আইটি বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো বাংলাদেশি
দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানো অনেকের কাছেই স্বপ্নের। মানুষ ভাগ্য গড়তে নিজের দেশ ছেড়ে ভিন দেশে যায়। তাদের কেউ কেউ মেধা, চেষ্টা আর পরিশ্রমে এক সময় হয়ে ওঠেন দেশেরই প্রতিনিধি, যাদের হাত ধরে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের সম্মান বাড়ে। দেশের অনেক মেধাবী মানুষই এখন বিদেশে সম্মানজনক স্থান করে নিয়েছেন এবং উঁচুতে তুলে ধরেছেন দেশের পরিচিতি। তেমনই একজন আজিজ আহমেদ, একজন বাংলাদেশি আমেরিকান; যিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা জগতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একজন। কোডার্সট্রাস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা, যিনি স্বপ্ন দেখেন দেশের তরুণদের আইটি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পেশাদার বিকাশ, ডিজাইনার, ডিজিটাল বিপণনকারী সৃষ্টির।
আজিজ আহমেদ একাধারে একজন সফল ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, গবেষক এবং শিক্ষক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাঁর বসবাস। ব্যবসায়িক প্রধান কার্যালয় নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে হলেও তার ব্যবসার ব্যাপ্তি এখন বিশ্বজুড়ে। আধুনিক সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কম্পিউটারভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরি ও সেবাই তাঁর প্রধানতম ব্যবসা, যার বাজার আমেরিকা, ইউরোপ হয়ে এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রে এখন তিনি ন্যাশনাল বিজনেস ইনক্লুশন কনসোর্টিয়াম অন্যতম সদস্য।
তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে পদ্ধতি সমন্বয় ও পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান ইউটিসি অ্যাসোসিয়েটস-এর প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী আজিজ আহমেদ। আড়াই দশক ধরে টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি জগতে সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছে ইউটিসি অ্যাসোসিয়েটস। নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটের প্রথমসারির প্রযুক্তি পরামর্শক ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এটি। যুক্তরাষ্ট্রে এশিয়ান-আমেরিকানদের এবং ব্যবসা, বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, শিক্ষা ও জনসেবামূলক সব খাতে এশিয়ান আমেরিকানদের প্রতিনিধিত্বকারী সব পক্ষের প্রতিষ্ঠান ইউএস প্যান-এশিয়ান আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স (ইউএসপিএএসসিসি) অন্যতম নেতা তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান এটিঅ্যান্ডটি-এর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি নেটওয়ার্কের প্রধান স্থপতি ছিলেন বাংলাদেশি এই প্রকৌশলী। এটিঅ্যান্ডটি -এর হয়ে সেই নব্বইয়ের দশকে নেক্সট জেনারেশন ইন্টারনেট (এনজিআই) টিম পরিচালনা করেন। এই দলের গবেষণার ফসল হিসেবেই পরবর্তী সময়ে বিশ্বে ব্রডব্যান্ড, মাল্টিওয়েভলেন্থ অপটিক্যাল টেকনোলজি জনপ্রিয় হয়।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার রাজনীতিতেও রয়েছে তার শক্ত অবস্থান। নিউইয়র্ক-নিউজার্সিতে ডেমোক্র্যাট দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন এই বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তাঁর হাতেই গঠিত হয়েছে ইউএস বাংলাদেশ গ্লোবাল চেম্বার অব কমার্স নামের শক্তিশালী ব্যবসায়ী ফোরাম। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সারির মাল্টিমিডিয়াভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভোনেয়ার ইনকর্পোরেটেড।
