পরিশ্রমী ব্যক্তি কখনো গরিব থাকে না

গরিবের ঘরে জন্মগ্রহণ করা পাপ নয়, কিন্তু গরিব হয়ে মৃত্যুবরণ করা মহাপাপ। কারণ একমাত্র অলস মানুষেরাই গরিব হয়ে মারা যায়। এবার বুঝিয়ে বলছি। মানুষ যখন এই ভবে জন্ম নেয়, তখন সে কার ঘরে বা কোন পরিবারে জন্ম নেবে, তা নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু মানুষ কীভাবে মৃত্যুবরণ করবে, তা অনেকাংশেই তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই ধরুন—আপনি যদি রাস্তায় বের হন, তাহলে নানা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘কিন্তু আমি অনেক সুস্থ মানুষকে দেখেছি হঠাৎ মারা যেতে!’ একজন মানুষের মৃত্যু হতে হলে তার হৃৎকম্পন বন্ধ হতে হয়। আর হৃৎকম্পন আপনা-আপনি বন্ধ হয় না। তার পেছনে নিশ্চয় কোন কারণ থাকে।
আচ্ছা, এসব নিয়ে বিস্তারিত আর নাইবা বললাম। এবার বলি, গরিব হয়ে মরা কেন পাপ বা গরিব হয়ে জীবনযাপন করা কেন পাপ? আপনি যদি গরিব হন, তাহলে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন আপনি গরিব কেন? গরিব না থাকার জন্য আপনি কী কী কাজ করেছেন। উত্তরে হয়তো আপনি বলতে পারেন, আমি অনেক পড়াশোনা করে মাস্টার্স শেষ করেছি কিন্তু আমার একটি চাকরি নেই। কারণ চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দুর্নীতি থাকে বা টাকা–পয়সার ব্যাপার থাকে, যা আমার নেই। সে জন্য আমার চাকরি হচ্ছে না। আবার নিজেকে সৎ মানুষ দাবি করে গরিব হয়ে থাকার জন্য সান্ত্বনা দিচ্ছেন। একটু ভেবে দেখেন, আপনি যদি মাস্টার্স পাস করে সত্যিই জ্ঞান অর্জন করে থাকেন, তাহলে সে জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা কি করেছেন?
জ্ঞানের প্রয়োগ বা অর্থ উপার্জনের জন্য আপনার চাকরি থাকতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। চাকরি না খুঁজে নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হোন। নিজে চাকরি তৈরি করুন। সেই চেষ্টা কি আপনি করেছেন? নাকি শুধু নিজের ভাগ্যের দোষ দিয়ে সারা রাত অন্যত্র আড্ডা দিয়ে বেলা ২টা বাজে ঘুম থেকে উঠছেন। সব মানুষের জীবনে ভাগ্যের দরজা সামনে এসে হাজির হয় না। অনেক সময় কোন কোন ব্যক্তিকে ভাগ্যের দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য বহু সংগ্রাম করে প্রথমে ভাগ্যের বাড়ি বানাতে হয়। তারপর সেই বাড়ির দরজা দিয়ে তাকে সাফল্যের কক্ষে প্রবেশ করতে হয়। তেমনি আপনার জীবনে ভাগ্যের দরজা সামনে না আসলে, তা নিয়ে কান্নাকাটি করলে ভাগ্যের দরজ আপনার সামনে আসবে না। মোদ্দাকথা হচ্ছে, অলস বসে থাকলে চলবে না।
আপনি যদি সারা দিন সরস্বতীর পূজা নিয়ে ব্যস্ত থেকে পড়াশোনাই বাদ দিয়ে দেন, তাহলে কখনো বিদ্যা অর্জন করতে পারবেন না। তেমনি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে কান্নাকাটি করলে চাকরি আপনার দিকে ছুটে আসবে না। আপনাকে ভাগ্যের দুয়ার আপনার সামনে আসবে বলে অপেক্ষায় না থেকে পরিশ্রম করে ভাগ্যের বাড়ি বানাতে হবে। তাহলেই জীবনে সাফল্য লাভ করতে পারবেন। অলস হয়ে বসে থাকলে সাফল্য আপনার জীবনে আসবে না। অলস হয়ে বসে থাকতে থাকতে আপনার শরীর এতই অভ্যস্ত হয়ে যাবে যে, কোন দিন সত্যি সত্যি কোন সুযোগ আপনার সামনে আসলে, আলসেমি করে তা ফিরিয়ে দেবেন।
