নায়াগ্রা জলপ্রপাত: তোমাকে অভিবাদন

খুব কাছ থেকে পর্যটকদের প্রপাত দর্শন। ছবি: লেখক
খুব কাছ থেকে পর্যটকদের প্রপাত দর্শন। ছবি: লেখক

নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ের পাতায় দেখা অপরূপ নায়াগ্রা। অনেক কিছুর সঙ্গে প্রেমের অনুষঙ্গে অনবদ্যভাবে জুড়ে গিয়েছিল নায়াগ্রা জলপ্রপাত। তার অনেক দিন পর ভূগোলের নায়াগ্রার কাছে একদিন পৌঁছালাম। জীবন্ত ছবির মতো সে জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে যেন চক্ষু চড়ক গাছ! যেন এক স্বপ্নপুরীতে হাজির হয়েছি হঠাৎ করে—এমনই এক অনুভূতি।

অসামান্য সে মায়াবী দৃশ্যের সামনে মনে হলো নতজানু হয়ে অভিবাদন করি নায়াগ্রাকে। অন্তরের ভালো লাগা ফুটে উঠতে চাইল শরীরী ভাষায়। চারদিকে সুন্দরের হাতছানি। কী মায়াবী; যেখানে গেলে আর ফিরতে ইচ্ছে হয় না। বিদগ্ধজনেরা তাই হয়তো বলেন, মানুষ আসলে প্রকৃতির পূজারি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নৈসর্গিক রূপ দেখার জন্য মানুষ ছুটে চলেছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

নায়াগ্রা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রপাত। এর হৃদয়ছোঁয়া নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিন কোটির বেশি পর্যটক সমবেত হন। নায়াগ্রা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে জলপ্রপাতের বৈচিত্র্যময় রূপ দেখার পরও সেখান থেকে আসতে মন চায় না। সূর্যোদয়ের সময় তার একরূপ, রাতে অন্য রূপ, দুপুরে প্রখর সূর্যের আলোয় আরেক রূপ,গোধূলি লগ্নে আরেক রূপ, আর রাতে যখন চারদিকে আলো জ্বলে ওঠে, তখন এ যেন স্বপ্নপুরী।

নায়াগ্রার জল কীভাবে নিচে পড়ছে, তা খুব কাছ থেকে দেখা যায়। সে জল নিচে পড়ার আগেই বাষ্প হয়ে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলে। সেই ধোঁয়ায় যখন সূর্যের আলো পড়ে, তখন সেখানে সৃষ্টি হয় রংধনুর। সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে আসা পর্যটকেরা বাতাসে ভেসে আসা সেই জলকণায় ভেজেন; অবগাহন করেন নায়াগ্রায়। নায়াগ্রা যেন বরণ করে নেয় অতিথিদের। জলপ্রপাতের চারদিকে দলবাঁধা সিগালদের ওড়াউড়ি, ধূ ধূ বাতাস, আর জল পড়ার শব্দ সেখানে মায়াবী এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। এমন পরিবেশে যে কারওই কবিতা আবৃত্তির ইচ্ছে করবে। ইচ্ছে করবে প্রাণ খুলে গাইতে, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা।’ গোধূলির সময় আবীরমাখা আকাশের প্রেক্ষাপটে সিগালদের ঘরে ফেরার দৃশ্য যে কারওই দৃষ্টি আটকে দেয়।

নায়াগ্রা জলপ্রপাত কানাডার অন্টারিও প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বে ও আমেরিকার নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এরি লেকের জলরাশি থেকে সৃষ্ট নায়াগ্রা নদী উৎপত্তিস্থলে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে বড় অংশটি নায়াগ্রা জলপ্রপাতে এবং ক্ষুদ্র অংশটি আমেরিকান জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে। এই দুই জলপ্রপাত দুই সহোদরার মতো পাশাপাশি অবস্থান করছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে অশ্বক্ষুরাকৃতির বলে একে ‘হর্স শু’ ফলস বলা হয়। কানাডীয় অংশে ১৭৩ ফুট ওপর থেকে এবং আমেরিকান অংশে প্রায় ১০০ ফুট ওপর থেকে নিচে জল পড়ে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের প্রস্থ ২৬০০ ফুট; আমেরিকা অংশে প্রস্থ ১১০০ ফুট। উভয় দিক থেকেই প্রপাত দুটো দেখা যায়। জলপ্রপাতে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৫ লাখ গ্যালন জল নিচে পড়ে, যা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকে কানাডা অংশে ২ মিলিয়ন কিলোওয়াট ও আমেরিকা অংশে ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।

