মুক্তিযোদ্ধার আত্মবিলাপ

প্রায় বছর দশেক আগে আমার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাই। এক বিকেলে ওদের গ্রাম্য বাজারের টং দোকানে বসে আমার বন্ধুর সঙ্গে চা খাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব অর্ধনগ্ন পঙ্গু লোক পাগলের মতো জোরে জোরে বলছে, ‘তোরা আমার সখিনারে ফিরাইয়া দে, আমার সখিনারে মারিছ না, তোদের আল্লার দোহাই, সখিনার ইজ্জত নষ্ট করিছ না।’
আমার জানতে ভীষণ আগ্রহ জাগল, এই লোকটি কে, আর কে সেই সখিনা, কারা তার ইজ্জত নষ্ট করবে? আমার বন্ধুর কাছে জানতে পারি, তিনি ওদের গ্রামের একজন সনদবিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলাম, তারপর সেই মুক্তিযোদ্ধাকে আমার পাশে এনে বসালাম। তিনি আমার সঙ্গে তখন খুব স্বাভাবিক আচরণ করলেন। উনাকে চা-বিস্কুট খেতে দিয়ে কিছু সময় গল্প করলাম। তারপর উনাকে তার জীবনের গল্প বলতে বললাম।
তিনি তাঁর গল্প বলা শুরু করলেন এভাবেই—
আমার নাম তোরাব আলী। আমার জন্মের কয়েক মাস পরে বাপ মইরা যায়। মায়ে আর বিয়া বয় নাই। আমার দাদা–দাদি, আমি আর আমার মায়েরে লইয়া আমাগো গৃহস্থ পরিবার। দাদাজানের জমিজমা আছিল বিস্তর। কোনো অভাব আছিল না। আমি সারা দিন দোস্তগো লগে ঘুরাইতাম। মায়ে কতো বকাঝকা করত, দাদাজানের জমিজমা দেখশন করতে কইতো। দাদাজান মায়েরে উল্টা কইতো, তুই ওরে বকিস না বেটি, আমি এখনো বাইচ্ছা আছি। তোরাব আমার পুলার শেষ নিশানা, আমার কলিজা, আদরের নাতি, থাকুক হের মন মতন। আসলে আমার মনডা পইড়া থাকত অন্য জায়গায়। হা...হা...হা... কী কমু শরমের কথা, সারা দিন পইড়া থাকতাম মোল্লা বাড়ির সামনের পুকুরের বাঁশঝাড়ের চিপায়। সখিনা ঘাটে আইলে আমি হাবলার মতো তাকাইয়া থাকতাম। সখিনাও কাজল টানা চোখ তুইল্যা দুই এক নজর আমারে দেখত আর আঁচল দিয়া মুখ লুকাইয়া মিটমিটাইয়া হাসত। আহারে, কী যে সুখ পাইতাম! মনের সুখে গান ধরতাম, আরও কতো যে পাগলামি করতাম। আসল কথা অইলো, সখিনারে আমি বহুত মহব্বত করতাম।
সখিনা দেখতে আছিল আসমানের পরীর লাহান। টানা টানা চোখ, দুধে আলতা চেহারা, মাথার চুল আছিল মাশাল্লাহ। একদিন সখিনারে পথে একলা পাইয়া, পথ আটকাইয়া দাঁড়াইলাম। সখিনা আমারে সালাম দিয়া কইলো, তোরাব ভাই পথ ছাড়েন। আমি তারে কইলাম, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। সে জবাব দিল, আমি মোল্লা বাড়ির মাইয়া, পথে ঘাটে কারও লগে কথা কই না, আফনে পথ ছাড়েন। আমি লগে লগে পথ ছাইড়া দিলাম আর সখিনা হনহনাইয়া হাইট্যা যাইতাছিল। আমি সাহস নিয়া পিছন থাইক্যা জোরে কইয়া উঠলাম, সখিনা আমি তোমারে অনেক মহব্বত করি। আমার কথা শুইন্না, সখিনা আঁচলে মুখ ঢাইকা একটা মুচকি হাসি দিয়া একবার পিছন ফিরা কইলো, ‘আফনে একটা বেশরম মানুষ, লজ্জা শরমের মাথা খাইছেন। আমার বুঝি শরম নাই, এইসব কথা কেউ এমনে কয়।’
কথাডা শেষ কইয়াই হের বাড়ির দিকে জোরে দৌড় দিছিল। তহনই পুরাপুরি বুঝতে পারছি, সখিনাও আমারে মহব্বত করে। হেই দিন এই দুনিয়ায় আমার মতো সুখী মানুষ আর কেউ আছিল না। হেই খুশিতে আমার হগল দোস্তদের ছাগল জব দিয়া খাওয়াইছি।
হঠাৎই একদিন মাইনসের মুখে শুনি, দেশে কি জানি ঝামেলা চলতাছে। আমি মাথা ঘামাইনাই, এই গুলা অইলো রাজাগো ব্যাপার। কিন্তু না, ঘটনা তো অইন্য রকম। শেখ সাবে নাকি কইছে, যার কাছে যা কিছু আছে, তাই লইয়া পাক সেনার ওপর ঝাঁপাইয়া পর, দেশ পাক সেনার হাত থাইক্যা মুক্ত কর। তহন আমার টনক নড়ল। শাব্বাস শেখের ব্যাটা, জব্বর একখান কথা কইছে। কি করমু, কি করমু ভাবতাছি। এমুন সময় আবারও হঠাৎ একদিন শুনি, গভীর রাইতে পাক সেনারা নাকি ঢাকাতে হামলা করছে। গুলি কইরা পাখির মতো হাজার হাজার বাঙালি মারছে। তহনই দেশ স্বাধীনের ঘোষণা আইছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু অইয়া গেছে, প্রত্যেক দিন হাজারে হাজারে বাঙালি মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতাছে। আর চুপ কইরা থাকতে পারলাম না। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম, মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিমু, দেশ পাক সেনা মুক্ত করমু। দোস্তগো লগে যুক্তি করলাম, সবাই রাজি অইয়া গেল যুদ্ধে যাইতে। শরীলডাতে তহন আগুন জ্বলতাছে, আর তর সইতাছেনা। তারপর যে যার মতো বাড়িত গেলাম।
রাইতে খাইতে পারি নাই, ঘুম আহে নাই। চিন্তায় পইড়া গেছি, দাদাজান আর মায়েরে কেমনে কথাডা কই। চিন্তা করতে করতে এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়ছি আর খোয়াবে দেখলাম, আমি যুদ্ধের ময়দানে গুলি কইরা পাক সেনা মারতাছি। এমুন সময় একটা পাক সেনা পিছন থাইক্যা আইয়া আমার ঘাড়ে স্টেনগান দিয়া গুতা মারছে। আমি রাগে থাবা দিয়া হের স্টেন গানের নলে ধইরা টান দিয়া কইলাম, গুলি মারলে সামনে দাঁড়াইয়া আমার সিনাতে গুলি মার। তহনি ঘুম ভাইঙ্গা গেছে আর দেহি মায়ে আমার সামনে দাঁড়াইয়া আছে আর আমার হাতে একটা লাটি। হা..হা..হা..মায়ে আমারে ঘুম থাইক্যা জাগাইবার লাইগ্যা লাটি দিয়া গুতা দিছিল। খোয়াবে লাটিডারে স্টেনগান মনে কইরা টান মারছিলাম। মায়ে আমারে জড়াইয়া ধইরা কইলো, বাজান তুই কি কুনু খারাপ খোয়াব দেখছত নাকি? কেডা তোরে পিছন থাইক্যা গুলি মারব?
মায়েরে সাহস নিয়া কথাডা কইয়া ফালাইলাম, আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিমু, পাক সেনার সঙ্গে যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করুম। মায়ে আমার কথা হুইন্না হাউমাউ কইরা কাইন্দা উঠছে। আমারে কিরা কসম দিয়া যুদ্ধে যাইতে নিষেধ দিতাছে। আমি অইলাম বংশের একমাত্র বাত্তি, আমি যদি যুদ্ধে মইরা যাই, তাইলে বংশের বাত্তি নিব্বা যাইবো। আরও কতো কথা কইতাছে, আমি ফতুয়াডা কান্দে লইয়া, না খাইয়া বাজারে দিকে পথ দিলাম। মায়ে পিছন থাইক্যা ছিল্লাইতাছে, ওরে পুত কিছু মুখে দিয়া যা। আমি আর শুনলাম না, সিদা বাজারে আইয়া আকছির মিয়ার চায়ের দোকানে গিয়া বইলাম।
তহন আকছির মিয়া আমারে ফিসফিসাইয়া কইলো, মাইনসের মুখে হুনলাম তোমরা নাকি যুদ্ধে যাইবা? আমি কইলাম, তুমি হুনলা কেমনে? আকছির মিয়া তহন চাপা স্বরে কইলো, যাইবার অইলে আইজকা রাইতের মইধ্যে যাও, নাইলে কাইলকাই হারামি শান্তি বাহিনী তোমরারে পাক সেনার হাতে ধরাই দিব, আমার কাছে খবর আছে।
মাথার মইধ্যে খুন চাইপ্পা গেল, মনে মনে নিয়ত করলাম আইজকা রাইতেই পথ দিমু। কিছু সময়ের মইধ্যেই আমার সব দোস্তরা বাজারে আইল। সবাইরে লইয়া মিটিংয়ে বইয়া আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাইয়া দিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই রশিদ, করিম, ফিরোজ, জলিল, মুক্তার, হরিপদ আর অসীম আইজকা রাইতে আমার সঙ্গে যাইতে রাজি অইয়া গেল, বাকিরা বাড়িত গিয়া সিদ্ধান্ত নিব। আমি সবাইরে কইলাম, যারা আমার সঙ্গে যুদ্ধে যাইবা, আইজকা রাইতে দশটার সময় নদীর ঘাটে থাকবা। তারপরে হগলে বুক মিলাইয়া যার যার মতো বিদায় নিলাম। আমি তহন মোল্লা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম সখিনার লগে এক নজর দেহা করতে। পুকুর ঘাটের বাঁশঝাড়ের নিচে বহুত সময় বইসা আছিলাম, কিন্তু সখিনা ওই দিন পুকুর ঘাটে আর আহে নাই। সখিনা গো বাড়ির একটা ছোট মাইয়ারে পথে পাইয়া কইলাম, সখিনারে কইছ আমি আইজকা রাইতে যুদ্ধে যাইমু আর হয়তো দেখা নাও হইতে পারে। তারপর বাড়ির দিকে রওনা দিলাম আর বুকের মইধ্যে তহন ধুকপুকানি শুরু হইছে।
বাড়ির উঠানে পা রাখতেই দাদাজানের গলার আওয়াজ শুইন্না কইলজাডা শুকাইয়া কাঠ অইয়া গেছে। দাদাজানে আমারে কইলো, তর মায়ের মুখে আমি কি শুনলাম? আমিও সাহস নিয়া জবাব দিলাম, যা শুনছো, ঠিকি শুনছো। মায়ে আর দাদিজানে মরা কান্দন শুরু করছে আর দাদাজানে কতো কিছু বুঝাইতাছে কিন্তু আমি অনড়। শেষমেশ দাদাজানে মায়ে আর দাদিরে কান্দন থামাইতে কইলো। আরও কইলো, ‘তোরাবের শরীলে আমাগো রক্ত, জবানে যখন কইয়া লাইছে, কথা আর নড়ব না, তোমরা হের যাওনের ব্যবস্থা কর।’