সুতরাং আপনাকে নিয়মিত কাজ করে যেতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে—কেননা পরিশ্রমী মানুষ গরিব থাকে না। তারা সুযোগ এলে সে সুযোগটি সহজেই লুফিয়ে নিতে পারে না। কারণ নতুন সুযোগ মানে—নতুন পরিশ্রম। আর পরিশ্রমী ব্যক্তি কখনো পরিশ্রমকে ভয় করে না। একমাত্র অলস ব্যক্তিই পরিশ্রমকে নানা অজুহাতে এড়িয়ে চলে। অন্যদিকে, যে ব্যক্তি তার খারাপ অবস্থার জন্য নিজের দোষ না দিয়ে নানা ধরনের অজুহাত দেয়, সে ব্যক্তি অলস ব্যক্তির চেয়েও অধম। অলস ব্যক্তি তার জীবনের কোন একপর্যায়ে তার অসাফল্যের পেছনে তার আলসেমির ভূমিকা বুঝতে পারে। কিন্তু অলস ব্যক্তি সারা জীবন শুধু অজুহাত দিতে ব্যস্ত থাকে।
যেমন—আমি এটা পারি না, কারণ আমার এ সমস্যা, আমি কখনো এটা করতে পারব না, কারণ আমি এভাবে বেড়ে উঠিনি বা আমি এটা করতে পারছি না, কারণ আমার পরিবারের এ সমস্যা বা সময় নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিশ্রমী ব্যক্তি অজুহাত দেওয়া পছন্দ করে না। তারা শুধু কাজ করে যায়। আবার কেউ বলে, পাশের বাড়ির অমুকের ছেলে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করে, এখন অনেক বড় চাকরি করছে, কারণ তাদের অনেক টাকা-পয়সা আছে। আমার কোন টাকা-পয়সা নেই, তাই ভালো কোন চাকরি করতে পাচ্ছি না। আমাদের সবার জানা উচিত, জীবনটা প্রকৃতপক্ষে ন্যায্য নয়। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মানলাম, আপনি গরিবের ঘরে জন্মেছেন, বহু কষ্টে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু অর্থের অভাবে চাকরি পাচ্ছেন না। আপনি ইচ্ছা করলে টিউশনি করতে পারেন। নিয়মিত টিউশনি করলে মাসে হাজার হাজার টাকা আয় করা যায়। কিন্তু তাতে তো দারিদ্র্য কাটানো সম্ভব নয়। ঠিক বলেছেন। রিকশা একটি ভাড়া করে চালান। নিয়মিত যারা রিকশা চালায়, তারা মাসে সহজেই পঁচিশ হাজার টাকা আয় করতে পারে। ধরুন, টিউশনি করে আপনি মাসে ১৫ হাজার আয় করছেন। তাহলে আপনার মাসিক আয় ৪০ হাজার টাকা হয়।
এবার অর্থ সঞ্চয় করার চেষ্টা করুন। সঞ্চয়ের অর্থ দিয়ে ছোটখাটো একটি বিনিয়োগ করুন। এরপর আপনি আপনার কলেজজীবনের সংগ্রহ করা জ্ঞান খাঁটিয়ে ব্যবসাকে অনেক ওপরে নিয়ে যান। ভাগ্যের দরজা সামনে না আসলে ভাগ্যের বাড়ি তৈরি করুন। কি? মাস্টার্স ডিগ্রি করে নিম্নমানের কায়িক পরিশ্রম করতে মান-সম্মানে লাগছে। কাজ করতে বা পরিশ্রম করতে যদি আপনার মান-সম্মানে লাগে বা লজ্জা পান, তাহলে আপনি কোনদিন উন্নতি করতে পারবেন না।

