যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীদের জন্য খোলা হয়েছে হটলাইন

প্রবাসীবহুল জ্যাকসন হাইটসের জনমানবহীন ডাইভার্সিটি প্লাজা। ছবি: শিরিল হাসান
প্রবাসীবহুল জ্যাকসন হাইটসের জনমানবহীন ডাইভার্সিটি প্লাজা। ছবি: শিরিল হাসান

করোনাভাইরাসের কবলে নিউইয়র্কের নাগরিকদের লকডাউনের টানা ১১ দিন চলে গেছে। ১ এপ্রিল বুধবার গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো রাজ্যে প্রায় দুই হাজার মৃত্যুর কথা জানিয়েছেন। নিউইয়র্ক নগরীতে বাংলাদেশি প্রবাসীরা এর মধ্যেই ৪২ জনের নিশ্চিত মৃত্যুর খবর পেয়েছেন। এ ৪২ জনের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বার্ধক্যের কারণে। এর বাইরেও মৃত্যুর খবর আসছে। নিশ্চিত না হয়ে আমরা বাংলাদেশিদের মৃত্যুর সংখ্যা প্রচার করা থেকে বিরত আছি; যদিও এ সংখ্যা ঘন ঘন পরিবর্তন হচ্ছে।

নিউইয়র্কে কোনো মৃত্যুকেই এখন আর স্বাভাবিক মৃত্যু বলে এখন মেনে নেওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে। নগরীর হাসপাতালগুলোর বাস্তব অবস্থাও করুণ। রাজ্য গভর্নর আশাবাদের কথা বলেছেন। আশঙ্কার কথাও বলেছেন। আশাবাদের কথা হচ্ছে, এপ্রিলের মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব অনেকটাই কমে আসবে বলে তিনি আশা করছেন। উদ্বেগের কথা হচ্ছে, নিউইয়র্কে ১৬ হাজার নাগরিকের মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন রাজ্য গভর্নর। করোনার প্রাদুর্ভাব পুরো গ্রীষ্মকালেই চলবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

কর্মহীন লোকজনকে দ্রুত বেকার ভাতার জন্য আবেদন করা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মেডেলিয়ান মালিক, উবার চালকসহ সব স্বেচ্ছা কর্মজীবীকেও সরকারি সহযোগিতার জন্য দ্রুত আবেদন করতে হবে। বাড়ির মর্টগেজের বিলম্ব পরিশোধের জন্য মর্টগেজ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। বাড়িভাড়া মওকুফ হয়নি। অবশ্যই বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে সময় চেয়ে নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

নাগরিক সহযোগিতার অর্থ আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই আসতে শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব অর্থ এলে বাড়িভাড়া শোধ করার পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক বিষয়ে ভুয়া সংবাদের পেছনের না ছুটে অবশ্যই কমিউনিটির পরিচিত সিপিএ, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আইনজীবী বা বিমা এজেন্টদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। সবাই টেলিফোনেই এসব পরামর্শ ও সহযোগিতা দিচ্ছেন। এসবের ফাঁকে নানা ধরনের জালিয়াত চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। করোনার ত্রাণ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ই-মেইলে বা ফোনে ফাঁদ পাতা শুরু হয়ে গেছে। এসব থেকে চরম সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা (বামনা) টেক্সাস চ্যাপটার অন্য পেশাজীবী সংগঠকদের নিয়ে আমেরিকায় থাকা বাংলাদেশিদের জন্য সার্বক্ষণিক হটলাইন চালু করেছে। যেকোনো স্থান থেকে ২১৪-৪৪৬-৮৮৯০ নম্বরে যেকোনো সময়ে ফোন করা যাবে। ডাক্তার এবং স্বেচ্ছাসেবীরা পুরো আমেরিকায় যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো সাহায্যে সাড়া দেবেন বলে জানানো হয়েছে। টেক্সাস থেকে প্রযুক্তি পেশাজীবী জন চৌধুরী প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

