মুজিব বর্ষ ও বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে
২০২০ মুজিবর্ষ। জাতির পিতার শততম জন্মবছর। দেশে–বিদেশে উৎসব–আনন্দে তা পালনের প্রস্তুতি চলছে। জাতির পিতার জন্মদিন ঘিরে চলছে নানা আয়োজন।
বিদেশে মুজিববর্ষ নিয়ে চলছে বেশ কাজকর্ম। ইতিমধ্যে ২০১৯ সালে একটি বড় স্বীকৃতি এসেছে বাংলাদেশের অভিবাসী সমাজের সঞ্চয়ে। ২৫ সেপ্টেম্বরকে ‘বাংলাদেশ ইমিগ্র্যান্ট ডে’ ঘোষণা করেছে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য।
আমেরিকার নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে প্রতিবছর ২৫ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে’ বা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী দিবস’ হিসেবে পালনের লক্ষ্যে বিল পাস করেছে স্টেট সিনেট। প্রবাসী বাংলাদেশিদের উত্থাপিত এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে স্টেট সিনেট সর্বসম্মতিক্রমে এই বিল পাস করে।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রথমবারের মত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় ভাষণ দেওয়ার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘মুক্তধারা ফাউন্ডেশন’ এই প্রস্তাব দিয়েছিল। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আলবেনিতে অনুষ্ঠিত সিনেট অধিবেশনে ‘বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে’ বিলটি উত্থাপিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দেওয়া হয় এবং তারিখটিকে স্টেট ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটের ওয়েবসাইটে দেওয়া রেজ্যুলেশনে এই সংবাদ দিয়ে উল্লেখ করা হয়, যেহেতু ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন, সে জন্য এই দিনটি নিউইয়র্কের বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এতে আরও বলা হয়, এ ছাড়া মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ২৫ সেপ্টেম্বরকে ‘বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে’ ঘোষণার জন্য যে প্রস্তাব করেছে, তাতে জাতিসংঘের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাংলায় ভাষণের কথা সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে’ ঘোষণার প্রস্তাবক ও নিউইয়র্কের মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বিশ্বজিৎ সাহা সেই সময়ই গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, দিনটিকে বাংলাদেশি ইমিগ্রান্ট ডে ঘোষণা করার লক্ষ্যে তিনি ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম সিনেটর টবি অ্যান স্ট্যাভিস্কির কাছে আবেদন করেন। কিন্তু ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে সিনেট অধিবেশনে এই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
এরপর ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি সিনেটর হোসে পেরাল্টার আবার বিষয়টি জানানো হয়। সিনেটর তখন আশ্বাস দেন, এই বিষয় নিয়ে তিনি কাজ করবেন। ২০১৮ সালের শেষ দিকে সিনেট নির্বাচনে হোসে পেরাল্টা পরাজিত ও তাঁর অকাল মৃত্যু হলে এই বিলটি নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। কারণ, ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রেজ্যুলেশনটিও সিনেটর হোসে পেরাল্টার প্রস্তাবনায় নিউইয়র্কে স্টেটে পাস হয়েছিল এবং তা স্টেট ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
এরপর মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ আরও কয়েকজন সিনেটরের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সিনেটর টবি অ্যান স্ট্যাভিস্কির কাছে প্রস্তাবটি পাঠান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিনেটর টবি অ্যান স্ট্যাভিস্কির ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আলবেনিতে অনুষ্ঠিত সিনেট অধিবেশনে এই বিলটি উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত ও স্টেট ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এখন থকে প্রতিবছর ২৫ সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক স্টেটে দিবসটি পালিত হবে। জাতির পিতা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন ২২ মিনিট, যা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে। প্রজন্ম জানতে পারছে বাঙালির বীরত্বের ইতিহাস। কেমন ছিল তাঁর সেই ভাষণ। এই প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজকের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সেই জাতিসংঘ সফরে জাতির পিতার সঙ্গী তোফায়েল আহমেদ একটি লেখায় লিখেছেন—
‘যেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য ও মহত্ত্বর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, সেদিনটি ছিল বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সাল।
ঐতিহাসিক এ দিনটির সূচনা হয় একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার। বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এই ঘোষণাটি শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি সুখী হয়েছি, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন; সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।’
এই দিনটিকে ‘বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে’ ঘোষণার জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছে একটি সুসংগঠিত টিম। কিন্তু হঠাৎ করেই আমরা লক্ষ্য করছি, নিউইয়র্কে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী একটি চিহ্নিত মহল সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তারা ‘প্রবাসী বাংলাদেশি দিবস’ নামে একটি ধুয়া তোলে মানুষজনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
