ওসমানি সুলতানদের প্রাসাদ

চতুর্থ চত্বরের উত্তর দিকের ছোট সাধারণ গেট। এই গেট দিয়ে একমাত্র সুলতান ছাড়া আর কারও প্রবেশ বা বের হওয়ার অনুমতি ছিল না। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় সুলতান ছদ্মবেশে এই দরজা দিয়ে ইস্তানবুলের সাধারণ মানুষের জনজীবন দেখতে বেরুতেন।
চতুর্থ চত্বরের উত্তর দিকের ছোট সাধারণ গেট। এই গেট দিয়ে একমাত্র সুলতান ছাড়া আর কারও প্রবেশ বা বের হওয়ার অনুমতি ছিল না। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় সুলতান ছদ্মবেশে এই দরজা দিয়ে ইস্তানবুলের সাধারণ মানুষের জনজীবন দেখতে বেরুতেন।

তোপকাপি প্রাসাদ: তুর্কির অটোমান (ওসমানি) সুলতানেরা এই প্রাসাদ থেকে একসময় মক্কা, মদিনা, বাগদাদ ও জেরুজালেমসহ দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, উত্তরপূর্ব আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এক সাম্রাজ্য শাসন করতেন। প্রাসাদটি তুরস্কের ইস্তানবুলে মর্মর সাগর, বসফরাস প্রণালী ও গোল্ডেন হর্ন খাঁড়ি ঘেরা একটি নয়নাভিরাম ছোট উপদ্বীপে পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত। বর্তমান ইস্তানবুল শহরের এই উপদ্বীপটি ১৪৫৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত কনস্টান্টিনোপল নামের এক খ্রিষ্টানপ্রধান শহর ছিল। তোপকাপি আজ অবধি টিকে থাকা বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম প্রাসাদ। তোপ শব্দের অর্থ কামান আর কাপি অর্থ গেট। তোপকাপি নামে একসময় প্রাসাদের একটি বড় গেট ছিল, যার নামে প্রাসাদের এই নাম। তুর্কি ভাষায় এই প্রাসাদ ‘টপকাপু সারাই’ বা ‘সার্গলিও’ নামেও পরিচিত।

বাবা-উস-সালাম। এই গেট দিয়ে শুধু সুলতান ঘোরায় চড়ে যেতে পারতেন। বাকি সবার পায়ে হেঁটে যেতে হতো
বাবা-উস-সালাম। এই গেট দিয়ে শুধু সুলতান ঘোরায় চড়ে যেতে পারতেন। বাকি সবার পায়ে হেঁটে যেতে হতো

পেছনের কথা: মোঘলদের পূর্বসূরি, অর্ধ-পৃথিবী শাসন করা সেলযুক সাম্রাজ্য ভেঙ্গে ওসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আনুমানিক ১২৯৯ সালে। তাদের শাসনকাল ছিল প্রায় ৬২৫ বছর। ১৪৫৩ সালে ওসমানি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ সুরক্ষিত খ্রিষ্টান শহর কনস্টান্টিনোপল বিজয় করে এর পূর্ব পাশে প্রাচীন বাইজেন্টাইনের ধ্বংসাবশেষের ওপরে টপকাপি প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। পরে প্রায় সব সুলতানই এর সৌন্দর্য ও পরিধি বাড়ান। ১৮৫৩ সালে সুলতান আবদুলমেচিদ তাঁর ইউরোপীয় ধাঁচে বানানো নতুন দোলমাবাচে (Dolmabahçe) প্রাসাদে বসবাস করতে শুরু করার পর থেকে তোপকাপি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানি রাজ বংশের বিলুপ্তি হলে ১৯২৪ সালে আধুনিক তুরস্কের স্থপতি ও প্রথম রাষ্ট্রপতি মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন এবং প্রথমবারের মতো সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেন।

ইসলামের পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন: ১৫১৭ সালে আব্বাসীয় খলিফাদের কাছ থেকে মিসর ও আরবের ক্ষমতা সুলতান সেলিমের হাতে চলে গেলে পর্যায়ক্রমে ইসলামের অনেক পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন ওসমানি সুলতানরা প্রাসাদে নিয়ে যান। এর মধ্যে হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র দাড়ি, জুব্বা, পাগড়ি, সেন্ডেল, পানি পানের বাটি, তরবারি, ধনুক, পতাকা, চিঠি, পায়ের ছাপসহ তাঁর পরিবার ও সাহাবীদের ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র প্রাসাধের ভেতর একটি জাদুঘরে প্রদর্শিত আছে। এ ছাড়া এই জাদুঘরে ইব্রাহিম (আ.)-এর ব্যবহৃত পাত্র, ইউসুফ (আ.)-এর পাগড়ি, মূসা (আ.)-এর লাঠি, দাউদ (আ.)-এর তরবারি ও ইয়াহিয়া (আ.)-এর পুঁথি রক্ষিত আছে।

সুলতান তৃতীয়-এর গ্রন্থাগার। দর্শনার্থী কক্ষের ঠিক পেছনে, তৃতীয় চত্বরের মাঝখানে সুন্দর এই নিও-ক্লাসিকাল ভবনটি। এটি নির্মাণ হয়েছিল ১৭১৯ সালে। এখানে হজরত ওসমান (রা.)-এর সময়ের পবিত্র কোরআনসহ প্রায় ৩ হাজার ৫০০ ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে।
সুলতান তৃতীয়-এর গ্রন্থাগার। দর্শনার্থী কক্ষের ঠিক পেছনে, তৃতীয় চত্বরের মাঝখানে সুন্দর এই নিও-ক্লাসিকাল ভবনটি। এটি নির্মাণ হয়েছিল ১৭১৯ সালে। এখানে হজরত ওসমান (রা.)-এর সময়ের পবিত্র কোরআনসহ প্রায় ৩ হাজার ৫০০ ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে।

সুলতানদের জীবনধারা: প্রাসাদের উত্তর পাশে সুরক্ষিত ও বিলাসবহুল হারেমে সুলতানের মা (রাজ মাতা), স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং প্রায় ৩০০ জনের মতো উপপত্নী ও দাসী থাকতেন। সুলতানের উপপত্নী ও দাসীরা সাধারণত ককেশীয়, জর্জিও ও আবখাসিও ছিলেন। এদের কমবয়সে পরিবার বা বাজার থেকে দাসী হিসেবে কিনে এনে হারেমে লালন-পালন করা হতো। আরবী ‘হারেম’ বা ‘হারাম’ শব্দের অর্থ ‘নিষিদ্ধ’। সুলতানের হারেমে সুলতান ও তার পরিবারের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছাড়া সবার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। হারেমের পাহারাসহ অন্যান্য দায়িত্বে থাকতেন প্রায় দুই শ তুর্কি ও নিগ্রো খোজা-প্রহরী।

প্রাসাদের নকশা: পুরো প্রাসাদ প্রাঙ্গণ মোটামুটি একটি আয়তক্ষেত্রের মত এবং চারটি প্রধান চত্বর ও হারেমে বিভক্ত। চত্বরগুলো চারদিক থেকে বিভিন্ন ছোট থেকে মাঝারি আকারের ভবন ও উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। চত্বরগুলো দক্ষিণ থেকে উত্তরে দিকে পর্যায়ক্রমে কম থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাসাদের সীমানা বাইজেন্টাইন আমলের দেড় হাজার বছরের পুরোনো বেসিলিকা হাজিয়া সোফিয়ার ঠিক পেছন থেকে শুরু। বহির্মুখী প্রথম চত্বরটি একেবারে দক্ষিণে, যেখানে প্রবেশাধিকার সবচেয়ে বেশি শিথিল ছিল। হাজিয়া সোফিয়ার উত্তর পূর্ব কোণে বাব-ই-হুমায়ুন (Imperial Gate) নামে গেট দিয়ে প্রথম চত্বরে ঢুকতে হয়। টিকিট ছাড়াই এই চত্বরে ঢোকা যায়। এই চত্বরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো হাজিয়া ইরিন গির্জা। প্রথম চত্বর থেকে দ্বিতীয় চত্বর উঁচু দেয়াল আর বাবা-উস-সালাম (Gate of Salutation) দিয়ে আলাদা করা। এই গেট দিয়ে একমাত্র সুলতান ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারতেন। বাকি সবার পায়ে হেঁটে যেতে হতো।

