নানাবাড়ির খবরে মন ভালো নেই

করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী থাবায় লন্ডভন্ড সব। বিশ্বের শক্তিশালী দেশ আমেরিকার অন্যতম প্রধান নগর নিউইয়র্কের বাংলাদেশি অভিবাসীরা নির্বাক, স্তব্ধ। উৎকণ্ঠা পৌঁছে গেছে চরম বিষাদ ও ভয়ের শেষ ধাপে। কেউই ভালো নেই। বাংলাদেশের নানা অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসীরা করোনাভাইরাসের প্রকোপে পর্যুদস্ত-অসহায়। ভালো নেই বৃহত্তর সিলেট জেলার নানা প্রান্তের জানা অজানা অনেকে। প্রচণ্ড উদ্বেগ নিয়ে দেখছি নিউইয়র্কে ভালো নেই আমার নানা বাড়ি গোলাপগঞ্জের চেনা স্বজনেরা।

গত ২৯ মার্চ চলে গেলেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার রনকেলী গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ইসমত চৌধুরী, যিনি আমার স্ত্রীর আপন মামাতো ভাই। অভাবনীয় ও দুর্লভ মেধার অধিকারী ছিলেন তিনি। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত কৃষিভিত্তিক শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি মেরামতে দক্ষ প্রকৌশলী মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর দ্বিতীয় ছেলে ইসমত চৌধুরীর নিউইয়র্কে বাস ৩০ বছরের অধিককাল। দুই ছেলের জনক ইসমত চৌধুরী এ দেশে এসে জীবিকা নির্বাহের জন্য শুরু করলেন গাড়ির ওয়ার্কশপের ব্যবসা। ফ্রেশ মেডোতে নিজ মালিকানাধীন অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে গত ২৪ মার্চ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর আগে কোভিড-১৯-এর উপসর্গ স্ত্রীর শরীরে দেখা দিলে স্থানীয় আর্জেন্ট কেয়ারের চিকিৎসা নেন। সে চিকিৎসায় তাঁর স্ত্রী সুস্থ হয়ে যান। ইসমত চৌধুরী ওই দিন রাতেই শরীরে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে ফ্লাশিং হাসপাতালে ভর্তি হন। ক্রমান্বয়ে তিন দিন চিকিৎসার পর গত ২৮ মার্চ বাসায় ফোন করে ছেলেদের হাসপাতালে যেতে নিষেধ করেন। এরপর আর নিজে থেকে যোগাযোগ করার সুযোগ পাননি বলে স্বজনেরা জানান।

মরহুমের এক আত্মীয়ের সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ মার্চ বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৫টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরহুমের ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে ফোন করে জানায়, ‘পেশেন্ট ইজ নট রেসপন্ডিং’, যা ছিল মরহুমের মৃত্যু সংবাদ। পরপরই নিউইয়র্ক শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব স্বজনের মধ্যে খবরটি জানাজানি হয়ে যায়। রাতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, মরহুমের লাশ দাফনের জন্য গৃহীত নানা পদক্ষেপ।

মরহুমের বড় বোনের ছেলে নিউইয়র্কের পরিচিত মুখ ও ব্যবসায়ী আসিফ চৌধুরী জানান, গত ৩১ মার্চ রাতে ধর্মীয় আচার পালনের জন্য অজ্ঞাত এক ফিউনারেল হোমে পাঠানো হয়। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা সেরে ১ এপ্রিল বেলা দেড়টায় মরহুমের বড় ছেলে ইমতিয়াজ চৌধুরী ও ছোট ভাই কামাল চৌধুরীর উপস্থিতিতে লং আইল্যান্ড ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালে বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা হয় তাঁর মরদেহ। দাফনের আগে সীমিত স্বজনের উপস্থিতিতে জানাজার নামাজ আদায় করা হয়।

গত ৩০ শে মার্চ সন্ধ্যায় চলে গেলেন ৩০ বছরের গৃহবধূ গোলাপগঞ্জের লক্ষ্মীপাশা গ্রামের নিশাত আফসা চৌধুরী, যিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন কুইন্স হাসপাতালে। নিউইয়র্কে বিশাল এক অভিবাসী পরিবারের সদস্য ছিলেন নিশাত। মাত্র দু বছর আগে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। সুদর্শন স্বামীটি কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে সম্প্রতি এসেছিলেন। জীবন সাজানোর এ গল্প থেমে গেল বড় অবেলায়! কী নিদারুণ আর মর্মান্তিক! স্বামীসহ সব স্বজন আজ বাক্যহারা। সর্দি ও কাশির উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন নিশাত। এ হাসপাতাল যাত্রাই যে শেষ যাত্রা হবে, তা স্বজনেরা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি।

গত ৩১ মার্চ গোলাপগঞ্জের আরেক নারীর প্রস্থান ঘটেছে নিউইয়র্কে। ৪৫ বছর বয়সী ওই নারীর নাম নুসরাত মজুমদার। এক মেয়ের মা নুসরাত বেড়ে উঠেছিলেন সিলেটের কাষ্ঠঘর এলাকায়। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে পরিচিত সাদত মজুমদারের স্ত্রী তিনি। এ দম্পতিকে কমিউনিটির নানা অনুষ্ঠানে দেখা যেত সব সময়। আর দেখা যাবে না। নুসরাতের বাল্যবন্ধু প্রবাসী ফ্লোরা চৌধুরী বললেন, ‘স্বামীর স্বাস্থ্য নিয়ে নুসরাতের উদ্বেগ ছিল সব সময়। ভয়াল করোনাভাইরাসে সে নিজেই চলে গেল, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে!’

গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বর গ্রামের মরহুম মইন উদ্দিন চৌধুরীর সন্তান নুসরাত মজুমদার। শ্বাসকষ্টজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা থাকায় সপ্তাহখানেক ধরে কাজে না গিয়ে বাসায় অবস্থান করছিলেন। গত ২৯ মার্চ অসুস্থ বোধ করলে স্বামী শাহাদত মজুমদারকে নিয়ে ম্যানহাটনের বেলভিউ হাসপাতালে যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নুসরাত চৌধুরীকে বিশদ পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিয়ে যায়। স্বামী বাসায় ফিরে আসার আগেই হাসপাতাল থেকে জানতে পারেন স্ত্রীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় দ্রুত ভেন্টিলেটরের সহায়তা নেওয়া হয়। ৩০ মার্চ বিকেলে পরিবারকে জানানো হয়, চিকিৎসক ও নার্সদের পরিচর্যায় নুসরাতের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস পরদিনই আকস্মিকভাবে কর্তৃপক্ষের করা ফোনকলে পরিবার জানতে পারে, করোনাভাইরাসের ছোবলে একটি পরিবারের সব সুখ, আশা ও স্বপ্নের অবসান ঘটেছে।

নিউইয়র্কে প্রবাসীবহুল সিলেট অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে আমার নানাবাড়ি গোলাপগঞ্জের লোকজন সব সময় ব্যতিক্রম। বিনয় আর ভালোবাসায় নিজেদের বনেদি মনে করা আমার স্বজনেরা ভালো নেই। এক সপ্তাহে অন্তত চারজনকে হারিয়েছেন তাঁরা। ঘুরে ফিরে এসব লোকজন পরস্পরের আত্মীয়, নিকটাত্মীয়! শোকের নগরীতে একদম মন খারাপ আমার এসব স্বজনদের। মন খারাপ আমার, আমাদের সবার!