একটি গ্রামের সবার দায়িত্ব থাকে’ এবং একটি শিশু যখন নির্যাতিত হয়, তখন তার জন্য পুরো ‘গ্রাম’ই দায়ী। বাংলাদেশ শিশুদের জন্য অনিরাপদ হওয়ার জন্য আমরা সবাই দায়ী। এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। এখন সবাইকে সঠিক কাজটি করতে হবে।

বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এর প্রতিকারে সরকার যা করতে পারে তা হলো, শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া, শিশু নির্যাতন মামলাগুলো দ্রুত বিচারের আওতায় আনা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। শিশু আইন, ২০১৩-এর আলোকে জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য সরকারকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার।

নীতিমালা বাস্তবায়ন ও আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। আমরা যদি শিশু নির্যাতনকে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য করি, তাহলে এর হার কমবে। মনে রাখতে হবে, শিশুরা ছোট বলে তাদের অধিকার কারও চেয়ে কম নয়। মা-বাবার কাছে শিশুরা যদি নির্যাতনের ঘটনা জানায়, তাহলে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। শিশুর করা অভিযোগ খতিয়ে দেখে অপরাধীর (সে যদি পরিবারের সদস্য হয়, তাহলেও) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে শিশুটিকে আশ্বস্ত করতে হবে, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের সবাইকে পরিবারের মধ্যে এবং বাইরে সব সময় শিশুদের সঙ্গে অহিংস আচরণ করতে হবে। শিশু নির্যাতন ঘটতে দেখলেও আমরা নিশ্চুপ থাকি। আমাদের প্রতিবেশীর বাড়িতে নির্যাতনের শিকার শিশু গৃহকর্মীর কান্নার শব্দ শুনে আমরা কি কোনো প্রতিবাদ করতে এগিয়ে যাই? বিষয়টি যে অগ্রহণযোগ্য, তা কি প্রতিবেশীকে বলি, নাকি চুপ করে থাকি? এই নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। আমরা সবাই যখন শিশু নির্যাতন সহ্য না করার সিদ্ধান্ত নেব, তখনই ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে প্রচার হওয়া প্রয়োজন, যাতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, মিডিয়া, সাধারণ নাগরিক—সবাই ভূমিকা রাখবে। গণমাধ্যমে অনেক ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কতগুলো ঘটনা শেষ পর্যন্ত ফলোআপ হচ্ছে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। গণমাধ্যমে শুধু আলোচিত ঘটনা নয়, সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা গণমাধ্যমের দায়িত্ব।

আমরা যদি সত্যিই শিশু নির্যাতন অবসানে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে থাকি, তাহলে আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মা-বাবা, শিক্ষক, নিয়োগদাতা, বিভিন্ন সেবা প্রদানকারীসহ সবাই যদি বয়স অনুযায়ী শিশুর চিন্তা ও অনুভূতি বুঝে তাদের সঙ্গে আচরণ করে, তাদের প্রতি নির্যাতন দেখলে নিজস্ব অবস্থান থেকে রুখে দাঁড়ায়, তাহলেই সমাজটা শিশুবান্ধব হয়ে উঠবে। আসুন, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আমরা প্রত্যেকে রুখে দাঁড়াই।

লায়লা খন্দকার: পরিচালক, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স ও চাইল্ড প্রোটেকশন, সেভ দ্য চিলড্রেন।