বন্ধুর বন্দনা!

কুহূ আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু। ওর কাগুজে নাম হলো পারভীন সুলতানা, আমরা ডাকতাম কুহূ। আমাদের ব্যাচে শত ছেলের মধ্যে মাত্র চারটি মেয়ে ছিল। তাদের নাম কুহূ, কিসি, পাখি আর লাকি! লাকি অল্প কিছুদিন ক্লাস করেই বুঝল, আইন ওর বিষয় নয়, সুতরাং বাদ দিল, পাখি সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে না উঠতেই আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারের গলায় মালা দিয়ে প্রবাসী হয়ে গেল। ল’ ফ্যাকাল্টির মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম আমি আর কুহূ। রাম গরুডের দুটি ছানার কারণেই হোক বা মনের তীব্র টানে, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে হেসে–কেঁদে কাটিয়ে দিলাম ইউনিভার্সিটির আটটি বছর!

কুহূ বাংলাদেশে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। আমি নিউইয়র্কে থাকায় ওর সঙ্গে নিয়মিত দেখা–সাক্ষাতের সুযোগ নেই। কিন্তু হাজারো মাইলের ব্যবধানকে তুচ্ছ করে ওর আর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বন্ধুত্ব, ভালোবাসার বন্ধন আজও অটুট, সগৌরবে টিকে আছে অমলিন। ‘চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল’ কথাটি সর্বাংশে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এই লেখায় আমি আমার এই বন্ধুটির কথা বলতে চাই...কুহূ, সে আমার ভালোবাসার কুহূ!

কুহূর বাড়ি রাজশাহীর সাগরপাডায়। আপাত শান্ত মনে হলেও সে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি বিশেষত উপস্থিত বুদ্ধির আঁধার! সারাক্ষণই মজার মজার কথা বলে পাশের মানুষটিকে হাসিয়ে নিজের মুখটি বেজার করে রাখায় তার জুড়ি মেলা ভার। ওর চরিত্রের মধ্যে আমি প্রায়শই হ‌ুমায়ূন আহমেদের নায়িকাদের ছায়া দেখতে পাই। একই সঙ্গে শক্ত ও নরমের মিশ্রণে বিধাতার এক অপূর্ব সৃষ্টি!

ওর সঙ্গে আমার ক্লাসেই প্রথম দেখা। আমি কাউকে সহজে তুই করে বলতে পারি না, তাকেও পারিনি। তুমি করে শুরু করতেই লম্বা চুলের ক্যাটস আইয়ের এই মেয়েটি অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা ক্লাসমেট নাকি? তুমি কেন?’ ভাবলাম আপনি করে না বলায় হয়তো কিছু মনে করেছে! আমার অপ্রস্তুত মুখের দিকে তাকিয়ে সে খিলখিল করে হেসে বলল, ‘তোর এই কিসি নামটা তো দারুণ!’ সেই থেকে শুরু, আজ অবধি আমি দারুণ এই মেয়েটির দারুণ দারুণ কথার প্রেমে দারুণভাবে আবদ্ধ। সে যে শুধু কথার জাদুকর তাই নয়, তার অপূর্ব সুন্দর, খাঁটি প্রেমময় একটি হৃদয়ও আছে; যে হৃদয়ে একবার যে ডুবেছে সে আর নোঙর তুলতে পারেনি, আমিও পারিনি। টিন–এজ জীবনের ভালোবাসা এই মধ্যবয়সেও পাকাপোক্তই আছে, সময়ের ব্যবধানে মলিন হওয়ার বদলে এই সম্পর্ক আরও দৃঢ়, মজবুত হয়েছে!
ইউনিভার্সিটিতে আমার লোকাল অভিবাবক ছিলেন রাজশাহী মেডিকেলের সিভিল সার্জন ডাক্তার মাহফুজ খান, সম্পর্কে আমার মামা। কিন্তু মামিরা খুলনায় থাকায় হল থেকে মামার কাছে গিয়ে থাকা সম্ভব ছিল না; পরে কুহূর বুদ্ধি মতো ওর আব্বাকে লোকাল অভিবাবক করি এবং যখন ইচ্ছা কুহুর বাড়িতে যাওয়া–আসা শুরু হয় আমার। আমরা সব বান্ধবীই ওদের বাড়ি যেতাম, তবে আমি ছিলাম ওদেরই একজন। খালা, খালু, ভাই, ভাবি, আপা, দুলাভাই—সবাই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। দুলা ভাইয়েরা কুহূ, শাহিনের (কুহূর ছোট বোন) সঙ্গে আমাকেও মেলায় নিয়ে যেতেন, এটা–ওটা কিনে দিতেন। তাদের সেই ভালোবাসার ঋণ এই জীবনে শোধ করা অসাধ্য!

