একাত্তরের স্মৃতিতে ফেরা

১৯৭১ সালের বর্ষাকাল, অথই পানিতে সয়লাব। সারা দেশে তুমুল উত্তেজনা। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে গ্রামে হামলা শুরু করেছে। নৃশংস অত্যাচারের কথা শুনে আমার মা খুবই ভয় পেলেন। একদিন আমাকে বললেন, যে দিকে পারো চলে গিয়ে জালিমদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা কর। আল্লাহ সহায়।

মায়ের কথায় খুবই খুশি হলাম, সময় মতো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে না পারার বেদনা নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করত প্রতিনিয়ত। তাই হয়তো অনেকটা অজানা তাগিদেই মনে মনে প্রস্তুতি নিতাম যুদ্ধে যাওয়ার। একদিন প্রতীক্ষার অবসান হলো। লোক মারফত খবর পেলাম, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ভালাট যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক করে রেখেছে আমার এক খালাতো ভাই। সুতরাং আমাকে সময় মতো প্রস্তুতি নিতে হবে। সময় মতো পৌঁছে গেলাম তাদের বাড়িতে।

একটা ছৈওয়ালা নৌকায দুই মাঝি আর আমরা চারজন। কাকডাকা ভোরে রওনা হলাম। আমাদের সাথি একজন মৎস্যজীবী, তিনি যাবেন স্থানীয় এমপির সঙ্গে দেখা করে জলমহালের ইজারা আনতে। দ্বিতীয় ব্যক্তি নুরুল্লা ভাই, তিনি ইউনিয়ন পরিষদের হ্যাটট্রিক করা সদস্য এবং গ্রাম্য সালিসের একজন মান্য ব্যক্তি। উনি ছাড়া ইউনিয়নের কোনো কার্যক্রমই সমাধান হয় না, তাই তিনি সর্বদাই ব্যস্ত। সীমান্তের ওপারে যাওয়াও ওনার ব্যস্ততারই অংশ, নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ। নুরুল্লা ভাই আলাপচারিতায় খুবই পটু। কিন্তু ওনার কথাগুলো একটু ধৈর্য নিয়ে হজম করতে হয়, উনি যখন কথা বলতে শুরু করতেন, মনে হতো যেন খাবার কিছু মুখে নিয়ে জাবর কাটছেন, কারণ নুরুল্লা ভাইয়ের ভীষণ রকমের তোতলামোর বাতিক ছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনা ছিল না, উনি বিশ্বাস করতেন দেশ তো স্বাধীন হবেই। তাঁর একান্ত ভাবনা ছিল, আগামী নির্বাচনে কে কে এমপি হওয়ার নমিউসন (নমিনেশন) পাবেন, কথার মারপ্যাঁচে নমিনেশন হয়ে যেত নমিউসন।

একেতো মনে দারুণ উৎকণ্ঠা, তার ওপরে নুরুল্লা ভাইয়ের কথা বলার ধরন শুনে ভীষণ হাসি পেত। সেই হাসিকে সংবরণ করতে হতো অতি কৌশলে। জ্যেষ্ঠের ভরা বর্ষায় হাওরে ভরা যৌবন। নৌকার পালে ভীষণ তেজি হাওয়া মনে হচ্ছে, একদিনের রাস্তা একদণ্ড সময়েই পারি দেওয়া সম্ভব। মাঝি একজন, একহাতে বইঠা অন্য হাতে হুঁকা টানছে বেশ আয়েশ করে, আরেকজন রান্না চাপিয়েছে ব্যতিক্রমী চুলায়, (কেরোসিনের টিন কেটে তৈরি করা হয়েছে ভ্রাম্যমাণ চুলা)। বাঁশের কঞ্চিকে ছোট্ট করে কেটে জ্বালানি তৈরি করা হয়েছে। তাতে যে আগুন উৎপন্ন হয়, ডাল ভাত কিংবা মাছ রান্না করা যায় অনায়াসে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম প্রথম গন্তব্যে। দিরাই থানার (উপজেলা) ভাটিপাড়া হাইস্কুলে, এখানে ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, প্রায় এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার আমাদের কাসেম মামা, উদ্দেশ্য হলো কমান্ডারের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাকি রাস্তা পাড়ি দেওয়া। যাতে হাওর এলাকায় টহলদারি মুক্তিযোদ্ধা আমাদেরে সন্দেহ না করে। কমান্ডার সাহেব আমাদের উদ্বেগের কথা জেনে ছাড়পত্র লিখে দিলেন। অনেক ধরনের আধুনিক অস্ত্রের সমাহার দেখে আমি ভীষণ কৌতূহলী হলাম, কিছু জানার আগ্রহ দেখালাম, কমান্ডার সাহেব সংক্ষেপে কিছু দূরপাল্লার অস্ত্রের বর্ণনা দিলেন। হ্যান্ডগ্রেনেড যে ৩০৩ রাইফেল ব্যবহার করেও অনেক দূরে নিক্ষেপ করা যায়, তাও জানা গেল। ওখান থেকে এখন আমাদের গন্তব্যে যাত্রার পালা।

