করোনা বাধা হতে পারেনি তাঁদের ভালোবাসায়

করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে ভালোবাসার টানে সে বাধা তুচ্ছ। প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে ভালোবাসার টানে সে বাধা তুচ্ছ। প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

‘পরিবারের সঙ্গে কায়রোতে থাকব, নাকি কানাডায় যাব আমার ভালোবাসার কাছে? আমাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে ভ্রমণে বের হওয়া মানে তো আত্মহত্যা বা তার চেয়েও খারাপ কিছু, হত্যার শিকার হওয়া।’

এসব কথা যিনি লিখেছেন, তিনি মিসরীয় বংশোদ্ভূত এক কানাডীয়। নাম ইহাব বোরাইয়ে। আর তাঁর ভালোবাসার মানুষটি ইতালীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। নাম ফ্রানচেসকা ব্রুনদোচিনি।

করোনাভাইরাসে দেখা দেওয়া কোভিড–১৯ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো স্থানই নিরাপদ নয়। নিজেকে গৃহবন্দী করাই সবচেয়ে ভালো পন্থা। এরপরও ভালোবাসা আপনাকে কখনো কখনো মরিয়া করে তোলে। নির্বোধের মতো কাজ করায়। ইহাবের ভাষায় তিনিও এমন প্রেমিকের আচরণই করেছেন। ভালোবাসার মানুষের কাছে যেভাবে হোক, পৌঁছাতে চেয়েছেন। ইহাবের বয়ানেই এখানে তুলে আনা হলো তাঁর মিসর থেকে কানাডায় ভালোবাসার মানুষের কাছে যাওয়ার সেই অভিজ্ঞতার কথা। যা গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে সিএনএনে।

ফ্রানচেসকা কুইবেক সিটির পোস্টডকে কাজ করে। ও শহরে নতুন। তাঁর আশঙ্কা পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আইসোলেশনে থাকার এই সময়ে সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

রোগটি বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার খবরে আমাদের দুজনেরই উপলব্ধি হলো যে এটা কয়েক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলতে পারে। দূরত্ব, অনিশ্চয়তা ও ফ্রানচেসকার ইতালীয় মায়ের ইতালি থেকে বারবার ফোন করে আতঙ্কিত হওয়ার ঘটনায় আমি ওর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কোনো নিশ্চয়তা ছিল না যে আমি কায়রো থেকে ফ্লাইট পাব।

করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে ভালোবাসার টানে সে বাধা তুচ্ছ। প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে ভালোবাসার টানে সে বাধা তুচ্ছ। প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

পেছনে পরিবারকে ফেলে আসার বিষয়টিও আমাকে যাতনা দিচ্ছিল। মা–বাবা দুজনের বয়সই ষাটের ঘরে। তাঁদের নানা স্বাস্থ্য জটিলতা আছে। ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ। এতে তাঁরা ঝুঁকিতেও রয়েছেন। তাঁদের ছেড়ে আসার মানে হচ্ছে, কোনোদিন দেখা না–ও হতে পারে। মা–বাবাও আমাকে ফ্লাইট খুঁজে নিতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। আমার পার্টনার একা কানাডায় আছেন, বিষয়টি তাঁদেরও উদ্বিগ্ন করে তুলছিল। তবে আমরা সবাই একটি চিন্তাই করছিলাম যে টিকিট পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।

মিসর ঘোষণা দিয়েছে, মার্চ থেকে কায়রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে যে টিকিটগুলো বাকি রয়েছে, সেগুলোর দামও হু হু করে বেড়ে গেল। ৭০০ ডলারের টিকিটের দাম হয়ে গেল ৩ হাজার ডলার।

আমি অলৌকিক কিছুর আশায় ইজিপ্ট এয়ারের অপেক্ষমাণ তালিকায় নিজের নাম লেখালাম। আমি ভাবছিলাম, কানাডা সরকার যদি আটকে পড়া কানাডীয়দের নেওয়ার জন্য ফ্লাইট পাঠায়, তাহলেই হয়তো আমি যাওয়ার সুযোগ পাব। অবিশ্বাস্যভাবে বিমানবন্দর বন্ধের কয়েক ঘণ্টা আগে কানাডা যাওয়ার সবশেষ ফ্লাইটে আমার টিকিট নিশ্চিত করে ফোন এল। আমি টিকিট নিতে কায়রোর কোরবায় ইজিপ্ট এয়ারের কার্যালয়ে ছুটে গেলাম।

বাসা থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, তখন চোখে পড়ল অলংকারের একটি দোকান খোলা। এ সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়—এমন জিনিসের দোকান খোলা থাকাটা বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। যেন পুরো বিশ্ব জানে, আজ আমার এই মুহূর্তে এমন একটি জিনিসই দরকার। ঘরে ফেরার সময় খেয়াল করলাম, পথে সেনা মোতায়েন হচ্ছে। তার মানে কারফিউ শুরু হতে যাচ্ছে। আগের কারফিউ স্মৃতির যেই মানে ছিল, তা ভিন্নভাবে যেন দেখা দিল আজ। এ সময়ে এই কারফিউ স্বস্তি দিল যে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে তা সহায়তা করবে।

বিমানবন্দরে গিয়ে দেখলাম লোকজনের উপস্থিতি কম। এটা এক রকমের স্বস্তি দিল যে একজনের সঙ্গে অপরজনের দূরত্ব রক্ষা করা যাবে। ফ্লাইটে বেশির ভাগ যাত্রী মাস্ক পরা ছিলেন। এই সময়ে সর্দি–কাশি রয়েছে, এমন কারও পাশে বসা খুব বাজে একটা অবস্থা সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি নিজেকে তেমন একটি অবস্থায় পেলাম।

