কবি দিলওয়ার নিজ ভঙ্গিমায় করেছেন মানুষের জয়গান
কবি দিলওয়ার বাংলাদেশের কাব্যধারার এক উজ্জ্বল পুরুষ। আজীবন সাহিত্যসাধনা করে গেছেন। কবিতায় আলাদা কণ্ঠ হিসেবে তাঁকে মান্য না করে উপায় নেই। আপন কাব্য খ্যাতি কিংবা কাব্য স্বীকৃতি নিয়ে তাঁকে কখনো বিচলিত হতে দেখা যায়নি। নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে অতীতে অনেকে তাঁকে মফস্বলের কবি হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু কাব্য বিষয় আহরণে দিলওয়ার বিশ্বের নানা দিকে হাত বাড়িয়েছেন। আজীবন এটাই ছিল তাঁর ব্রত। মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাঙালির অগ্রযাত্রার প্রতিটি সংগ্রামে কবি দিলওয়ার গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য–সংস্কৃতির মূল প্রবাহের অন্যতম প্রাণপুরুষের কর্মের চর্চাকে তুলে ধরা আজকের বাস্তবতায় আরও বেশি জরুরি।
কবি দিলওয়ারের ষষ্ঠ প্রয়াণদিবস উপলক্ষে নিউইয়র্কে আয়োজিত স্মরণসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজা মিলনায়তনে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা আয়োজিত এই নাগরিক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী, কবি–গীতিকার ইশতিয়াক রূপু, সাংবাদিক রহমান মাহবুব ও হেলিম আহমেদের যৌথ পরিচালনায় আলাপ–সংলাপ–কবিতায় স্মরণ করা হয় কবিকে। অনুষ্ঠানের শুরুতে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে স্মরণ ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয় এক মিনিটের নীরবতার মধ্য দিয়ে।
প্রবীণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে এই স্মরণসভায় বিপুলসংখ্যক সংস্কৃতিসেবী ও দিলওয়ার অনুরাগীদের সমাগম ঘটে। আলোচনায় তাঁরা দিলওয়ারকে একজন বড় কবি ছাড়াও মানবিক উচ্চারণের এক সাহসী প্রতিভা বলে চিহ্নিত করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সাংবাদিক মনিজা রহমান কবি দিলওয়ারের জীবনী থেকে পাঠ করেন।
মাহবুবুর রহমান তাঁর আলোচনায় বলেন, কবি দিলওয়ার নানাভাবে তাঁর পরিবেশ–প্রতিবেশকে আন্দোলিত করে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস বলেন, কবি দিলওয়ার আন্তর্জাতিকতার কথা বলে গেছেন তাঁর কাব্যে, গানে। শোষিত–বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কথাই তিনি উচ্চারণ করে গেছেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বেলাল বেগ তাঁর আলোচনায় কবিকে নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা উল্লেখ করেন। কবি দিলওয়ারের সঙ্গে শিল্পী সুলতানের জীবনধারার মিল দেখেছেন উল্লেখ করে বেলাল বেগ বলেন, চণ্ডীদাস মানুষের জয়গান করে গেছেন, কবি দিলওয়ারও নিজের উচ্চারণে করে গেছেন মানুষের জয়গান। তাঁর কর্ম নিয়ে একটি মিউজিয়াম করার জন্য কবি অনুরাগীদের প্রতি আহ্বান জানান বেলাল বেগ।
কবি ফকির ইলিয়াস তাঁর বক্তব্যে নিজের কাব্যকর্মে কবি দিলওয়ারের প্রেরণার কথা তুলে ধরেন। সাংবাদিক সামসাদ হুসাম চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে কবি দিলওয়ারের নানা ঐতিহাসিক কর্মের কথা জানালেন উপস্থিত সুধীজনকে। লেখক সোনিয়া কাদের কবিকে নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতিগাথা তুলে ধরেন।
আইনজীবী শেখ আখতারুল ইসলাম বলেন, কবিদের কোনো দেশ নেই, স্থান নেই। তাঁরা নিজেদের উচ্চারণের মধ্য দিয়েই আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠেন। কবি দিলওয়ারও একইভাবে ধরা দেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। কবি ও সংগঠক সালেম সুলেরী স্বাধীনতা–পরবর্তী কাব্য ধারায় কবি দিলওয়ারকে নিয়ে আলোচনা করেন।
কবিপুত্র শাহীন দিলওয়ার তাঁর বাবাকে নিয়ে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার এমন আয়োজনের জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। কবিকন্যা সাজিয়া রহমান তাঁর বাবা কোনো খ্যাতির পেছনে কখনো ছুটে যাননি উল্লেখ করে বাবার কবিতা পাঠ করে শোনান। কবি দিলওয়ারের নাতি আদি রহমান তাঁর নানার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করেন।
কবি দিলওয়ার ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমায় জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর পেশাজীবন শুরু হয়। পরে রাজধানীতে এসে সাংবাদিকতা শুরু করেন কবি। ১৯৬৭ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ–এ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ–এ সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। উদীচী ও খেলাঘর আসরের সিলেটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন।
কবি দিলওয়ার ১৯৮০ সালে কাব্যচর্চায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৮ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর সিলেটে নিজ বাড়িতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অনুষ্ঠানে কবির কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী গোপন সাহা ও শামীম আল আমীন।
সভায় আলোচনা, কবিতা পাঠ ও আবৃত্তিতে অংশ নেন জান্নাতুল আরা, ফরিদা ইয়াসমীন, রওশন হক, রোকেয়া দীপা, জেবুন্নেছা জ্যোৎস্না, শাহীন দিলওয়ার, ইমাম কাজী কাইয়ুম, শেলী জামান খান, জাহেদ আহমেদ, আবদুস শহীদ, স্বপ্ন কুমার, ভায়লা সালিনা, আবু তাহের, ইলিয়াস খসরু, এ এফ এম জামান, সাজিয়া রহমান, আদি রহমান, ফকির ইলিয়াস, ফারহানা ইলিয়াস, শেখ আখতারুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান, সুব্রত বিশ্বাস, আলেয়া চৌধুরী, মইনুল হক চৌধুরী, ইশতিয়াক রূপু, জাহেদ আহমদ, সামসাদ হুসাম চৌধুরী, মনিজা রহমান, ফরিদা ইয়াসমীন, জান্নাতুল ফেরদৌস আরা, সুলতানা পারভীন, দিলারা খান, রহমান মাহবুব, মো. আবদুল মালেক, মিনহাজ আহমদ, আরিফ মাহমুদ, সাজিয়া রহমান, অধ্যাপক আবদুল কাইয়ুম, সুলতানা শাহীন, শাহীন ইবনে দিলওয়ার, সৈয়দ মামুনুর রশীদ, সৈয়দ মুজিবর রহমান, আবুল খায়ের চৌধুরী, মাহমুদুল হক চৌধুরী, সরওয়ার সালাউদ্দীন, শেখ মোফাখখার উল ইসলাম, হেলিম আহমেদ, মাসুম আহমেদ, রওশন হাসান, আহমাদ মাযহার, তোফাজ্জল লিটন, ড. বিলকিস রহমান , ফুকু চৌধুরী, শামস আল মমীন, এম এ আহাদ, সুয়েব সাজ্জাদ, আকবর হায়দার কিরণ, এমাদউদ্দীনসহ কবি, লেখক, সাংবাদিক, কবির ভক্ত জনগণ।