মাঝি আবার নৌকায় পাল খাঁটাল, পালের রশিটা টান টান করে বেঁধে দিল নৌকার পেছনের গোড়ার সঙ্গে। ইতিমধ্যে আকাশে মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা চলছে। ইতিমধ্যে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল মাঝি সবার জন্য খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হলো। ডাল তার সঙ্গে ডিম দিয়ে হালকা খাবার। সবাই খেতে মনোযোগী হলাম। হঠাৎ ঈশান কোনে কাকের ডিমের রঙ্গ ধারণ করে আকাশে মেঘ দেখা দিল, মুহূর্তেই প্রচণ্ড বেগে ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ঢেউয়ের দাপটে পাল তোলা নৌকা তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তড়িঘড়ি করে অভিজ্ঞ মাঝি পালের রশি খুলে দিতেই নৌকা দোল খেতে খেতে মনে হলো এবার বুঝি মুহূর্তের জন্য বিপদটা কেটে গেছে, কিন্তু না পর মুহূর্তেই বিরাট এক ঢেউ এসে নৌকার পাঁচাগলুই এ আঘাত করে ছৈয়ের ভেতর দিয়ে একদম সামনে চলে গেল।

আমরা সবাই আল্লাহর নাম নিতে নিতে ভয়ে জ্ঞান হারাবার উপক্রম, হঠাৎ ভাতের প্লেটে চোখ যেতেই দেখি ডাল দিয়ে ডিম ভাত লাপাত্তা। প্লেট এক দম পরিষ্কার। তারপর পরিস্থিতি কিছু শান্ত হতে লাগল। ইতিমধ্যে আমরা একটি গ্রামের পাশে চলে এসেছি, তখন দিন গড়িয়ে বিকেল। সূর্যের লাল আভা দিনের সমাপ্তি জানান দিল। একটু পরেই হাওর পারের গ্রামের ঘরে ঘরে সন্ধ্যাবাতি জ্বলবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রামের পাশেই নৌকা বেঁধে রাত্রিযাপন করার। জেলেরা হাওরে মাছ ধরা শেষে বাড়ি ফিরছে।

এক জেলেনৌকা থেকে জেতা মাছ নিয়ে রাতে খাবারের আয়োজন করা হলো। পুরো দিন ক্ষুধার্ত থেকে অনেক আয়েশ করে রাতের খাবার খেলাম। আমরা সবাই নৌকায় বসে বসেই ক্লান্ত হয়ে একসময় শুয়ে পড়লাম। ভোরে আবার হাওর পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি। কত নাম না জানা হাওর বর্ষার পানিতে একাকার হয়ে বিশাল সাগরের রূপ ধারণ করেছে। শনির হাওরের নাম জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি। শনির হাওর পাড়ি দিতে হবে মনে হতেই গা ছমছম ভাব। শনির হাওরের এক কোনা পেরিয়ে যখন আমাদের নৌকাখানা খরচার হাওরে প্রবেশ করে, তখন মনে দারুণ আশার উদ্রেক হলো, কারণ খরচার হাওরের একপাশেই বিশ্বম্ভরপুর, আমার প্রিয় বন্ধু বশিরের বাড়ি।

বন্ধু বশিরের মুখ থেকে খরচার হাওর আর বিশ্বম্ভরপুরের অনেক গল্প শুনেছি, কিন্তু সময় আর সুযোগের গাণিতিক মিল হয়নি, তাই আসা হয়নি। এবার যেন এক মোক্ষম সময় এসে গেল হাতের নাগালে। এখন প্রশ্ন হলো, বশির কি বাড়িতে আছে? না মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে!

