নিউইয়র্কে বাংলা সংবাদপত্র ও বিজ্ঞাপনদাতা

দুনিয়াজুড়ে কাগজে ছাপা পত্রিকা বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিউইয়র্কে বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ১০ জানুয়ারি। এই ৩৫ বছরে বাজারে এখন আছে ১৮টি সাপ্তাহিক ও সাতটি অনলাইন বাংলা সংবাদপত্র। প্রশ্ন আসতে পারে, সেই তুলনায় পাঠক সংখ্যার অবস্থান কী? নতুন যারা সংবাদপত্র নিয়ে আসছেন তাঁদের অভিপ্রায় কী? তাঁরা কি পাঠককে এমন কিছু দেবেন যা আগে কখনো কেউ দেয়নি। একেবারে নতুন কিছু না দিলেও অনেক কিছু সংযোজন-বিয়োজন করায় প্রত্যয় নিয়ে নতুন যেকোনো উদ্যম শুরু হয়, এ কথা সবার জানা। পত্রিকা বাজারে আসার আগে পত্রিকায় যিনি অর্থ লগ্নি করবেন তাঁর সবচেয়ে বড় এবং প্রাথমিক প্রশ্ন ‘পত্রিকা প্রকাশ কী বাংলাদেশি জনসমাজে লাভবান কোনো ব্যবসা?’ এর আয়ের উৎস কী কী?

নিউইয়র্কের বাংলাদেশি জনসমাজে পত্রিকার আয়ের প্রধান উৎস বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিজ্ঞাপন। এই কথা পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক জানেন। তাঁদের চেয়েও ভালো জানেন বিজ্ঞাপনদাতারা।
বাংলাদেশে সংবাদ প্রকাশে সম্পাদকেরা সরকার বা রাজনৈতিক চিন্তা বিবেচনায় এনে সংবাদ প্রকাশ করতে বাধ্য হন বলে জানা যায়। তবে আমেরিকায় এ ধরনের সমস্যা নেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে যে কাউকে নিয়ে যে কেউ সত্য প্রকাশ করতে পারে। এখানে প্রধান সমস্যা বিজ্ঞাপনদাতা ও তাঁদের ফরমায়েশি সংবাদ।

‘আপনি একা পত্রিকা চালান বলে মেনে নিলাম অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। আমি নিজে নিউজ পাঠিয়ে আপনাকে ফোন করে বলেছিলাম, প্রথম পাতার ডান কোনায় বড় একটি রঙিন ছবি দিয়ে নিউজটি দিতে। আপনি সাদাকালো ছবি দিয়ে ভেতরের পাতায় নিউজটা দিলেন, এই নিউজ কেউ দেখবে? আমার বউয়ের কাছে মুখ দেখাব কীভাবে?’ কথাগুলো বলছিলেন সামাজিক সংগঠনের একজন বিজ্ঞাপনদাতা নেতা। মাথা নত করে এসব শুনছিলেন দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ হয়ে আসা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। এই কলামিস্টসহ আরও কয়েকজন সাধারণ মানুষ তাঁদের কথোপকথন প্রত্যক্ষ করেছিলেন জ্যাকসন হাইটসে।

সামাজিক সংগঠনগুলো বিশেষ কোনো উপলক্ষে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে? তাদের আচরণ যদি এমন হয়, তাহলে সাধারণ পাঠকও সহজেই অনুমান করতে পারেন নিয়মিত যারা বিজ্ঞাপন দেন তাঁদের আবদার অথবা আচরণ কেমন হতে পারে? পত্রিকার সম্পাদক বা সাংবাদিকদের এমন বেহাল দশা কী এক দিনে তৈরি হয়েছে?

সাপ্তাহিক বর্ণমালার সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘নিউইয়র্কে সাংবাদিক হওয়ার চেয়েও সম্পাদক হওয়া সহজ। প্রয়োজন শুধু নিজের অথবা অন্যের কিছু পয়সা খরচ করে একটি সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক-না হলে একটি ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা। আর সংবাদ কপি-পেস্ট, মেকআপ-গেটআপ করার জন্য বাংলাদেশে একজন লোক ভাড়া করা। তারপর ২৫ ডলার দিয়ে কয়েক হাজার বিজনেস কার্ড ছেপে নেবেন নিজ দায়িত্বে। ব্যাস, আপনি হয়ে গেলেন সাংবাদিক-সম্পাদক-প্রধান সম্পাদক অথবা আপনার যে পদবি ভালো লাগে।’
নিউইয়র্কে এমন সম্পাদক-সাংবাদিক নেহাত কম নয়। বেশ কয়েকটি প্রেসক্লাব থাকার কারণে তাঁদের নিয়ে টানাটানিও হয়। তাঁরাই বিজ্ঞাপনদাতা ও সাধারণ মানুষের কাছে সাংবাদিক পেশাটিকে খেলো করে তুলেছেন। বিজ্ঞাপনদাতারাও পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বা মান যাচাই করে কোনো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন তা নির্ণয় করেন না। মুখ পরিচিত দেখে টাকা দিয়ে দেন। কমিউনিটি যেহেতু ছোট তাই সবাই সবার কাছে পরিচিত। সে কারণে সব পত্রিকাতে কম বেশি বিজ্ঞাপন দিতে হয়। যিনি টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেবেন, তাঁর দায়িত্ব না কে সাংবাদিক কে অসাংবাদিক তা নিয়ে গবেষণা করা। আর বিড়ম্বনাটা ঘটে সেখানেই। তিনি সবার কাছে সমান সুবিধা চান।

সবচেয়ে লাভবান সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিক ২৮ বছর ধরে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক নাজমুল আহসানের কাছে পরামর্শ চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে ছবিসহ বিজ্ঞাপনদাতাদের অন্তত ১৫টি নিউজ দিতে হবে প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায়। একটু পরামর্শ দেন।’

এর উত্তরে সম্পাদক বলেছেন, পত্রিকার প্রধানতম দুই পৃষ্ঠায় টাকার পরিমাপ অনুযায়ী বিজ্ঞাপনীয় এত নিউজ দেওয়ার পর সেখানে আর কি কিছু অবশিষ্ট থাকে? আপনাদের ৯৬ পৃষ্ঠার পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে কেন? মানুষ অনলাইনে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছে। এত বড় পত্রিকা পড়ার কি কারও সময় আছে? বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে নতজানু না হয়ে পত্রিকার পাতা কমিয়ে দিন না। এত নতজানু হয়ে চলা যায় না।

নাজমুল আহসানের পরামর্শটি ভালো লেগেছে। বাংলা গণমাধ্যমগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হলে মূলধারার বিজ্ঞাপন সংগ্রহের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।