তহন মায়ে আর দাদিজান আমার পছন্দের তরকারি রানতে গেছে আর আমি কিছু কাপড় ছোপর গুছগাছ কইরা বিছানায় শুইয়া একবার সখিনা আরেকবার যুদ্ধের কথা ভাবতাছি। এমুন সময়ে মায়ে আইয়া খাইতে ডাকল কিন্তু আমার খিধা নাই। তবুও গিয়া দাদাজানের লগে বইলাম। সবাই মিল্লা জোর কইরা অনেক কিছু খাওয়াই দিল। রাইত বাড়তাছে আর যাওনের সময় কাছাইয়া আইছে।
আমি সবাইরে কইলাম, আমি পথ দিমু অহন। মায়ে আর দাদিজান তহন আমারে জড়াইয়া ধইরা কান্দন শুরু করল। আমি সান্ত্বনা দিয়া কইলাম, সুযোগ মতো মাঝে মইধ্যে আইয়া দেহা করুম, চিন্তা কইরো না। দোয়া কইরো, আমরা যেন যুদ্ধে জিততে পারি। মায়ে তখন কইলো, তুই যেদিন দেশ স্বাধীন করতে পারবি, হেই দিন আমার কাছে ফিরা আবি। এহন এই দেশ তোর মা, দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত আমি তোর সব দাবি ছাইড়া দিয়া দেশের কাছে সইপ্পা দিলাম। মায়ের কথায় সিনা টান টান হইয়া গেছে, শরীলে রক্ত ফুটতাছে।
মায়ে আমার হাতে চিড়া, মুড়ি, গুড় আর নাড়ুর একটা পুটলি ধরাইয়া কইলো, খিধা লাগলে খাইছ বাজান আর দাদাজানে আমারে বেশ কিছু খরচের টাকা দিয়া কইলো, আরও লাগলে খবর পাঠাইছ। আর দেরি না কইরা সবাইরে পায়ে ধইরা সালাম কইরা পথ দিলাম নদীর ঘাটের দিকে। সখিনা গো বাড়ির রাস্তা পার হমু, এমুন সময় কেডা জানি আমারে পিছন থাইক্যা জড়ায়া ধরছে। বুঝতে পারতাছি কুনু মাইয়া মানুষের শরীল। চাপা স্বরে কইলাম, কেডা তুমি...? তখন চাপা কান্দন সুরে কইয়া উঠল, আমি সখিনা। আমার তহন মনে হইছিল, আসমান থাইক্যা মাটিত পড়ছি। যে সখিনার হাত ধরতে পারি নাই, ঠিকমতো কথাই কইতে পারি নাই, হে আইয়া আমারে জড়ায়া ধরছে!!
সখিনা আমারে কইতাছে, ‘তুমি আমারে ফালাইয়া একলা যুদ্ধে যাইতে পারবা না তোরাব ভাই, আমিও তোমার লগে যামু।’ আমি পিছন ঘুইরা সখিনার মুখের দিকে চাহিয়া দেহি, কাইন্দা চোখ ভাসাইয়া লাইছে। তখন আমার মনে হইতাছিল, শরীলডা অবশ হইয়া গেছে, জবানে আওয়াজ দিতে পারতাছিলাম না। তবুও বুকের মইধ্যে পাষাণ বাইন্ধা কইলাম, ‘তুই মোল্লা বাড়ির মাইয়্যা, তুই এতো রাইতে বাইরে আয়োন উচিত হইছে না।’
সখিনা আমার কথাডা শুইন্যা রাইগা কইলো, ‘আমি আর বাড়ি ফিরা যামু না। হয় তোমার সঙ্গে যুদ্ধে যামু, আর নয়তো দুই চক্ষু যেদিক যায়।’
আমি তহন আমার মহব্বতের কসম দিয়া কইলাম, ‘তুই যদি আমারে হাছা মহব্বত করছ, বাড়ি ফিরা যা কেউ দেহনের আগে। আমি তোরাব আলী রাইতের আইন্ধারে তোরে সঙ্গে নিয়া দুই পরিবারের ইজ্জত মারতে পারুম না। আমি যুদ্ধ শেষে ফিরা আইয়া তোরে বিয়া কইরা ঘরে তুলুম। যা এই বার তুই বাড়ি ফিরা যা।’
কথাটা শেষ কইরা আমি এক মুহূর্ত না দাঁড়াইয়া হাঁটা শুরু করলাম। আমার বুকটা তহন ফাইট্যা যাইতাছিল। এমুন সময়ে সখিনা পিছন থাইক্যা কইয়া উঠল, ‘তোরাব ভাই, কথা দিয়া যাও, তুমি ফিরা আইবা।’
আমি তহন পিছন ফিরা কইলাম, ‘আমি তোরাব আলী তোরে জবান দিলাম, আমি যুদ্ধ শেষে ফিরা আমু।’
সখিনা তহনও পথে বইসা কানতাছে, আমি আবার কইলাম, যা সখিনা, বাড়ি ফিরা যা।
সখিনা তহন দাঁড়ায়া কইলো, ‘আমিও জবান দিলাম, তুমি না ফিরা আসা পর্যন্ত সারা জীবন তোমার অপেক্ষায় থাকুম।’
তহন আমার চোখের পানি আটকাইতে পারলাম না। আর কথা না বাড়াইয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে নদীর ঘাটের দিকে পথ দিলাম। গিয়া দেখি সব দোস্তরা আমার আগেই আয়া পড়ছে। হগলে বুক মিলাইয়া তারপরে নৌকায় উইঠা যুদ্ধে যাওনের যাত্রা শুরু করলাম। নদী পার হইয়া রাইতের মইধ্যেই বর্ডার পার হইয়া ইন্ডিয়া ঢুইকা গেলাম মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে।
মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আমরা সবাই ট্রেনিং লইলাম। ট্রেনিং শেষে ২৫ জন কইরা বেশ কয়ডা গেরিলা গ্রুপ বানাইয়া দিল। একটা গেলিরা গ্রুপে আমরা নয়জন দোস্ত আছিলাম, বাকিরা সবাই আছিল কলেজের ছাত্র আর একজন কলেজের স্যার। কইতে গেলে আমরা আছিলাম একটা নওজোয়ান গ্রুপ, সবাইর শরীলের রক্ত টকবগ করতাছে যুদ্ধের ময়দানে নামতে। আমাগো গ্রুপের কমান্ডার আছিল ওই স্যার আবীর আহমদ আর আমি আছিলাম গ্রুপের সহ–কমান্ডার। আমরা সবাইর হাতে অস্ত্র তুইল্যা দিয়া ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন সবাইরে লইয়া শপথ বাইক্য পড়াইলো। শপথ পড়তে পড়তে রক্ত গরম হইয়া গেছে, শপথ বাইক্য শেষ কইরা সবাই এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ফায়ার করলাম দেশের নামে, এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ফায়ার করলাম মায়ের নামে, এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ফায়ার করলাম শহীদি ভাইদের নামে, তারপর ক্যাম্প থাইক্যা বিদায় নিয়া গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হইয়া রওয়ানা দিলাম যুদ্ধের ময়দানে।
যুদ্ধের ময়দানে আমরা মাইলের পর মাইল হাঁটছি, খাইছি কি না খাইছি। আমরা গাঁও–গেরামের পুলাপাইন আছিলাম, তেমুন অসুবিধা অয় নাই। কিন্তু ছাত্র পুলাপান এই কষ্ট সইতে পারে না, তবুও হার মানে নাই। খিধার জ্বালায় লতাপাতা খাইছি, আমার মায়ে আর দাদাজানে যদি দেখত, কাইন্দা মইরা যাইতো। পাকিস্তানি বাহিনী আর রাজাকারদের লাইগ্যা জঙ্গলে জঙ্গলে রাইত কাটাইছি। আমরা এর মইধ্যে বেশ কিছু গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিছি, এর মইধ্যে চাইরটাতেই