এসব ভাবনার মধ্যেই মাঝি বলল, আমরা বাজারে এসে গেছি। অনেক ভেবে চিনতে বিশ্বম্ভরপুর বাজারে নৌকা বাঁধা হলো। তখন সময় বিকেল, মেঘ ভাঙা রৌদ্র এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বাজারের এক চায়ের দোকানে ঢুকে দেখি লোকজন নেই, দোকান একদম ফাঁকা। একটা ছেলে দৌড়ে এসে আমাদেরে বসাল, তারপরই জিজ্ঞেস করে কি খাবেন, রসগোল্লা না লেম্বুসটি। বললাম রসগোল্লা দাও, আর দ্বিতীয়টা কি বুঝলাম না। কিছু না বলেই ছেলেটা চলে গেল রসগোল্লা আনতে, তারপর নিজেই আবিষ্কার করলাম, লেম্বুসটি মানে হয়তো সে লেবুর চাকে বোঝাচ্ছে। সে বাংলিশ বলে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে। যাক, ছেলেটা কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম বন্ধু বশিরের কথা। সঙ্গে সঙ্গেই সে বলল, হাঁ চদরীসাব তো সারাদিন বাজারেই ছিলেন, আপনারা আসার কিছু আগেই বাড়ি গেলেন, তবে তিনার মনটা খুবই খারাপ।

বশিরের মন খারাপের কারণ আমি ওই ছেলের কাছে জানতে চাইনি, শুধু জিজ্ঞেস করি, বশিরকে একটা খবর দিতে পারবে? সে বলল পারবে। আমি আমার নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে তাকে দিয়ে তার ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম। কিছুক্ষণ পরই বন্ধু বশির এসে হাজির, আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলল, চল বাড়ি যাই, আমি তার হাসিতে স্বভাবসুলভ আন্তরিকতা পেয়ে খুবই খুশি হলাম।

পাঁচ/সাত মিনিট হাঁটার দূরত্ব পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম তাদের বাড়িতে। বশিরের আব্বা জবান আলী চৌধুরী সাহেব ছেলের বন্ধু হিসেবে আমাকে আগে থেকেই চিনতেন, তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করা হলো, তার পর চা নাশতা আপ্যায়ন শেষে বশিরকে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। তার কথায় বুঝলাম, এখন আর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া যাবে না। কারণ অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবুও গিয়ে দেখা যাবে।

পরদিন সকালের নাশতা সেরে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। বশিরের নির্দেশনায় কিছু দূর নৌকায় করে সম্ভবত স্থানীয় চিনাকান্দি বাজারে পৌঁছলাম। নৌপথের সমাপ্তি ওখানেই টানতে হলো। তারপর পদযাত্রা, সবাই গল্প করে করে হাঁটতে লাগলাম। বিশ্বম্ভরপুর (বর্তমানে উপজেলা) হাওর বেষ্টিত এলাকা, ওখানের জনজীবন কৃষিনির্ভর। বালু আর এটেল মাটির সংমিশ্রণে পায়ে চলার রাস্তা, কোথাও কিছু রাস্তা ভেঙে মাটি নিংড়ানো পানি জমে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে বশিরের মুখে মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডিত গল্প শুনছি আর মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছি, আমাদের সহপাঠীরা কে–কোথায় আছে। কয়েকজন যুদ্ধে যেতে পেরেছে। বশির মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন লোক ছিল। তাদের এলাকাটা সব সময়ই ছিল মুক্তাঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ যাতায়াত হামেশা লেগে থাকত।

যুদ্ধে না যাওয়ার কারণ হিসেবে বলতে হয়, বশিরের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের একটা অংশের দুর্বলতার কথা। অর্থাৎ সে ছিল একচোখা। কিশোর বয়সে খেলাচ্ছলে অন্য কিশোরের দুষ্টুমির ছলে তার একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায় চিরতরে। চমৎকার ফিগার আর সুন্দর চেহারার মানুষটি ছিল আমার একান্ত সুহৃদ। কিন্তু স্বাধীনতার পুরো সুফল ভোগ করার আগেই না ফেরার দেশে চলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সামনে তাকিয়ে দেখি সবুজ গাছপালাবেষ্টিত বিশাল উঁচু পাহাড় আমাদেরে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এটিই ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে দেশত্যাগী লাখো বাঙালি শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন।