ওপর থেকে যেমন জলপ্রপাত দুটো দেখা যায়, তেমনি নৌকায় করে খুব কাছ থেকেও তা দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। জলপ্রপাতের কাছেই রয়েছে স্কাইলন টাওয়ার, যা প্রপাতটি থেকে ৮০০ ফুট উঁচু। এই টাওয়ার থেকেও খুব সুন্দরভাবে জলপ্রপাত দেখা যায়। এ ছাড়া নদীর ওপর ঝুলন্ত হোয়ার্লপুল এয়ারো কারে চড়েও দেখা যায় জলপ্রপাতের মনোরম দৃশ্য ও কাছের পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় দৃশ্য। ১৬ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রতি শুক্র ও রোববার, সেপ্টেম্বর মাসের প্রতি শুক্রবার এবং আমেরিকা ও কানাডার প্রধান প্রধান ছুটির দিনে রাত ১০টায় জলপ্রপাত এলাকায় আতশবাজি পোড়ানো হয়। আতশবাজির শব্দ ও আলোয় আকাশ রঙিন হয়ে ওঠে সে সময়।

আমেরিকান অংশের নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ছবি: লেখক
আমেরিকান অংশের নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ছবি: লেখক

নায়াগ্রা জলপ্রপাতকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল উচ্চ দালান, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বিনোদনের জন্য রয়েছে কুইন্স ভিক্টোরিয়া পার্ক, ক্যাসিনো, গলফ ক্লাব, নায়াগ্রা হিস্টরিকাল সোসাইটি, মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, নায়াগ্রা অ্যাকোরিয়াম ও জিওলজিক্যাল মিউজিয়াম। আর কেনাকাটার জন্য রয়েছে বড় বড় শপিং কমপ্লেক্স, প্লাজা, সুপার মার্কেট, স্টোর, কারেন্সি এক্সচেঞ্জ সেন্টার, তথ্য কেন্দ্র, অনতিদূরে রয়েছে লেক এরি ও লেক অন্টারিও।

নায়াগ্রা দেখতে পর্যটকের ভিড় সারা বছরই লেগে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম হয় জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে। এখন যেখানে জলপ্রপাতটি দাঁড়িয়ে, ১২ হাজার বছর আগে তা ছিল সাত মাইল ভাটিতে। নদী ভাঙনে তা পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে তিন ফুট নদী ভাঙন ছিল। বর্তমানে প্রতি ১০ বছরে এক ফুট করে ভাঙছে। নায়াগ্রা নদী প্রায় ৩৫ মাইল দীর্ঘ। এর উজানে রয়েছে এরি হ্রদ এবং ভাটিতে অন্টারিও হ্রদ।

অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা, অসম্ভবকে সম্ভব করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। হাজার বছর ধরে মানুষ সেই চেষ্টাই করে আসছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দিতে গিয়ে কত লোক নায়াগ্রার জলেই হারিয়ে গেছে, তার হিসেব হয়তো কেউই জানে না। ১৮৫৯ সালে প্রথম জিন ফ্রানকুইজ গ্রেভলেট (যিনি ব্লনডিন নামে অধিক পরিচিত) রশির ওপর দিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দেন। ১৯০৭ সালে এন টেলর নামে এক মহিলা ব্যারেলের সাহায্যে নায়াগ্রার প্রবল জলরাশিকে অতিক্রম করে এপার থেকে ওপার যান।

নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ইতিহাস:
আজ থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে এখানে মানুষের পা পড়ে। এখানকার ভূমি তুন্দ্রা ও স্পুস ফরেস্টের সমন্বয়ে গঠিত। আজ থেকে ৯ হাজার বছর আগে এ অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল ক্লোভিস জনগণ। এরি লেকের তীরবর্তী অঞ্চলে নমভিক শিকারিরা ছোট ছোট গুহায় বাস করত। গ্রীষ্মে পাহাড়গুলোতে যেমন পশু-পাখি জড়ো হতো, তেমনি মেরু অঞ্চলের ছোট বড় শিকারি দল সমবেত হতো শিকারের জন্য। হরিণ, মাছ ও বৃক্ষরাজি তাদের আকৃষ্ট করতে। প্রাচীন এ যুগের (৯-৩ হাজার বছর আগ পর্যন্ত) পরের সময়টাকে (৩ হাজার থেকে ৩০০ বছর আগ পর্যন্ত) বলা হয় উডল্যান্ড কাল। এ সময়ে অধিবাসীরা গম, ভুট্টা, শিম, বরবটি চাষ করতে। সে সময়েই লাশ কবর দেওয়া, পোড়ানো বা জলে ভাসিয়ে দেওয়ার প্রচলন ঘটে। গড়ে ওঠে রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থা। তখন গ্রামগুলো পরিচালিত হতো নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা। ১৫০০ সালের দিকে ইউরোপীয়রা এখানে আসতে শুরু করে। অন্টারিওর হুরন, পেটুন ও নিউট্রাল—এই ত্রিজাতির ঐক্যকে তারা নষ্ট করে। অনেকে ছেড়ে যায় নায়াগ্রা। শুধু প্রকৃতিপ্রেমিক একটি অংশ থেকে যায়।