জানা যাচ্ছে, এই বিষয়টির নেপথ্য কলকাঠি নাড়ছেন একজন ব্যক্তি, যিনি একসময় সাময়িকভাবে নিউইয়র্কে অভিবাসী ছিলেন। এখন তিনি ঢাকায় ‘এনআরবি’–এর সাইনবোর্ড লাগিয়ে টু-পাইস কামানোর ধান্দায় আছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিউইয়র্কের আরও একজন, যার পরিচয় ইতিমধ্যে একাত্তরের চেতনাবিরোধী বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেদনার কথা হচ্ছে, এই কাফেলায় যারা যুক্ত হয়েছেন, তারা কেউ বুঝে, কেউ না বুঝেই ঝান্ডা ওড়াচ্ছেন।
এই চক্রটি জ্যামাইকার একটি রেস্টুরেন্টে প্রথম যে সভাটি ডাকে, সেখানে নিউইয়র্কের একজন নারী প্রস্তাব করেন ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিবসকেই প্রবাসী বাংলাদেশি দিবস ঘোষণা করা হোক’। এই নারী আরও বলেন ‘রবীন্দ্রনাথ ভারতীয়। আমি বুঝি না কীভাবে এই লোকের গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হয়।’
আমরা সাধারণ প্রবাসীরা ওই নারীর এই বক্তব্যে পাকিস্তানি প্রেতাত্মা মোনায়েম খানের কণ্ঠের প্রতিধ্বনিই শুনেছি। কী বলেছিলেন মোনায়েম খান, প্রিয় পাঠক নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে।
একই চক্র জ্যাকসন হাইটসের একটি হলে আরেকটি সভা করে রেজ্যুলেশন পাস করতে চায়। উল্লেখ করা দরকার, এই চক্রটি কখনো ৩১ ডিসেম্বর, কখনো ১০ জানুয়ারি (বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস), কখনো ১৯৮১ সালের ১৭ মে (শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস) দিনটিকে ‘প্রবাসী বাংলাদেশি দিবস’ করার প্রস্তাব করে। কিন্তু তা বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়নি। তারপরও এরা থেমে নেই। তারা নানা দুরভিসন্ধি করেই যাচ্ছে। এদের মূল উদ্দেশ্য হলো, জাতির পিতার সেই জাতিসংঘ ভাষণের স্মৃতি ও কর্মকে ম্লান করে দেওয়া।
এই বিষয়ে আমরা সোচ্চার কণ্ঠে বলতে চাই, এসব চিহ্নিত অপশক্তিকে প্রতিরোধ করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা, সৃজনশীল লেখক আদনান সৈয়দকে জানিয়েছেন এই ইমিগ্র্যান্ট ডে বিষয়ে বেশ কিছু কথা।
শুধু জাতিসংঘ, ইউনেসকো নয়, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের পতাকা আজ নিউইয়র্কের ক্যাপিটাল হিলেও পত্ পত্ করে উড়ছে। নিউইয়র্ক স্টেট ২০০১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করছে। আর চলতি বছর ২৫ সেপ্টেম্বর যেদিন জাতির জনক বাংলা ভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেদিনটিকে নিউইয়র্ক স্টেট ঘোষণা করল বাংলাদেশি ইমিগ্রান্ট ডে। ৪৫ বছর আগে যিনি এই শহরে বীরদর্পে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন বাংলা নামে দেশের কথা, বাংলা ভাষার কথা, বাঙালি জাতির কথা—আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী লগ্নে সেই শহরই তাঁকে সম্মান জানাল ২৫ সেপ্টেম্বরকে ‘বাংলাদেশি ইমিগ্রান্ট ডে’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
ভাবলে অবাক লাগে, সত্তরের দশকে কতজন বাঙালি ছিল এ দেশে। আজ শুধু নিউইয়র্কেই ৩ লাখের বেশি বাঙালি বসবাস করছে। সাবওয়ে, ট্রেনে, বাসে সকলে বাংলায় কথা বলছে। জ্যাকসন হাইটস তো বাঙালি পাড়াই হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ দেখতেন, তার বাঙালিরা শুধু আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বেই বাংলাদেশ তৈরি করে ফেলেছে।
বাঙালিরা আজ সারা পৃথিবীতে আরও অনেক অর্জন করছে। আর তা সম্ভব হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নীতির জন্য। নানান বৈরিতার মধ্যেও তিনি জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন করে যে কূটনৈতিক সাফল্য দেখিয়েছেন, তা এককথায় অনন্য, অসাধারণ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সরাসরি যুক্তরাজ্যে গিয়ে এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া কি সহজ বিষয় ছিল? ’৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বসভায় জানান দিলেন। তারপর এক বছরও বাঁচতে দিল না হায়েনার দল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বংশ নির্বংশ করে আইন করল, এই হত্যার বিচার করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্বে সব বিশ্বনেতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাই তো আজও চিরঞ্জীব তিনি।’
ইমিগ্র্যান্ট ডে বিষয়ে আমি কিছু প্রস্তাবনা রাখতে চাই বর্তমান সরকার ও শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের সমীপে।
১. বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের একজন সদস্যের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে’ বিষয়ে একটি বিল উত্থাপিত হোক। ২৫ সেপ্টেম্বর এই দিবসটিকে মান্য করে সংসদের ভোটে তা পাস করা হোক।
২. বিলটি স্পিকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে আইন আকারে পাশা করা হোক।
৩. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাস বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে প্রতিটি বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে তা প্রবাসীদের কাছে জানিয়ে দেওয়া হোক। এবং তা করা হোক এই ২০২০ সালে মুজিববর্ষেই।
আমাদের অনেক প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপে আছেন। সবার জন্য একটি ‘কমন ইমিগ্র্যান্ট ডে’ হওয়া আবশ্যক। ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিপুঞ্জে পড়েছিল জাতির পিতার পদ ছায়া। এর চেয়ে বড় দিবস আর কি হতে পারে?
আবারও বলি, মুখোশধারী যারা এই দিনটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাইছে, আমরা তাদের চিনি। তাই এদের প্রতিহত করা হোক দেশে-বিদেশে।