নিউইয়র্ক, নিউজার্সিসহ মেট্রো এলাকা থেকে বেশ কিছু মৃত্যুর সংবাদ এসেছে গতকাল বুধবার। করোনাভাইরাসের কারণে সবার মৃত্যু হয়েছে, এ কথা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। হাসপাতালগুলো নাজুক অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও সবকিছু ভেঙে পড়েছে। নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন ভিন্ন। কোনো কোনোটি নগর পরিচালিত। অন্যগুলো প্রাইভেট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। এসব হাসপাতালের সব চিকিৎসাই প্রযুক্তিনির্ভর। করোনা প্রাদুর্ভাবে সব হাসপাতালেই অন্য রোগীদের এখন প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। নিয়মিত সার্জারি বন্ধ। হাসপাতালগুলোয় তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

ম্যানহাটানের জলাধারে এক হাজার বেডের ন্যাভেল শিপ হাসপাতালে করোনা নয়, এমন রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে প্রসূতিদের। নিউইয়র্কের একমাত্র জ্যামাইকা হাসপাতালেই দিনে গড়ে ৩০টি প্রসূতির আগমন ঘটে স্বাভাবিক সময়ে। এখন অধিকাংশ হাসপাতাল থেকে এসব জরুরি চিকিৎসাপ্রত্যাশীকে স্থানান্তর করা হচ্ছে ন্যাভেল হাসপাতালে। রোগী স্থানান্তরের জন্য হাসপাতাল থেকে হেলিকপ্টার চাওয়া হচ্ছে। সব হাসপাতালকে দ্রুত প্রযুক্তির নেটওয়ার্কে আনা, হাসপাতালের সঙ্গে ব্লাডব্যাংকসহ অন্যান্য লজিস্টিকের সমন্বয় করার দুরূহ প্রয়াসের কথা জানা গেছে এ খাতে কাজ করা বাংলাদেশি লোকজনের কাছ থেকে।

নিউইয়র্কে প্রবাসীদের পরিচিত ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, টেস্টিং কিটের অভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বাড়িতে বসে সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অসংখ্য লোক টেস্ট করাতে না পেরে দিনের পর দিন বাড়িতে বসে থেকেছেন। এর ফলে সংক্রমণ পুরো কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে।

ডা. খন্দকার আশঙ্কা করে বলেছেন, ‘নিউইয়র্কের ৭০ শতাংশ লোকই মনে হচ্ছে সংক্রমিত হয়ে গেছে। এলমহার্স্ট হাসপাতালে নিজের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, সেখানে এখন যত রোগী ভর্তি আছে, তার ৯৫ শতাংশই হচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। প্রচুর রোগী মারা যাচ্ছে সেখানে। হাসপাতালটির চারপাশে প্রায় ১০ মাইল ব্যাসার্ধের এলাকার অধিকাংশই অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। বেশির ভাগ অভিবাসী সম্প্রদায়ের। তাদের জীবনযাপন বা চলাফেরা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

ডাক্তার খন্দকার বলেছেন, ‘বাংলাদেশি ডাক্তার আমরা যারা আছি, তাদের ৯০ ভাগ ইতিমধ্যেই সংক্রমিত হয়েছে। বাংলাদেশি ডাক্তারদের অনেকেই এখন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন। কেউ কেউ চিকিৎসা নিচ্ছেন।’

করোনা মোকাবিলায় নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি নিতে বিলম্বের কারণেই আজ এ মাশুল দিতে হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব অনেক আগে থেকেই চালু করলে, টেস্টিং কিট আগে থেকেই পর্যাপ্ত প্রস্তুত রাখলে এ অবস্থা এড়ানো সম্ভব হতো। নিউজার্সিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়েস্ট ডায়াগনস্টিক ল্যাবে ১ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার নমুনা পরীক্ষার অপেক্ষায় পড়ে আছে।

নিউইয়র্কের কলম্বিয়া প্রেসপেরিটিয়ান হাসপাতালের ডাক্তার ক্রেইগ স্পেন্সার। ইবোলা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজে বেঁচেছিলেন। ক্রেইগ বলেছেন, ‘আগাম প্রস্তুতি না থাকার কারণেই আমেরিকায় এত মানুষ করোনাভাইরাসে মারা যাচ্ছে। নিউইয়র্ক জনমানবহীন দেখা যাচ্ছে ঠিকই। তবে হাসপাতাল খুবই কোলাহলের। এ কোলাহল খুবই বেদনার।’