নায়াগ্রার আকাশে আতশবাজি। ছবি: লেখক
নায়াগ্রার আকাশে আতশবাজি। ছবি: লেখক

১৫৩৫ সালের পর সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে ফ্রান্স থেকে অনেকেই কানাডা আসেন। কিন্তু কেউই নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকায় যাননি। এটিনি ব্রুলি প্রথম ইউরোপীয়, যিনি লেক অন্টারিও, এরি, হুরন ও সুপিরিয়র হ্রদগুলো পর্যবেক্ষণ করেন এবং সম্ভবত তিনিই প্রথম ১৬১৫ সালে এই জলপ্রপাতে যান। ১৬৫১ সালে শ্বেতাঙ্গরা এখানকার আদিবাসীদের হটিয়ে স্থায়ী আবাস গড়ে। ১৬৭৮ সালে পাদ্রিদের প্রধান লুইস হেনিপিন নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে যান এবং এর ১৯ বছর পরে তাঁর রচিত বই ‘নোভেলি ডেকোভারট’-এ উঠে আসে এই জলপ্রপাতের কথা। এই বই লেখার পর ১৭০০ সালের দিকে মানুষ এ সম্পর্কে জানতে শুরু করে। তখন নদীপথই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ১৮২০ সাল নাগাদ এখানে পর্যটকদের যাওয়া শুরু হয়। ১৮৯৬ সাল নাগাদ এখানে গড়ে ওঠে সড়ক ও রেল যোগাযোগ।

বর্তমানে সড়ক, জল, আকাশ ও রেলপথে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে যাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত পর্যটকদের কাছে এখন প্রধান আকর্ষণীয় স্থান। বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স ১৮৪১ সালে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পরিদর্শন করে বলেছিলেন, ‘নায়াগ্রা ওয়াজ অ্যাট ওয়ানস স্টাম্পড আপন মাই হার্ট এন ইমেজ অব বিউটি টু রিমেইন দেয়ার চেঞ্জলেস।’ পৃথিবীতে কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলো চোখে দেখা যায়, অনুভব করা যায়, উপলব্ধি করা যায় কিন্তু কাউকে এর সৌন্দর্য বর্ণনা করে বোঝানো যায় না, ঠিক তেমনই এক প্রকৃতিপ্রদত্ত নন্দন নায়াগ্রা জলপ্রপাত। নায়াগ্রার হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য প্রকৃতিপ্রেমীদের নিত্য আহ্বান জানায় এবং সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক এখানে আসেন।

যারা যাবেন, তাদের জন্য কয়েকটি টিপস:
নায়াগ্রা যাওয়ার জন্য জুলাই ও আগস্ট মাসই উত্তম। কারণ, সে সময় এ এলাকায় আবহাওয়া থাকে ভালো। তবে সামার জ্যাকেট বা রেইনকোট নিতে ভুলবেন না। লাইফ জ্যাকেট থাকলে ভালো। ভালোভাবে সবকিছু দেখতে হলে দু দিন-দু রাত থাকার পরিকল্পনা থাকতে হবে। এখানে কম খরচে থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। ডাবল বেড ৮০ ডলার থেকে ২৫০ ডলার পর্যন্ত। ২০০ ডলারেও দুজনের থাকা সম্ভব। এখানে রয়েছে রেন্ট এ কার, বাস সার্ভিস, ট্যাক্সি, শাটল বাস সার্ভিস। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া দিয়ে বাসে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের সুবিধা রয়েছে। ঘোড়ার গাড়িতে করে বেড়াতে পারবেন জলপ্রপাত এলাকা। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সঙ্গে নিজেকে একই ফ্রেমে বন্দী করতে একটা ক্যামেরা নিতে ভুলবেন না যেন।