বাগদাদ কুসকু। এটি ১৬৩৮ সালে সুলতানের বাগদাদ বিজয়ের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল
বাগদাদ কুসকু। এটি ১৬৩৮ সালে সুলতানের বাগদাদ বিজয়ের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল

দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় চত্বরে ঢোকার গেটের নাম বাব-উস-সাদী (Gate of Felicity) এই গেটের সামনে ধর্মীয় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিনে হজরত মুহাম্মদ (স.) পবিত্র পতাকা টাঙানো হতো। এই গেটের ঠিক পেছনে সুলতানের দর্শনার্থী কক্ষ। সুলতানের অনুমতি ছাড়া বাব-উস-সাদী দিয়ে দর্শনার্থী কক্ষে বা তৃতীয় চত্বরে কারওরই প্রবেশাধিকার ছিল না। এমনকি প্রধান উজিরের ও সুলতানের অনুমতি নিতে হতো। সবচেয়ে উত্তরের চতুর্থ চত্বর ও হারেম ছিল সবচেয়ে দুর্গম, সুরক্ষিত ও সুলতানের একান্ত ব্যক্তিগত। এই চত্বরের উত্তর দিকে ছোট একটি সাধারণ দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে একমাত্র সুলতান ছাড়া আর কারও প্রবেশ বা বের হওয়ার অনুমতি ছিল না। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় সুলতান ছদ্মবেশে এই দরজা দিয়ে ইস্তানবুলের সাধারণ মানুষের জনজীবন দেখতে বেরোতেন। প্রাসাদে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার কর্মী বসবাস ও কাজ করতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কাজে প্রাসাদে প্রতিদিনই অনেক মানুষ আসতেন। প্রাসাদের পূর্ব পাশে আছে বিশাল রন্ধনশালা, যেখানে একসময় আট শ থেকে এক হাজার বাবুর্চি আর সহযোগীরা পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষের খাবার তৈরি করতেন।

দর্শনার্থীদের জন্য কিছু পরামর্শ: যারা এই প্রাসাদ দেখতে যাবেন, তারা পুরো দিন সময় নিয়ে গেলে ভালো। টিকিট প্রথম চত্বরের টিকেট বুথ থেকে বা অগ্রিম অনলাইনে কিনতে পারবেন। গেটে টিকিট কাটার জন্যে সাধারণত লম্বা লাইন দিতে হয় না। ভেতরে ঢোকার আগে একজন গাইড নিয়ে নিলে ভালো। গাইডরা দর্শনার্থীদের একটি গ্রুপ নিয়ে ভেতরে ঢুকে এক থেকে দেড় ঘন্টা চারটি চত্বর ও কিছু ভবন ঘুরে দেখাবে। এরপর আপনি নিজে জাদুঘর, হারেম ও অন্যান্য ভবন ঘুরে দেখতে পারেন। গাইড ঠিক করার আগে দাম-দর করে নেবেন। টিকিট আবার তিন ধরণের—

১. প্রাসাদে ঢোকার টিকেট (Topkapı Palace Museum Ticket) যেটি আপনাকে কিনতেই হবে ২. হারেমের টিকেট-ঐচ্ছিক ((Topkapi Palace Museum Harem Apartments Ticket) এবং ৩. হাজিয়া ইরিন গির্জার টিকিট—ঐচ্ছিক (Hagia Irene Monument Museum Ticket)। সব টিকিট একসঙ্গে কিনতে পারেন অথবা ২ ও ৩ নম্বর টিকিট ভেতরে ঢোকার পর আপনার হাতে সময় ও আগ্রহ থাকলে পরেও কিনতে পারবেন। প্রাসাদের ভেতরে কয়েকটি রেস্তোরাঁ আছে, তবে দাম একটু বেশি। ভেতরে ঢোকার সময় সঙ্গে হালকা খাবার ও পানীয় নিতে পারেন। ইস্তানবুলে ট্যাক্সি ভাড়া বেশি না। চাইলে উবারও ব্যবহার করতে পারেন। চালককে Topkapi palace বা ‘টপকাপু সারাই’ যেতে চান বললেই হবে।