একজন ৭২ বছর বয়সী মা ও ৩৮ বছর বয়সী মেয়ের মাঝখানে আমি স্যান্ডউইচ হয়ে বসেছিলাম। ওই মা মাস্ক পরে থাকলেও তাঁর নাক দিয়ে পানি পড়ছিল। তিনি কাশছিলেনও। আর মেয়েটিকে সুরক্ষামূলক কোনো ব্যবস্থা নিতেই দেখলাম না।

করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে ভালোবাসার টানে সে বাধা তুচ্ছ। প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে ভালোবাসার টানে সে বাধা তুচ্ছ। প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

এই সময়ে ভ্রমণঝুঁকি এড়াতে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে সচেতনতা দেখলাম না তাঁর। ফ্লাইটের পুরো সময় ওই মায়ের প্রতিটি কাশি প্রান্তে বসা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে আমি সম্ভাব্য শত্রুর সঙ্গে বসে আছি। আমি ওই মাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি ভালো আছেন কি না। তিনি আমাকে নিশ্চিত করলেন যে ঠিক আছেন। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমার ঠান্ডা লাগে, লক্ষণ দেখা দেয়। তবে তারা আমাকে নিশ্চিত করেছে, এটা নাক দিয়ে পানি পড়া দিয়ে শুরু হয় না, শুকনা কাশি থাকে। তবে কাউকে বলো না। আমি ফিরে যেতে চাই না।’ আমি খুব অবাক হলাম যে তিনি ফ্লাইটের লোকজনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। কারণ, তিনি নিজেকে কানাডায় নিরাপদ ভাবছেন। তবে তিনি বললেন, ‘আমি মনে করি না অটোয়া কায়রোর চেয়ে নিরাপদ। আমি শুধু বাড়িতে থাকতে চাই। আমার মেয়ের সঙ্গে, নাতি–নাতনির সঙ্গে থাকতে চাই।’

আমার এই ভ্রমণের একমাত্র কারণ, আমার ভালোবাসার মানুষটির কাছে যাওয়া। তবে এ ধরনের লক্ষণ থাকলে আমি অবশ্যই ভ্রমণ করতাম না।

আমি যখন টরন্টোয় পৌঁছালাম, তখন আমার প্রত্যাশা ছিল, বিমানবন্দর থাকবে লোকে লোকারণ্য। কারণ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নাগরিকদের দেশে ফেরার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অথচ আমাকে অবাক করে দিয়ে বিমানবন্দরটি কায়রোর মতো প্রায় জনশূন্য ছিল। প্লেন থেকে নামার পর দুই সপ্তাহের আইসোলেশনে থাকার বিষয়টি কর্তৃপক্ষ মনে করিয়ে দিলেন। পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য বিমানবন্দরে আমাকে সাত ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো। একজন নিরাপত্তাকর্মী বললেন, ‘ সার্সের সময়েও আমার ডিউটি ছিল। কিন্তু বিমানবন্দর এমন শূন্য পড়ে থাকতে দেখিনি।’

কুইবেক সিটিতে যাওয়ার ফ্লাইটটির অর্ধেকই খালি ছিল। তাই বেশির ভাগ যাত্রী একটি সারিতে একাই বসেছিলেন। পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কায়রো থেকে টরন্টো, কুইবেক সিটি আমাকে ন্যূনতম পরীক্ষাও করা হলো না। অথচ কোভিড–১৯–এ ওই সময় বিশ্বজুড়ে ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে ভালোবাসার টানে সে বাধা তুচ্ছ। প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
করোনা রুখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে ভালোবাসার টানে সে বাধা তুচ্ছ। প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

আমার বান্ধবী ফ্রানচেসকা যখন এল, আমি তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। সে পুরো হতভম্ব। ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ের আগ পর্যন্ত সে জানত না আমাকে আর সে দেখতে পাবে, সেখানে আমি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব সেটা তার চিন্তাতেও আসেনি। সে আমার প্রস্তাব গ্রহণ করল। আমরা একে অপরের মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে চুমু খেয়ে প্রস্তাবটিকে আনুষ্ঠানিকতায় রূপ দিলাম। আমি খুব স্বস্তি বোধ করছিলাম এই ভেবে যে সে আমার বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলেছে। এত ঝুঁকি নিয়ে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া সার্থক হলো। আমি কল্পনাও করতে পারছিলাম না যদি সে না করে দেয়, তাহলে কী হবে। আমার তো মিসরে ফিরে যাওয়াই এখন সম্ভব নয়।

আমার প্রেমিকা আমার আংটি পছন্দ করল, আঙুলে পরল। কিন্তু আমরা দুজনই জানতাম, যে চুমু খেয়ে আমরা আমাদের সিদ্ধান্তকে আনুষ্ঠানিক করেছি, তাতে আমার যদি উপসর্গ থাকে, সে সেটির সংস্পর্শে এসেছে। তবে আশা ছিল, আমি ভাইরাসটিতে আক্রান্ত নই। ইতালিতে থাকা তার পরিবার ও বন্ধুরা যখন আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানলেন, তাঁরা অভিনন্দনের জোয়ারে আমাদের ভাসিয়ে তুললেন। তাঁরা বললেন, গত এক মাসে এই একটিই ভালো খবর পেয়েছেন।

এই সংকট কেটে যাওয়ার পর ইতালিতে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইহাব ও ফ্রানচেসকা। এ দুজনের গল্প প্রমাণ করে করোনাভাইরাস তার নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে যতই পৃথিবীকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করুক না কেন, পৃথিবীর মানুষ ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসা দিয়ে তারা জয়ী হয় যেকোনো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে।

লেখায় ইহাব এটা জানাতে ভোলেননি যে তিনি আর ফ্রানচেসকা এখন দুই সপ্তাহের কোয়ারেন্টিনে আছেন।