যুদ্ধ দিনের স্মৃতি আজও মনে পড়ে

ডিসেম্বর মাস এলেই আমার মন চলে যায় ১৯৭১ সালে। মনে পড়ে কিশোরবেলার স্মৃতি; যুদ্ধদিনের স্মৃতি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হানা দেয় ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর। বাড়ি বাড়ি ঢুকে হত্যা চালায় নির্বিচারে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে হাত মেলায় রাজাকার, আল-বদরেরা। শান্তি কমিটির নামে দেশব্যাপী অশান্তি কায়েম করে। বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। লাইন করে গুলি করে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালায়। বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয় চেকপোস্ট। খুঁজে খুঁজে মুক্তিবাহিনীর ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার-পরিজনকে ধরে ধরে নিয়ে যায় পাষণ্ডের দল। বিজয়ের ঠিক আগে আগে দেশের বুদ্ধজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই, হানাদার বাহিনীর দমন-পীড়ন, রাজাকার, আল-বদরদের ত্রাসের রাজত্ব ইত্যাদি কচি মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল।
যুদ্ধ শুরুর পর একদিন কারফিউ চলাকালে আমাদের পাড়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দেখে পাকিস্তানি বাহিনী গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চালায়। পাড়ার কিছু লোক পানির কল থেকে পানি আনতে গিয়েছিল। তাদের তাড়া করেছিল তারা। তাড়া খাওয়া মানুষেরা দৌড়ে আমাদের বাসায় ঢুকে পড়ে। বিষয়টি গোচরে এলে পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলে আমাদের বাসা। তখন দুপুর। আমরা খাবার টেবিলে আব্বার সঙ্গে বসে। উর্দু কথা শুনে আব্বা বের হন। পিছু পিছু আমরাও। আব্বাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে সেনারা। আব্বা উর্দুতে উত্তর দেন। এক সময় ওরা চলে যায়। আব্বা আম্মাকে আঙুল দিয়ে দেখান বারান্দায় টানানো কাগজের নৌকা, যা আমি ও আমার ছোট ভাই আবদাল ওসমানী মামার বাসা থেকে এনে টানিয়েছিলাম। একদিকে বঙ্গবন্ধুর ছবি, অন্যদিকে ওসমানী মামার ছবি। আব্বা বলেন, ‘ভাগ্য ভালো; দেখেনি। দেখলে সবাইকে মেরে যেত।’
এর পর শহর থেকে আমরা চলে যাই গ্রামে। আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে বিশ্বনাথ যান গাড়ি ভাড়া করে। বিশ্বনাথ থেকে নৌকায় গভীর রাতে গ্রামের বাড়ি চাঁন্দভরাঙ্গে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে আব্বাকে ঘিরে গ্রামের মানুষ যুদ্ধের খবর জানতে ছুটে আসে। আব্বা রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতেন মনযোগ দিয়ে। তাঁর আপন খালাতো ভাই কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর খবর জানতে খুব উদ্‌গ্রীব থাকতেন তিনি। আমাদের আত্মীয়স্বজনেরা শহর থেকে আমাদের বাড়িতে আসেন থাকার জন্য। পাশের গ্রাম রায়কেলী আমাদের নানার বাড়ি। সেখানেও আসেন অনেক আত্মীয়স্বজন। এভাবে গ্রামে আমাদের দিন কাটে ভয় ও আতঙ্কে। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে আব্বা নৌকার জন্য কাজ করেছেন প্রকাশ্যে। তাঁর খালাতো ভাই ওসমানী ছিলেন নৌকার প্রার্থী। ওসমানী আবার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এ পরিচয় আব্বার জন্য ছিল আতঙ্কের। সব সময় ভয় নিয়েই থাকতেন।
এদিকে গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের গ্রামের বাড়িতে আব্বার কাছে লোকজন আসত দেখা করতে। যুদ্ধের খবর জানতে ভিড় করত সবাই। ভয়ের মধ্যেও আব্বা সাহস দেন ছুটে আসা গ্রামের সহজ-সরল লোকগুলোকে। শোনাতেন যুদ্ধের খবরাখবর।
যুদ্ধের দিনগুলো গ্রামেই কাটে। দেশ স্বাধীনের আগে ৩ ডিসেম্বর আব্বা মারা যান। আব্বার মৃত্যুর পর দেশ স্বাধীন হয়। একদিকে আব্বার মৃত্যুর শোক, অন্যদিকে বিজয়ের আনন্দ। আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিজয় মিছিল বের করি; কণ্ঠে ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। গ্রামের পথ ধরে সারা গ্রাম আমরা ঘুরি। হাতে পতাকা। সেদিনের স্মৃতি আজও মনকে আলোড়িত করে। আব্বার মায়া মনকে নাড়া দেয়। দেয় আম্মার মায়াও। তাঁদের কথা মনে এলেই চোখে কান্না ভর করে।
তারপরও বিজয় দিবসের আনন্দ ভোলার নয়। আমাদের গৌরবের দিন এটি। বিজয় নিয়ে আমার ছড়া—

বিজয়ের মাস

বিজয়ের মাস এলো
জয় বাংলা জয়
হাসি খুশি ধুমধাম
নেই মনে ভয়।

রোদ হাসে ঝলোমলো
গান বাজে গান
পতাকাটা ঘরে ঘরে
ওড়ে অফুরান।

খেলা হয় মেলা হয়
খোকা খুকু মাঠে
সাজে দেশ প্রিয় ওই
দিন ভালো কাটে।

বিজয়ের আনন্দে যে
দেশ মাতে সুখে
সবুজের শোভা চোখে
খুশি মুখে মুখে।