জিতছি। কিন্তু আমাগো দোস্ত পরিমল, ছাত্র পুলা সোহেলরে হারাইছি। দুইজনেই একই দিনে
শহীদ অয়। পরিমল আর সোহেলের লাশ কারও বাড়ি পাঠাই নাই, জঙ্গলেই নিজেরা বিনা কাফনে দাফন করছি। তহন ইংরাজি অক্টোবর মাসের শুরু, এমুন সময় হেডকোয়ার্টার থাইক্যা খবর আইলো, বড়ো একটা যুদ্ধের মিশন আছে, সবাই সাব-ক্যাম্পে যাওয়ার নির্দেশ পাওয়া মাত্র ক্যাম্পে ফিরা গেলাম।
এইবার আমাগো মিশন আছিলো, আর্মির বড়ো একটা ক্যাম্প দখল করা। হেইখানে বন্দী বাঙালি মা-বইনদের আর আটক বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাগো ক্যাম্প থাইক্যা উদ্ধার করা। সব মিলাইয়া আমরা সবাই পঁচাত্তর জনের একটা বড় গ্রুপ হইলাম। এই গ্রুপ ১৫ জনের পাঁচটা ছোটো ছোটো গ্রুপে ভাগ অইলাম। এইবার আমারে একটা ছোটো গ্রুপের কমান্ডার বানাইয়া দিল। তারপর প্ল্যান মোতাবেক একদিন রাইতে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হইয়া বিভিন্ন দিক থাইক্যা সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে ঝাপইয়্যা পড়লাম, তবে খুব সাবধানে। যাতে কইরা শুয়রের বাচ্চারা বুঝতে না পারে। তহন হায়েনার বাচ্চারা বাঙালি মা–বোনের ইজ্জত লইয়া ফুর্তি করতাছে আর রাজাকারের বাচ্চাগুলা ক্যাম্প পাহারা দিতাছে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাগো ওপর অমানবিক জুলুমবাজি চালাইতাছে।
প্রথমে আমরা দুই গ্রুপ সামনে আর পিছন দিকে পাহারা দেওয়া রাজাকারের বাচ্চাগুলার ওপর হামলা করি আর দুই গ্রুপ এই ফাঁকে ক্যাম্পের দুই পাশ দিয়া ভেতরে ঢুইকা পড়ে। আরেকটা গ্রুপ ক্যাম্পের চাইর দিক ঘেরাও দিয়া রাখে। ক্যাম্পের ভেতরের আর্মিরা প্রস্তুতি নিতে নিতে আমরা হগলে পুরা ক্যাম্প ঘেরাও কইরা ফেলি আর যেদিকে আর্মি দেখি, ফায়ার করতাছি। এইভাবে একের পর এক আর্মি মারতাছি, আর বন্দী মা–বইনদের চিল্লাইয়া কইছি আশেপাশে নিরাপদ দূরে সবাই একসাথে লুকাইয়া যাইতে। সবাই মিল্যা তাই করল, কিন্তু এর মধ্যেই পাক আর্মি পুরা প্রস্তুতি নিয়া আমাগো ওপর পাল্টা হামলা শুরু করল। ক্যাম্পে আমরা আগুন ধরাই দিলাম, তবুও কাম হইল না। আসলে আমরার ধারণার থাইক্যা দ্বিগুণের বেশি পাক আর্মি আছিলো, প্রায় এক শর বেশি অইবো। তুমুল যুদ্ধ চলতাছে, বৃষ্টির মতো গোলাগুলি।