মেয়র ডি ব্লাজিও অবসরে যাওয়া সাবেক পুলিশ কমিশনার জেমস অনিলকে নগরীর কোভিড-১৯ বিষয়ে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। বুধবার কাজে নেমেই জেমস অনিল বলেছেন, প্রতিটি হাসপাতালে পর্যাপ্ত সরবরাহ, জনবল ও ব্যবস্থাপনাকে জোর দিতে তাঁরা কাজে ঝাঁপ দিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এ মহামারি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেসের পরিচালক অ্যান্থনি এস ফাউসি। কে বা কারা তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে বলে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রধান প্রধান মার্কিন সংবাদমাধ্যম এ সংবাদ প্রকাশ করেছে।

জ্যাকসন হাইটসের ফাঁকা রাজপথ। ছবি: শিরিল হাসান
জ্যাকসন হাইটসের ফাঁকা রাজপথ। ছবি: শিরিল হাসান

নিউইয়র্কে বহু স্বাভাবিক রোগী তাদের নিয়মিত ডাক্তারকেও ধরতে পাচ্ছেন না। যারা নিয়মিত প্রেসক্রিপশন ড্রাগের ওপর নির্ভরশীল তাঁরা ফোনে চেষ্টা করছেন যোগাযোগ করত। অনেকে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে অনন্যোপায় হয়ে আমাদের কাছে ফোন করে সাহায্য চেয়েছেন। নিউইয়র্কের ৩১১ নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাওয়ার জন্য প্রথম পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। নগরীতে ৩১১ সার্ভিস বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনে বাংলায়ও কথা বলা যাচ্ছে।

এ ছাড়া নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিস থেকে বাংলাদেশি ডাক্তারদের একটি তালিকা দিয়ে প্রয়োজনে ফোন করার কথা বলা হয়েছে। কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুন্নেছা জরুরি প্রয়োজনে নিম্নলিখিত চিকিৎসকদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে বা ই-মেইলে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

১. প্রীতম দাস, এমডি
বোর্ড-সার্টিফায়েড ইন ফ্যামিলি মেডিসিন নিউইয়র্ক কমপ্রিহেনসিভ কার্ডিওলজি, পিএলএলসি
৯৫, উইকফ অ্যাভিনিউ, ব্রুকলিন, এনওয়াই ১১২৩৭, ফোন: ৯২৯-৩২১-২৬৪৫

২. ফেরদৌস খন্দকার, এমডি এফএসিপি
ইন্টারনাল মেডিসিন অ্যান্ড জেরিয়াট্রিকস
ই-মেইল: drkhandker@drferdous. com; ফোন: ৭১৮-৫৬৫-৫৬০০

৩. মোহাম্মদ আলম, এমডি
ই-মেইল: dr. tuku@yahoo. com; ফোন: ৬৩১-৭৪২-৯০৮১

৪. মোহাম্মদ ইউসুফ আল মামুন, এমডি
ই-মেইল: mamonny1 @gmail. com

৫. মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান, এমডি
ই-মেইল: mzrahman@gmail. com; ফোন: ৫১৬-৪৫৫-৪৪২৭ (বিকেল ৪টার পর যোগাযোগ করতে হবে)

৬. মাকসুদ চৌধুরী, এমডি
ই-মেইল: Mchowdhury 55 @gmail. com; ফোন: ৯১৭-৩০৪-৫৯৩৪

৭. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, এমডি
ই-মেইল: ziauddin. philadelphia@gmail. com; ফোন: ৬১০-২০৩-৯৬৯৫

৮. বর্ণালি হাসান, এমডি
অ্যাটেনডিং ফিজিশিয়ান, লং আইল্যান্ড জিউইশ নরওয়েল হাসপাতাল
ফোন: ৯১৭-৯৩০-১১৭০

ওপরের নম্বরগুলোয় যোগাযোগে কোনো সমস্যা হলে জরুরি প্রয়োজনে কনস্যুলেট জেনারেলের সঙ্গে হটলাইন নম্বরে (৬৪৬-৬৪৫-৭২৪২ ও ৯২৯-৪২৪-২৭৫৮) যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। নম্বর দুটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। এ ছাড়া [email protected]—এই ই-মেইল ঠিকানাতেও যোগাযোগ করা যাবে। যেকোনো প্রয়োজনে কনস্যুলেট জেনারেল অব বাংলাদেশ ইন নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটে যোগাযোগের জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন কনসাল জেনারেল। একই সঙ্গে সবাইকে সাহসের সঙ্গে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।