পৃথিবীর বহু গুণী ব্যক্তি সফল হতে সব ধরনের কাজ করে গেছেন। কোন ধরনের কাজে তাঁরা লজ্জাবোধ করেননি। জীবনে সফল হতে হলে আপনার কাজের প্রতি সম্মানবোধ থাকা উচিত। তা না হলে জীবনে উন্নতি করা অসম্ভব। একটু ভাবুন, আপনার মানসম্মানে আঘাত দেয় বলে আপনি অনেকদিন কোন নিম্নমানের কাজ করছেন না, তাই আপনার পকেটে কোন অর্থ নেই। খেয়ে না খেয়ে কয়েক দিন কাটলেন। আপনার ভেতরের ইগো কি আপনার পেটের যন্ত্রণা নেভাতে পারবে? অথবা যে সমাজের মানসম্মানের কথা ভেবে আপনি নিম্নমানের কাজ করেননি, সে সামাজ কি আপনাকে বসিয়ে খাওয়াবে? তাই কোন কাজেই লজ্জা পাওয়া উচিত নয়—অপরাধমূলক কাজ ছাড়া।
উন্নত বিশ্বের মানুষ গরিবদের তেমন পছন্দ করে না। এবার সে বিষয়ে একটু বুঝিয়ে বলি। উন্নত বিশ্বের মানুষেরা মনে করে, আপনি গরিব মানে আপনি অলস, আপনি পরিশ্রম করেন না, আপনি কাপুরুষ বা আপনি অসৎ। যে ব্যক্তি পরিশ্রম করে, সে কখনো গরিব থাকে না। তাই বলে সারা দিন আপনি দিনমজুরের কাজ করে জীবনে উন্নতি লাভ করতে পারবেন না। হালের বলদ সারা দিন অসম্ভব পরিশ্রম করে এবং দিন শেষে সে বলদই থেকে যায়, বুলফাইটে অংশ নেওয়া যোদ্ধা বলদ হয় না। জীবনে পরিশ্রমের পাশাপাশি আপনাকে জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে এবং সেই পরিকল্পনা মাফিক আপনাকে কাজ করতে হবে। তাতেই আপনি সাফল্যের মুখ দেখতে পারবেন।
এবার ধরুন, আপনি জীবনে কোন পড়াশোনাই করেননি। অনেকের ভাগ্যে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ভাগ্য জোটে না। তাই বলে আপনি সে অজুহাত নিয়ে সারা জীবন গরিব থেকে যাবেন? লেখাপড়ার আসলেই কোন বয়স নেই। হয়তো আপনি ছোটবেলায় কোন কারণে পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, আপনি ইচ্ছে করলে এখনো স্কুল কলেজে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারেন। আচ্ছা ধরলাম, এখনো কোন কারণে পড়ালেখা করতে পারছেন না। তাহলে আপনি দারিদ্র্যের হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পাবেন? পুরো একটি দিন মানে পুরো ২৪ ঘণ্টা। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি আপনার পুরো ২৪ ঘণ্টা কীভাবে কাটান। আলস্যে সময় কাটানো নিজের পায়ে কুড়াল মারার সমতুল্য। একজন প্রাপ্ত বয়স্কের দিনে ছয় বা সাত ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। তাহলে বাকি থাকে আরও সতেরো বা আঠারো ঘণ্টা। এ সময় আপনি কীভাবে ব্যবহার করেন? একজন দিনমজুর দিনে সর্বোচ্চ সাত বা আট ঘণ্টা কাজ করে, তাহলে আপনার আরও পুরো দশ ঘণ্টা বাকি থাকে। বাকি ১০ ঘণ্টায় আপনি কি করেন? না কি অলস দিন কাটান।
বাকি সময়ে আপনি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ফসল ফলানো, অন্যের দোকানে ধোয়ামোছার কাজ, মেকানিকের দোকানে ফ্রিতে কাজ করা বা শিখা বা ভাড়া করে রিকশা বা টেম্পো চালাতে পারেন। এভাবে কাজ করলে আপনার একদিন কিছু অর্থ চলে আসবে। একটু ভাবুন—আপনি বহু পরিশ্রমের ফলে কিছু টাকা জমা করেছেন, কিন্তু কোথায় বা কীভাবে টাকাগুলো বিনিয়োগ করবেন, তা বুঝতে পারছেন না। এবার ধরুন, আপনি একটি খাবারের দোকান দিতে আগ্রহী, কিন্তু কীভাবে আপনি একটি খাবারের দোকান চালাবেন সে সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নাই। তাই বলে হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। আপনি