সম্প্রতি বিশ্ব নাগরিকদের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে ভ্যাটিকান সিটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বৈশ্বিক প্রযুক্তি সম্মেলন। বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তিবিদেরা এই সম্মেলনে অংশ নেন। পোপ ফ্রান্সিসের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘দ্য কমন গুড ইন দ্য ডিজিটাল এজ’ শীর্ষক এক আয়োজনে বক্তা হিসেবে অংশ নেন ইউটিসি অ্যাসোসিয়েটসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও কোডারসট্রাস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা আজিজ আহমদ।
ভ্যাটিকান সিটিতে ২৬ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া তিন দিনের সম্মেলনে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাম্প্রতিক উন্নয়ন, বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক সংলাপ ছিল। এই আয়োজনে ডিজিটাল যুগের অভিন্ন ইতিবাচকতা নিয়ে কথা বলেছেন আজিজ আহমদ। তাঁর ভাষ্য, ‘সম্মানজনক এ আয়োজনে ব্যবসায়ী নেতারা বিভিন্ন সমস্যার কথা বলেছেন। আমরা এসব সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করার কথা বলেছি। যা বিশ্ব নাগরিকদের কল্যাণে ভূমিকা রাখবে।’
ভবিষ্যতে কাজের ধরন কেমন হবে, সে বিষয়ে ভ্যাটিকান প্রযুক্তি সম্মেলনে আজিজ আহমেদ একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া ইউরোপের সেবাকর্মীদের ইউনিয়ন ইউনি-ইউরোপার অলিভার রোথিগ ও হংকং-ভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিজিনেক্সের ম্যালকম রাইটের সঙ্গে একটি প্যানেল আলোচনায়ও অংশ নেন তিনি। আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম কার্যালয়ের প্রতিনিধি আন্না বিওন্ডি।
আজিজ আহমদ নিউজার্সি টেকনোলোজি কাউন্সিল-এর হয়েও কাজ করেন। নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম এশিয়ান–আমেরিকান হিসেবে সম্মানসূচক অ্যালামনাই অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। স্মল বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এসবিএ) তাঁকে এসবিএ ইঞ্জিনিয়ারিং লিডার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে।
নাসডাক ও নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের বছর শেষের ঐতিহ্যবাহী ‘রিংগিং দ্য ক্লোজিং বেল’ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ডাক পড়ে এই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর। দিনে ৫০ বিলিয়ন ডলার লেনদেনের এই শেয়ার মার্কেটের এটিই সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ যেসব ব্যক্তি দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয় নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের এই আয়োজনে। বৃহৎ অর্থনীতির শিল্প ও প্রতিষ্ঠানের এই কর্তাব্যক্তিরা শেয়ারবাজারে বছরে আট ট্রিলিয়ন ডলারের ভোক্তা ব্যয়ের ক্ষমতা রাখেন। ব্যবসায়িক সাফল্য ও নানা ধরনের জনসেবামূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আজিজ আহমদও স্থান পান এই বিরল সম্মানের আয়োজনে।
নিউইয়র্ক সিটি কলেজ থেকে তড়িৎ প্রকৌশল (ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিষয়ে ব্যাচেলর অব ইঞ্জিনিয়ারিং (বিই) এবং মাস্টার্স অব ইঞ্জিনিয়ারিং (এমই) ডিগ্রি নেওয়ার পর পুরোদস্তুর ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন এই বাংলাদেশি আমেরিকান। পরে ডার্টমাউথ কলেজের টাক স্কুল অব বিজনেস থেকে সম্পন্ন করেছেন এক্সিকিউটিভ ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম। বছর কয়েক ধরে সিটি টেকনিক্যাল কলেজ এবং পেস ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনাও করছেন তিনি।
সমাজের উন্নয়ন ও উৎকর্ষে এই বাংলাদেশির অবদান অনস্বীকার্য। বিভিন্ন শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রয়েছে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা। নিউইয়র্ক সিটির হাইস্কুল ফর এন্টারপ্রাইজ, বিজনেস, অ্যান্ড টেকনোলজি, নিউইয়র্ক সিটি কলেজের অধীনে গ্রোভ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং লিডারশিপ কাউন্সিলে কাজ করেন। নিউজার্সির মালবোরোর মেয়র কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে অবদান রেখেছেন নগরীর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কমিটিতে।