আর্মি যেমন মরতাছে, তেমন কইরা আমাগো পুলাপাইন গুলি খাইতাছে। এইটাই আছিলো আমাগো সবাইর প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। হঠাৎ কইরা একটা গুলি লাগে আমার পায়ে তারপরে মাথায়, আর কিছুই কইতে পারি না। শুধু মনে আছে, ওই দিন আমি একলাই পাঁচটা পাক আর্মিরে কতল করি। যহন আমার হুশ আইলো, তহন আমি ইন্ডিয়ার কোনু একটা হাসপাতালের বিছনাতে শুইয়া আছি। তহনও কিচ্ছু কইতে পারি না, আরও কিছুদিন গেছে এমুন কইরা। আস্তে আস্তে হগল কিছু মনে পড়ছে। আমি নার্স দিদির কাছে দেশের খবর জানলাম, আমরা নাকি যুদ্ধে জিতছি, পাক বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করছে। সঙ্গে সঙ্গে জয় বাংলা, জয় বাংলা কইয়া ছিল্লাইয়া উঠলাম। দেশে ফিরা আইতে অস্থির অইয়া গেলে, ডাক্তর সাব আমারে ছাইড়া দিল। দেশে ফিরা সোজা বাড়ি ফিরা দেহি, বাড়ি আর বাড়ি নাই, একটা ধ্বংস লীলা অইয়া আছে।
আমার গেরামে ফিরা আইবার খবর পাইয়া আশপাশের দুই–চাইরজন আইয়া কইলো, মুক্তিবাহিনীর বাড়ি বইল্যা আমার দাদাজান, দাদি আর মায়েরে গুলি কইরা মাইরা এই বাড়ির ভেতরে আগুন লাগাইয়া সবাইরে পুড়াইয়া দিছে পাক আর্মি আর হারামি রাজাকারের বাচ্চারা। আমি রাগে কষ্টে চিল্লাইয়া উঠলাম, তারপর দৌড়াইয়া সখিনা গো বাড়ির দিকে গেলাম। সখিনা গো বাড়ির উঠানে দাঁড়াইয়া সখিনারে ডাকাডাকি করতাছি। এমুন সময়ে সুরোজ চাচা কাছে আইয়া কইলো, সখিনারে পাক সেনারা ক্যাম্পে তুইল্যা নিয়া গেছে, তারপর আর ফিরা আহে নাই। তহন আমি আবার চিল্লাইয়া আকাশ-পাতাল এক কইরা ফালাই। এরপর থাইক্যা মাইনসে আমারে পাগল কয়। অই পুলা, আমি কি পাগল, তোর কি তাই মনে অয়..?
আমি তখন দুচোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম, ‘আপনি পাগল নন, আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা।’
তখন তিনি আমাকে আবার বলে উঠেন, ‘তাইলে তুই আমার দাদাজান, দাদি আর মায়েরে ফিরাইয়া দে...আমার সখিনারে ফিরাইয়া দে...। সখিনা কইছিলো আমার লাইগ্যা সারা জীবন অপেক্ষা করব। তোরা কেউ আমার দাদাজান, দাদি, মায়ে আর সখিনারে রক্ষা করতে পারলি না, তয় কি এই তোদের লাইগ্যা আমি দেশ স্বাধীনে গেছিলাম...।’
এসব কথা বলতে বলতে আমাকে তোরাব আলী মারধর শুরু করলেন। সবাই মিলে উনাকে আমার কাছে থেকে সরিয়ে নিয়ে পাগল বলে মারতে শুরু করলে আমি সবাইকে বাঁধা দিই। তখন একজন বলে উঠলেন, ‘এই পাগলারে মুক্তিযুদ্ধের কথা জিগাইলেই হের পাগলামি শুরু অয়। আপনি নতুন মানুষ, জানেন না, তাই অযথাই হয়রানি হইলেন।’
আমি ওনার পুরো গল্প শুনে এবং ওনার পাগলামি দেখে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমার সামনে দিয়ে ‘সখিনা’ ‘সখিনা’ বলে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি উনাকে ডাকতেও পারছিলাম না। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে ওনার চলে যাওয়া পথের পানে তাকিয়ে ছিলাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।