কুহূদের পরিবার ছিল একান্নবর্তী। ওর আব্বা–আম্মা, বড় ভাই–ভাবি, ছোট ভাই–ভাবি, বড় বোন ও তাদের স্বামী সন্তানদের নিয়ে বাসায় ছিল জমজমাট পরিবেশ। বিশাল হাঁড়িতে রান্না হতো, আমি ওদের বাড়ির পালং শাক, বেগুন আর মিষ্টি কুমড়ার একটা তরকারির খুব ভক্ত ছিলাম। সেই রান্নাটি আমি এখন নিজেই করার চেষ্টা করি, কিন্তু ওদের বাড়ির মতো হয় না! বোনের বাচ্চাদের কুহূ, শাহিনই পড়িয়েছে। এই ব্যাপারেও কুহূর আন্তরিকতার তারিফ না করে পারছি না। অসীম ধৈর্য নিয়ে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চাগুলোকেও পড়াত। কুহুর নিজের সন্তানাদি নেই, এই বাচ্চাগুলোকে নিয়েই ওর ভুবন, ওরা কুহূকে আম্মু বলে ডাকে!

ফিরে যাচ্ছি কুহূ প্রসঙ্গে। সে আর আমি সব সময়ই একসঙ্গে পড়াশোনার ব্যাপারে আলাপ করে নোটপত্র তৈরি করতাম। সে যদি ক্রিমিনাল আইনের নোট করত, আমি করতাম সিভিল ল’, সে হিন্দু বা রোমান ল’ করলে আমি করতে মুসলিম ল’। আমাদের দুজনেরই বোঝাপড়া ছিল দারুণ। আমাদের দুজনের রেজাল্টও হয়েছে কাছাকাছি!

আমি যেমন পুজো, শবেবরাতের ছুটিতে ওদের বাড়ি থাকতাম, কুহূ ও তেমনি পড়ার সুবিধার্থে বা হলের কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আমার রুমে থেকে যেত। সে ছিল দারুণ অগোছালো আহ্লাদী টাইপের মেয়ে। সে আমার কাছে থাকতে এলে খুশিও হতাম, আবার রাগ হয়ে বকাও দিতাম ওর এলোমেলো স্বভাবের জন্য। সে কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখত না, ভাত খেয়ে প্লেট ধুত না, স্যান্ডেল পরে রুমে ঢুকে যেত, বইখাতা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখত। আমি ভীষণ বিরক্ত হতাম। ওকে বকা দিলেই বলত, ‘বেড়াতে এসেছি কাজ করব কেন?’ বলাই বাহুল্য, তিনি আজও তেমনই আছেন! মেইড থাকা সত্ত্বেও ওর ঘরবাড়ি এত অগোছালো।

আজও ভাবলে অবাক লাগে, মন্নুজান হলের ওই ছোট্ট সিঙ্গেল খাটে আমরা দুজনে রাজশাহীর প্রচণ্ড গরমে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুমাতাম; এত ছোট বেড ছিল যে, গা বাঁচিয়ে ঘুমানোর কোন উপায়ই ছিল না। এখন ভাবলে শিউরে উঠি, কিন্তু তখন কি আনন্দেই না গল্প করতে করতে ঘুমিয়েছি! আজ কুহূ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ ছাড়া ঘুমাতে পারে না। আর আমি নিউইয়র্কের এই তীব্র শীতেও হিটার দিয়ে আবার পাখা না ছেড়ে ঘুমাতে পারি না!

গত আগস্টে দেশ থেকে ফেরার সময় কুহূর বাসায় রাতে থাকতে গেলাম। এই প্রথম! ঘুমানোর সময় সে আমাকে বেডে ওয়ালের সাইডে থাকতে দিল। অন্য পাশে থাকেত চাইলাম, দিলই না। স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল, ‘তোর পছন্দ, আমার পছন্দ ক্ল্যাশ করছে, কিচ্ছু করার নেই! তা ছাড়া তুই মেহমান ক্যাটাগরিতে পড়িস না! আমি যখন রাগে দুঃখে ফুঁসছি, অবাক হয়ে দেখলাম কুহূ নাক ডাকছে। ঘুম না আসায় দরজা খুলে বারান্দায় বসে বসে ভোর হওয়া দেখলাম। সেও মন্দ নয়! আজান শোনা, নামাজিদের ব্যস্ত পায়ে মসজিদে ছোটা, পাখিদের জেগে ওঠা, গলির কুকুরের ডাক থেমে যাওয়া— ঢাকা শহরের জেগে ওঠা দেখলাম বহু বছর পর।

কুহূ আমার অন্তরে সবচেয়ে বেশি জায়গাজুড়ে থাকা একটি নাম। ওর কথা লিখে শেষ করার নয়! আমাকে সে এত পরিষ্কারভাবে বোঝে, যা অন্য কারওর পক্ষেই সম্ভব নয়। দোষে–গুণে মানুষ, কিন্তু কুহূর দৃষ্টিতে আমি দোষমুক্ত একজন মানুষ। আমি খুন করে এলেও একটাও প্রশ্ন না করেই সে আমার পক্ষ নেবে। সারা পৃথিবী আমায় ছেড়ে গেলেও কুহূ রইবে একাকী আমার পাশে আমৃত্যু—এই বিশ্বাস আমার আছে! আমার আর কুহূর পৃথিবী ভরে আছে বিশ্বাস, ভালোবাসা, মমতা আর সহমর্মিতায়। এ কারণেই প্রতিনিয়ত যোগাযোগের মাধ্যমে ভালোবাসার মহড়া না দিয়েও আমরা আজও ডুবে আছি অকৃত্রিম ভালোবাসায়!

আমি একটু রোমান্টিক, কুহূর ভাষায় অতি রোমান্টিক, বুদ্ধির চেয়ে ইমোশনে বেশি চালিত। প্রায়ই গল্পের বই পড়তে গিয়ে বা নাটক, সিনেমা দেখতে গিয়ে কেঁদেকেটে একাকার হয়ে যেতাম বা যাই। হ‌ুমায়ূন আহমেদের বাকের ভাই আর মুনার জন্য এখনো বুকের মধ্যে টনটনে ব্যথা আছে। যাকগে! তো মাঝেমধ্যেই আমি আর কুহূ হলে সিনেমা দেখতে যেতাম। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ দেখতে গেলাম হলের অন্য মেয়েদের সঙ্গে জোছনার সাজ পোশাকে, রঙিন ফিতায় চুল বেঁধে একেবারে ফাটাফাটি জোছনা সেজে। আজ আর মনে নেই, কার বুদ্ধিতে এমন সাজ দিয়েছিলাম! মনে হয় কুহূর বুদ্ধিতেই! সিনেমা দেখে আমি হলাম দারুণ নিরাশ আর কুহূ বেজায় খুশি!

কুহূ সব সময়ই উদ্ভট আজগুবি মার্কা সিনেমা দেখতে পছন্দ করত। ওর যুক্তি ছিল, ‘মা কাঁদছে, বাবা বকছে, ছেলে চাকরি পাচ্ছে না...এসব জীবনের গল্প, ঘরে ঘরেই আছে! পয়সা, সময় ব্যয় করে এসব প্যানপ্যানানি দেখতে রাজি না। অঞ্জু ঘোড়া দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে, নায়ক আকাশে উড়ে উড়ে ফাইট করছে...এগুলো পয়সা খরচ করে দেখার বিষয়! কুহূর যুক্তি খণ্ডানোর ক্ষমতা আমার কোনকালেই ছিল না, আজও নেই। তবে, আমরা দুজনেই প্রচুর বই পড়তাম, যেখানে যা পেতাম, ভালো মন্দ, খাদ্য-অখাদ্য স...ব!

কুহূ খুব ভালো নামকরণ করতে পারত। ক্লাসের প্রায় প্রতিটি ছেলেরই ও বিকট বিকট বীভৎস সব নাম দিয়েছিল। রওনকের থুতনিটা সুচালো ও দাঁতগুলো ছোট ছোট হওয়াতে তার নাম দিল...ছুঁচো, মমিনের প্রস্থ বেশি হওয়ায় এবং মুখ ভর্তি দাগ থাকাতে সে হয়ে গেল জলহস্তী, তাগড়া দশাসই কলিম হয়ে গেল ডাকু কলিম। আমাদের ক্লাসে কয়েকজন সাংবাদিক ছিল; ও তাদের দেখলেই বলত ‘দ্যাখরে সাংঘাতিকরা আসছে!’ এমনি করে কাউকে, ঘোড়ামুখী, কাউকে পটলকুমার, কাউকে মি. এইডস, কাউকে ঝালমুডি ইত্যাদি নামে ডাকত। তবে নামের ব্যাপারে সবচেয়ে মারাত্মক বিন্যাস ঘটিয়েছিল শান্তার প্রেমিক পরিমলের ব্যাপারে। আগে ডাকত রুনুঝুনু মল বলে, তবে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর ডাকত টয়লেট মল বলে! বান্ধবীদের নাম করণেও ও পিছিয়ে থাকেনি সে। একমাত্র আমিই বেঁচে যাই তার নামকরণ তালিকা থেকে।

কুহূকে একদিন একটু চিন্তিত মনে হলো। জিজ্ঞাসা করাতে জানাল, পাড়ার এক ভাবির বাচ্চা হয়েছে, ওর বিশেষ পছন্দের ভাবি। এখন ওই বাচ্চার একটা আনকমন নাম রাখতে হবে। আমি বললাম, রেখে দে, তোর জন্য তো ডাল ভাত। কুহূ বলল, আনকমন হলেই শুধু হবে না, পরেও যেন নামটি আনকমন রয়ে যায়, তেমন নাম। সত্যি চিন্তার বিষয়! হঠাৎ কুহূর মুখ হাসিতে ভরে গেল, পেয়ে গেছি! বলল, ‘নাম রাখতে হবে ইট, পাথর, খাট, পাট ইত্যাদি ইত্যাদি! আমি ভুরু কুচকে তাকাতেই বলল, ‘যেমন আনকমন তেমনি কেউ পরে কপিও করবে না!’
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই রাজশাহী বিআইটি (এখন রুয়েট)। ওই কলেজে বান্ধবী সালমার বন্ধু তাপু পড়ত। তাপু মাঝেমধ্যেই সালমার সঙ্গে দেখা করতে আসত আমাদের ক্যাম্পাসে। এভাবেই সালমার মাধ্যমে তাপু আর কুহূর পরিচয়, পরে প্রেম ও অবশেষে পরিণয়। তাপুর বাবা খুলনার ডাক্তার আর মা স্কুলের শিক্ষক। শ্বশুর–শাশুড়ির সঙ্গে কুহূর কথোপকথনও ফ্যান্টাস্টিক। কুহূর বিয়ের পরে শাশুড়ি তাকে বললেন, মা কাল তো ঈদ, অনেকেই আসবেন, তুমি যদি একটু রোস্টটা করো।

কুহূ মুখের ওপর বই ধরে রেখেই উত্তর দিল, ‘আমি রোস্ট বানাতে পারি না।’ শাশুড়ি বললেন, ‘আমি দেখিয়ে দেব।’ কুহুর উত্তর, ‘আমি নিজের সংসার করতে করতে যখন শিখে যাব, তখন করব!’ তিনি বললেন, ‘তুমি নতুন বউ, তাদের বলব তুমি করেছ।’ কুহূর উত্তর, ‘মা সে তো আপনি নিজে রেঁধেও আমার নাম দিয়ে দিতে পারেন! আর তা ছাড়া নতুন বউয়ের পরিচয়ে রোস্টের নমুনা কেন?

কুহূর বাচ্চা নেই দেখে তার শ্বশুর বাড়ির একজন মুরব্বি দুঃখ করে বলেছিল, ‘আহারে একটা বাচ্চাকাচ্চা হলো না, বংশের প্রদীপ জ্বালানোর কেউ রইল না।’ কুহূ বেশ কয়েকবারই এ ধরনের কথা শুনেছে। সেদিন ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিল, ‘কেন ছোট ছেলের ঘরে তো ছেলে সন্তান আছে। সে কি বংশের প্রদীপ নেভানোর জন্য জন্মেছে?’ কি কুৎসিত প্রশ্ন! তবে উত্তর যথার্থ!

আবারও কুহূদের বাড়ি প্রসঙ্গ! আগেই বলেছি শবে মেরাজ, শবে বরাত—এসব উপলক্ষে তার সঙ্গে আমাকে ওদের বাড়ি যেতে হতো। ওর ভাবিরা, আপারা সবাই মিলে হালুয়া, রুটি বানাতেন। আমরা কোন কাজই করতাম না, খাওয়া আর নামাজই আমাদের একমাত্র কাজ ছিল। আমরা মাগরিবের আগে আগে পাড়ার অন্য সব মেয়ের সঙ্গে ওদের পুকুরে গোসল করে মাথার চুল না মুছে, কোন কথা না বলে তাহিয়াতুল ওজুর নামাজ পড়তাম, চুলের থেকে যত ফোটা পানি পড়বে তত নেকি হবে—এই আশায়! তারপরে সারা রাত নফল নামাজ।
একবার কুহূ এক অদ্ভুত নিয়মে নামাজ পড়া শুরু করল। ও দুই রাকাত দুই রাকাত করে নামাজ না আদায় করে চার রাকাত করে আদায় করতে শুরু করল। জিজ্ঞাসা করায় উত্তর দিল, ‘সময় বাঁচাচ্ছি, বারবার নিয়ত, মোনাজাত—এগুলো করতে হচ্ছে না!’ জেনে করছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় বলল, ‘কবুল না হওয়ার কি আছে, আল্লাহই তো কবুল করার মালিক!’ এই হলো আমার কুহূ। নিষ্পাপ, নিজের বিশ্বাসে বিশ্বাসী!

গত বছর কুহূর সঙ্গে রাজশাহী গিয়েছিলাম। ওদের বাড়ির অনেক পরিবর্তন। সেই একান্নবতী পরিবারটি খালা–খালুর মৃত্যুর পর ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গেছে, কিন্তু প্রতিটি মানুষ আমাকে বরণ করে নিল সেই আগের অকৃত্রিম আদর, ভালোবাসা, মমতায়। বড় ভাইয়া বড় বড় মাছ কিনে আনল, মেজ ভাইয়া কিসি কই, কিসি কই করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, আর ছোট্ট তুহিন ফলমূলসহ এত কিছু এনে হাজির করল, যা খেয়ে শেষ করা দুঃসাধ্য। ডাইনিং টেবিলে খাবারের পাহাড় জমে গেল প্রতি বেলায়ই! সেই আগের মতো রাতভর আড্ডা চলতে লাগল। ছোট বোন শাহীন নওগাঁ থেকে ছেলেসহ ছুটে এল। হইচই আনন্দে দুটো দিন পার হয়ে গেল নিমেষেই! ওদের ছেড়ে খুলনার পথে রওনা হতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ!

আর হ্যাঁ, কুহূ বিবি ওই দিন ঘুম থেকে উঠে দেখেছিলেন আমি গোসল, নামাজ সব শেষ করে বসে আছি। সে রাতের স্বার্থপরতার কথা বেমালুম ভুলে গলা ধরে ঝুলতে ঝুলতে গভীর স্নেহে বলেছিল, এত কম ঘুমিয়ে বাঁচিস কি করে? এজন্যই তো তোর সব চুল পড়ে যাচ্ছে! এখন একটু ঘুমিয়ে নে যা!

এই আমার কুহূ, আমার ভালোবাসার ভীষণ ব্যতিক্রমী একজন মানুষ! মানুষকে বোঝার ও মূল্যায়ন করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। আমি কখনই মানুষ চিনি না, আর কুহূ কখনো মানুষ চিনতে ভুল হয় না! আমাদের রয়েছে হাজারো সোনাঝরা সকাল, তপ্ত দগ্ধ দুপুর, লাজরাঙা গোধূলি, বিষণ্ন মায়ার সাঁঝ আর মায়াবতী রুপালি রাতের গৌরবময় উপাখ্যান; স্মৃতিময় ইতিহাস অভিজ্ঞান!

এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘একটি ভালো বই, একটি ভালো বন্ধু আর একজন ভালো বন্ধু একটি লাইব্রেরির সমান!’ কুহূ, পুরো পৃথিবীতে যত লাইব্রেরি আছে, তার সমষ্টিগত ফলেরও অনেক ঊর্ধ্বের একজন বন্ধু। আল্লাহ তাকে ও আমাদের বন্ধুত্ব—দুই–ই হেফাজত করুন!