আমার প্রেম, আমার স্বাধীনতা

কলেজে পড়ার সময় আমি একজন বনলতা সেনের প্রেমে পড়েছিলাম। ঠিক প্রেমে পড়েছিলাম বলার চেয়ে আইয়ুব বাচ্চুর গানের মত বলা যায়, ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি/প্রেম আমার ওপরে পড়েছে।’ তখন প্রেমে পড়লে নদীর ধারে বা পুকুর পাড়ে সবুজ ঘাসের ওপর বসে চিনাবাদাম ভাঙার রেওয়াজ ছিল। আমরাও কলেজের পুকুর পাড়ে বসে কিছুদিন বাদাম ভেঙেছি। এ রকম একদিন পড়ন্ত বিকেলে চিনাবাদাম ভাঙতে ভাঙতে বললাম, আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য আজ রিহার্সাল আছে। আমাকে একটু উঠতে হবে।

বনলতা সেন পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে বলল, যুদ্ধের পর দেশ তো স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। ২৬ মার্চ কেন স্বাধীনতা দিবস? প্রেমে পড়লে প্রেমিকার বোকা বোকা প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরে নিজেকে বেশ হিরো হিরো মনে হয়। বললাম, বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পরে অর্থাৎ ২৬ মার্চের শুরুতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে কারণে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস।

বনলতা সেন এবার কাকের বাসার মত চোখ করে বলল, ‘যুদ্ধে আমরা জিতব কী হারব তার কোন ঠিক নেই, হঠাৎ করে একজন ঘোষণা দিয়ে দিল আর সেই দিন আমাদের স্বাধীনতা দিবস হয়ে গেল! হাও ফানি।

অন্য কোন বন্ধু–বান্ধব এমন কথা বললে আমার মাথায় আগুন ধরে যেত। অথচ প্রেমিকা অন্য জিনিস। মনে হল, আমার মাথায় কেউ ঠান্ডা নিদ্রা কুসুম তেল ঢেলে দিয়েছে। বনলতা সেনের কথা শুনে শুধু দুটি বাদামের কুচি গলার ভেতরে আঁটকে গেল।

একটা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললাম, ‘আমাদের স্বাধীনতা যে কেউ একদিন হঠাৎ করে ঘোষণা দিয়ে দিল আর আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম এমন নয়। দীর্ঘ দিনের আন্দোলন সংগ্রাম আর ত্যাগ–তিতিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সালে ভারত–পাকিস্তান ভাগ হওয়ার কিছুদিন পরেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের তাদের ইচ্ছামত শাসন করতে চায়। আমরা বাঙালিরা আমাদের ভাষা–সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি আগ্রাসন আর শোষণের স্বীকার হয়েছি। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালে আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে।’

বনলতাকে বলে চললাম, ‘১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলন করতে হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার স্বীকার হতে হয়েছে। ১৯৬৯ সালে গণ–অভ্যুত্থানের মত ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও আমাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়নি। আর এই দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতে আন্দোলন এমন এক রূপ লাভ করল, যে স্বাধীনতার আন্দোলন ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে তার ওপর চাপ বাড়তে থাকল স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার। আন্দোলনের এই পর্যায়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা ওড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশের নতুন জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হচ্ছে। দেশ তখন উত্তাল। দেশের সব মানুষ তখন উন্মুখ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য। সবাই আশা করেছিল, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন, কিন্তু তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য দিক নির্দেশন দিলেন।’

আমি প্রেমিকাকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু বললেন, যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক... ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে পাকিস্তান সরকার তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনকেই ভন্ডুল করে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এদিকে বঙ্গবন্ধু আলোচনার মাধ্যমে যখন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছিলেন, তখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য আর অস্ত্র সমাবেশ করছিল।

আমি বলেই চললাম, ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন পাকিস্তান বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে গণহত্যা চালাতে থাকে, তখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার সিদ্ধান্তে নেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটকের আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি তারবার্তা পাঠান, যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

পরে ২৬ মার্চ দিনে চট্টগ্রামের একটি বেতারকেন্দ্র থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান প্রথমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন এবং পরদিন ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

এরপর তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন। তারা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলা, মানে এখন যার নাম হয়েছে মুজিবনগর সেখানে ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়।

এই দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করার পর বুঝতে পারলাম, বনলতা সেন মহাবিরক্ত। তারপরও আমার কথাগুলো তার জানা দরকার। তাই বললাম, এবার একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে ওই দিন থেকেই বাংলাদেশ হয়ে গেল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আর বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানিরা হয়ে গেল বহিরাগত শত্রু। আমরা যুদ্ধ করেছি বহিরাগত শত্রুর বিরুদ্ধে। আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে অন্যান্য দেশের সাহায্য–সহযোগিতা পেয়েছি বাংলাদেশের পক্ষে। যুদ্ধকালেই নেপাল ও ভারতের মত পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছি। আমরা যদি স্বাধীনতা ঘোষণা না করতাম, তাহলে পাকিস্তানে আমাদের পরিচয় হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। সে ক্ষেত্রে আমরা অন্যদের সহযোগিতা পেতাম না। সবাই বলত, এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এমনকি যুদ্ধের একপর্যায়ে যখন তারা বুঝতে পারত, তারা জিততে পারবে না তখন নিজ দেশের বিদ্রোহীদের সঙ্গে মানে আমাদের সঙ্গে একটা মীমাংসা করে নিত। সে ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না।

বনলতা সেন আমার সব যুক্তি শোনার পর শুধু কাকের নীড়ের মত চোখ তুলে নয়, কাকের মত কর্কশ গলাতেই জিজ্ঞাসা করল, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কি কোন দেশের নজির আছে যারা আগাম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পরে স্বাধীনতা পেয়েছে।

আমি হেসে বললাম, বিদেশের যেকোনো বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে তো তোমরা আমেরিকার নাম শুনতেই বেশি পছন্দ কর। এ ক্ষেত্রেও আমরা আমেরিকান বিপ্লবের উদাহরণ দিতে পারি। তাদেরও সব প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সংলাপ ব্যর্থ হলে ১৩টি কলোনির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ৪ জুলাই ১৭৭৬ স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যদিও প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করেছে এরও সাত বছর পর।

প্রেমিকার সঙ্গে এ ধরনের দীর্ঘ ইতিহাস চর্চার ফল হিসেবে, সারা দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; ...ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার।

মুখোমুখি বসার জন্য কোন বনলতা সেন থাকার কথা নয়, থাকেও না। এর নামও স্বাধীনতা। আমার স্বাধীনতা।

(পুনশ্চ: বনলতা সেন এখন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ)