অন্ধকার সমাজে রোকেয়া এনেছিলেন আলোর মশাল

পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল সেন্টার প্রাঙ্গণে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য।
পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল সেন্টার প্রাঙ্গণে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য।

একটা সময় ছিল যখন নারীরা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। উনিশ শতকের সেই সময় নারীরা ঘরের চৌকাঠ পেরোনোর কথা ভাবতেও পারত না। তাদের চিন্তাধারা, সুখদুঃখ চারদেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজে বিদ্যমান নানা সংস্কারের শিকলে বন্দী ছিল তাদের জীবন। এই শিকল ভেঙে বাইরে এসে জীবনকে চেনার পথটা তৈরি করে দিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, যাকে আমরা সবাই ‘বেগম রোকেয়া’ নামেই জানি।
বিদ্যমান সংস্কারের স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নারীকে চারদেয়ালের অন্ধকার থেকে বাইরে এসে জীবনকে আলোকিত করার পথটা দেখিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। নারীর মুক্তির যে মশাল তিনি জ্বালিয়েছিলেন তা আজও প্রোজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। এ কারণে তাঁকে বলা হয় নারী জাগরণের অগ্রদূত। বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী ৯ ডিসেম্বর। এই মহীয়সী নারী রংপুর জেলার পায়রাবন্দের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। বেগম রোকেয়ার পরিবার ছিল খুবই উচ্চশিক্ষিত ও সমাজসচেতন। তবুও তৎকালীন সমাজব্যবস্থার কারণে বাড়ির বাইরে মেয়েরা যেতে পারত না। বাড়ির ভেতরে আবদ্ধ অবস্থায় চলত তাদের পাঠের কার্যক্রম। বিশেষ করে আরবি ও উর্দু ভাষার পাঠ। কিন্তু বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের ছিলেন আধুনিকমনা। তাই তিনি রোকেয়াসহ অন্য বোনদের গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান।
১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ভাগলপুরের উর্দুভাষী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন আধুনিক মানুষ। স্ত্রীকে তিনি সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করেন। বেগম রোকেয়ার রচনার মধ্যে ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধবাসিনী’ ও ‘মতিচুর’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রয়েছে তাঁর গল্প ও কবিতা। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন শিক্ষা ছাড়া নারীর মুক্তি নেই। নিজের জীবন দিয়েই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, নারীরা কত পিছিয়ে।
বেগম রোকেয়া চেয়েছিলেন নারীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান, অধিকারটুকু পাক। তিনি বলতেন, ‘মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে তাহারা ভবিষ্যৎ আদর্শ নারীরূপে পরিচিত হইতে পারে।’ আরও বলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কী রূপে? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কত দূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে।’ তিনি নারী ও পুরুষকে একটি গাড়ির দুটি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাই তো তিনি ছিলেন সমতায় বিশ্বাসী।
বেগম রোকেয়া চেয়েছিলেন নারীরা আত্মনির্ভরশীল হোক। সে জন্য শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। স্বামীর মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ নামে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুদিন পর সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে ওয়ালীউল্লাহ্ লেনের একটি বাড়িতে ১৯১১ সালে তিনি আবার চালু করেন একই নামে স্কুল। অল্প কয়েকজনকে নিয়ে শুরু করা স্কুলটি ১৯৩০ সালের দিকে হাইস্কুলে পরিণত হয়।
নারীশিক্ষার প্রসারে বেগম রোকেয়া আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছেন। তখনকার দিনে পথ চলাটা অত সহজ ছিল না। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি, চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন নারীদের অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসতে। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মৃত্যুবরণ করেন। সমাজে নারীদের জন্য তাঁর যে অবদান, তা অবিস্মরণীয়। এই মহীয়সীর অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য ‘রোকেয়া হল’ নামকরণ করা হয়। এ ছাড়া পায়রাবন্দ গ্রামে পৈতৃক
ভিটায় নির্মিত হয়েছে ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’। রংপুর বিভাগে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’-এর নাম তাঁর নামে নামকরণ করা হয় তাঁকে সম্মান জানাতেই। এই অঞ্চলে বেগম রোকেয়া শুধু নাম নয়, একটি ইতিহাস বলা যায়।