যদি কোন খাবারের দোকানে যান এবং বলেন, আপনি ফ্রিতে কাজ করতে আগ্রহী, তাহলে তারা অবশ্যই আপনাকে তাদের দোকানে চাকরি করতে দেবে। খাবারের দোকানে কাজ করতে গিয়ে আপনি কীভাবে একটি খাবারের দোকান চালাতে হয়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নিতে পারবেন। আপনি যদি ভালো কাজ করেন, এমন হতে পারে দোকানের মালিক আপনাকে কিছু টাকাও দিতে পারে। এভাবেই আপনি একদিন আপনার স্বপ্নের খাবারে দোকান দিয়ে একজন ব্যবসায়ী হতে পারবেন। কিন্তু সে জন্য আপনাকে পরিশ্রম করতে হবে, অজুহাত নয়। আপনি যত দিন অজুহাত দেবেন, তত দিন দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে আপনার মুক্তি মিলবে না।
এবার ধরুন, আপনার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম এবং ছোটখাটো একটি চাকরি আপনি করেন। এতে অনেক মাস আপনার কোনোমতে চলে যায়, আবার কোন কোন মাসে আপনাকে অর্থাভাবে কষ্ট করতে হয়। যদিও আপনি মাঝে মাঝে অর্থাভাবে কষ্ট করেন, কিন্তু আপনি আপনার চাকরিটা নিয়ে সন্তুষ্ট। আত্মসন্তুষ্টি একটি বড় রোগ, যা আপনার জীবনের উন্নতির পেছনে একটি বড় বাধা হতে পারে। তাই আত্মসন্তুষ্টিতে না ভোগে পাশাপাশি আত্মউন্নয়নে কিছু কাজ করে যান। যত দিন যায় মানুষের শরীর ও মানসিক গঠন যেমনি বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনি প্রতিদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, আপনি আপনার জীবনে উন্নতি করতে আজ কী করেছেন। সে উন্নতি যত ছোট হোক না কেন—কিন্তু আপনাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এতে আপনার জীবনের একঘেয়েমিও দূর হবে ও সাফল্য আসবে। ছোট ছোট জলরাশিতে একদিন সাগর হয়।
আপনি প্রতিদিন আপনার চাকরির পাশাপাশি কিছু না কিছু করে যান, দেখবেন একদিন আপনি অনেক কিছু করতে পারছেন বা অনেক সাফল্য পাচ্ছেন। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। কোন বড় কিছু করার আগে তার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিকল্পনা করুন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সে কাজগুলো করে যান। দেখবেন সাফল্য আপনার আসবেই। পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি—এ কথা সেই ছোট বেলা থেকে আমরা শুনে আসছি। পরিশ্রম করলে কীভাবে জীবনে আর্থিক সাফল্যে পাওয়া যায় তা আগে বলা হয়েছে।
এবার বলি পরিশ্রম করলে জীবনে আর কী কী সুফল পাওয়া যায়। যারা অনেক পরিশ্রম করে, তাদের অলস সময় থাকে না। অলস মস্তিষ্ক যেহেতু শয়তানের কারখানা, সেহেতু পরিশ্রম করলে জীবনে খারাপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। নিজেকে অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখা যায়। আবার যারা বেশি পরিশ্রম করে, তাদের অর্থের অপচয় খুব কম হয়। কারণ তাদের অর্থ ব্যয়ের সময় থাকে খুব কম। সারা দিনের বেশির ভাগ সময় তারা নিজেদের ক্যারিয়ার গঠনে, নিজেকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে আর সংসারের দীনতা দূর করতে পরিশ্রম করে যায়।