বেলা দুপুর। সবুজ আর নীলিমায় নীলের শোভা উপভোগ করছিলাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গানের কলি মনের অজান্তেই আওরিয়ে চলেছি, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। ভাবছিলাম, সুরমা নদীর তীর থেকে গোধূলি বেলায় উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখতাম পাহাড়ের ঝরনা আর পাহাড় ডিঙিয়ে গাড়িগুলো চলাচল করছে। এই সেই মেঘালয়ের পাহাড়। কিছু সামনে এগোতেই দেখা গেল, বিরাট খালের আকার ধারণ করে প্রবল স্রোতোধারা বহে আসছে সমতলে। এই ঝরনাধারায় পার হয়ে আমাদের যেতে হবে গন্তব্যে। পানির গভীরতা যে বেশি হবে না, তা অনুভব করা যায়। পরনের প্যান্ট যতটুকু সম্ভব টেনে ওঠালাম। আমাদের থেকে ১৫-২০ গজ দূরেই দল বেঁধে কিশোরী যুবতী নারীরা ঝরনার পানিতে গোসল করছে। তাকিয়ে দেখি আমাদের সহপাঠী বেশ কয়েকজন ষোড়শী দিব্যি তাকিয়ে আছে, হয়তো কিছু লজ্জাবোধে ওরা নির্বিকার। মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে স্রোতের গভীরতায় তলিয়ে গেলাম। মনে হল, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। ওই ষোড়শী মেয়েগুলো কখনো শানবাঁধানো ঘাটলা কিংবা বাথরুম ছাড়া এভাবে খোলা জায়গায় গোসল করার প্রশ্নই আসত না, যদি না পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাড়া না করত।

মেঘালয় রাজ্যের এক পাহাড়ি উপত্যকার নাম ভালাট। এখানে অনেক উপজাতির বসতি। পাহাড়ের পাদদেশে বিরাট সমতল ভূমিকে পরিকল্পিত করে গড়ে তোলা হয়েছে শরণার্থী ক্যাম্প। বাঁশের বেড়া আর শালপাতার ছাউনি দিয়ে লম্বা লাইনে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ দিকে একটু এগুলোই চোখে পড়ে মনোরম পাহাড়বেষ্টিত স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী কার্যালয়। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ওখান থেকেই বৃহত্তর সুনামগঞ্জ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড করতেন। টিলা বেয়ে কিছু দূর নিচে নামলেই আরেক শরণার্থী ক্যাম্প। ক্যাম্পের একপাশে ছিল মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং কার্যালয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আসত, তারা প্রথমে এই কার্যালয়ে হাজির হতো, ওখান থেকে বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানো হতো তাদের। আমার এক সুহৃদ সফিকুল চৌধুরী ছিলেন ওই ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর মাঝখানে ছিল স্থানীয় উপজাতীয়দের বাজার। বাজারে চায়ের দোকানগুলো সর্বদাই বাঙালির আড্ডায় মুখরিত থাকত। এমনি এক চায়ের দোকানে দেখা হলো মুক্তিযোদ্ধা তালেব আহমদের সঙ্গে। সুনামগঞ্জ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দুর্দান্ত সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধা পরে শহীদ হন। লাখো মুক্তিযোদ্ধাসহ বাংলার আপামর জনতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বুকের রক্ত ঝরিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল, তারা কি আজ সেই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পেয়েছে? সে সময়ে শত্রুতা ছিল দৃষ্টির গোচরে, কিন্তু আজকের শত্রুরা দৃষ্টির অগোচরে। আজও এ প্রশ্ন তাড়া করে দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে।

চার দিন ভালাটের শরণার্থীদের সান্নিধ্যে থেকে সফর শেষে আমরা আবার চলে আসি চিনাকান্দি বাজারে যেখানে আমাদের মাঝি আর নৌকা রাখা ছিল। এসে দেখি নৌকা বাঁধা আছে, কিন্তু মাঝি দুজন লাপাত্তা। খুঁজতে গিয়ে দেখি, দুজন এক দোকানে বসা কিন্তু তাদের হাত পাঁ বাধা। পাশেই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ঘিরে রেখেছে তাদের। অজানা আশঙ্কায় মুহূর্তেই বিরূপ ভাবনার উদ্রেক হলো। বশিরের মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সামনে এগিয়ে গেলাম পরিস্থিতি আঁচ করতে। গিয়ে দেখি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের একজন আমার পরিচিত। হাই স্কুলে আমার সঙ্গে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। পরে আর এগোতে পারেনি। আমাকে দেখে সেও অপ্রস্তুত হলো মনে হয়েছে। তারপর বলল সন্দেহবশত আটকে রেখেছে। বললাম, যুদ্ধের সময়ে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। মাঝি দুজনকে উদ্ধার করে ফিরে এলাম।