একপর্যায়ে দেশের মাটি ও মানুষকে জাগ্রত করতে, সামনে এগিয়ে নিতে তথা ডিজিটাল বাংলাদেশের উত্তরণে অবদান রাখতে ডেনমার্কভিত্তিক বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান কোডার্সট্রাস্টকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশ। আইসিটি বিভাগে বিশেষ মনোনিবেশপূর্বক ২০১৫ সালের মধ্যে ৯৯ শতাংশ শিক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন এবং মর্টেন লুন্ডের উপস্থিতিতে আজিজ আহমেদ এবং ডেনিশ সামরিক অধিনায়ক ফার্দিনান্দ কেয়ারওল্ফ ২০১৪ সালের এপ্রিলে কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোডার্সট্রাস্ট একটি আন্তর্জাতিক দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে বছরে শত শত বাংলাদেশি আজ আইটি খাতে দক্ষতা অর্জন করে সামনে এগিয়ে চলেছে। স্থানীয়ভাবে কাজ করে এই কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েটরা এখন বিশ্ব বাজারে স্থান দখল করে নিচ্ছে।
আজিজ আহমদ বলেন, কোডার্সট্রাস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমরা চাই তরুণদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং দিক নির্দেশনা নিশ্চিত করতে, যাতে তারা পেশাদার ডেভেলপার, ডিজাইনার, ডিজিটাল মার্কেটার ইত্যাদি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং নিজেদের জীবনযাত্রার মানে ও ক্যারিয়ারে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। কোডার্সট্রাস্টে, আমরা প্রযুক্তিগত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুবসমাজকে নিজেদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনার একটি যুগান্তকারী সুযোগ করে দিতে চাই। ডিজিটাল রিসোর্স এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা নারী–পুরুষ উভয়ের জন্য একটি পদ্ধতি ও চিন্তাভাবনা প্রবর্তনের ওপর মনোনিবেশ করি; এর সুবিধাগুলো শিক্ষার্থীদের জীবনে একটি বিশাল প্রভাব ফেলে থাকে।
অন্যদিকে, অনেক সাফল্যের গল্প থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে বেশ কয়েকটি বাধা রয়ে গেছে। এ জন্য কোডার্সট্রাস্টে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্যোক্তামূলক চিন্তাধারা জাগ্রত করার চেষ্টা করি। কারণ, এই আগ্রহী উদ্যোক্তারা অর্থায়নে অপর্যাপ্ত অ্যাকসেস এবং কঠোর প্রতিযোগিতার মতো চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করবেন।
আজিজ আহমেদ আরও বলেন, বাংলাদেশের এখন নিজেকে বড় করে ভাবার সময় এসেছে। অনেক সাফল্য অর্জন হয়েছে এবং হচ্ছে। আর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে আরও সাফল্য অর্জনের। তাই আমি মনে করি, আমাদের আর বসে থাকার সময় নেই। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সম্মিলিতভাবে চিন্তা করতে না পারলে একটি সম্মিলিত লক্ষ্য অর্জনও সম্ভব হয় না। ‘আমি, ‘তুমি’ বা ‘সে’ হয়ে কেউ থাকবে না, সবাই যখন ‘আমরা’ হিসেবে বিবেচিত হব, সেখানেই অর্জন সম্ভব। আর যা কিছু অর্জন তা হবে সবার। ব্যর্থতার ভাগীদারও হবে সবাই।
তরুণদের উদ্দেশ্য এই উদ্যোক্তা বলেন, আজকের তরুণদের মধ্যে তিনটি প্রধান বিষয় জাগ্রত করতে হবে—জবাবদিহি, দায়িত্বশীলতা ও মালিকানাবোধ। ‘নেতৃত্ব দেওয়া নয়, কর্মীদের সঠিক দীক্ষা দিয়ে কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং যেকোনো লক্ষ্য অর্জনে প্রত্যয়ী করে তোলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগের উৎকর্ষের যুগে পৃথিবীর অপর পৃষ্ঠে অবস্থান করেও সারাক্ষণই বাংলাদেশের জন্য কিছু না কিছু করা সম্ভব’, এমনটাই বিশ্বাস আজিজ আহমদের। তার মতে, বাংলাদেশ এখন ভবিষ্যৎ বিশ্বের কাছে একটি প্রত্যাশার নাম।