দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল


‘ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈবেদ্য কাব্যের উচ্চারণ আজ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের ঘরে ঘরে। বিরান এই জনপদ দেখার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। আছে সাইরেনের ভীতিকর আওয়াজ। কেঁপে কেঁপে উঠছে তল্লাট। ঘরে ঘরে পরম করুণাময়ের অনুকম্পা চাচ্ছেন অসহায় লোকজন। খতমে কোরআন চলছে ঘরে ঘরে। গির্জা, মন্দিরে প্রার্থনা আর সংগীতের বন্দনায় সব মানুষের আকুতি আজ একাকার হয়ে গেছে—প্রভু তুমি আমাদের রক্ষা করো।
নিউইয়র্কে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। নগরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত প্রায় প্রতিটি পরিবারের কোন স্বজন বা চেনা মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত। আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারে অনেকেই অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। অনেকেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরছেন, অনেকে কোন চিকিৎসা ছাড়াই ঘরেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এসব সংবাদের বাইরে মৃত্যুর খবর বেশি প্রচারিত হওয়ায় আতঙ্কের মাত্রা বেড়ে গেছে। 

হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে এনেকেই ফিরে আসলেও নিউইয়র্কে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। স্থানীয় সময় ১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় নিউইয়র্কে নতুন করে প্রায় ১৮ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিনের মৃত্যু হয়েছে। করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনরা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় সমাহিত করছেন। সাংবাদিক স্বপন হাইয়ের দাফন সম্পন্ন হয়েছে নিউজার্সির কবরস্থানে। নিউইয়র্কে মৃত বেশ কয়েকজনের অন্তিম ঠিকানা হয়েছে নগরের ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল গোরস্থানে।
বাংলা সংবাদমাধ্যমের ইলিয়াস খসরুর অবস্থা উন্নতির দিকে বলে তাঁর পরিবার থেকে জানানো হয়েছে। সাবেক ছাত্রনেতা শাহাব উদ্দিনের অবস্থা অপরিবর্তিত। বাংলাদেশিদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা যেমনি বেড়েছে, তেমনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা বা বাড়িতেই সুস্থ হচ্ছেন—এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
প্রথম আলো মূলত বাংলাদেশিদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কারণে নগরের অন্যান্য অভিবাসী গোষ্ঠীর অবস্থা কী—সে তথ্য আমাদের কাছে নেই।
বিশ্বজুড়ে চলছে সুদীর্ঘ এক মৃত্যুর মিছিল। মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধলক্ষের কাছাকাছি। আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৯ লাখের বেশি। দেশের পর দেশ লকডাউন। বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ, বারণ মানুষের সঙ্গে মানুষের সময় কাটানো। গোটা বিশ্ব যেন এক বিষণ্নতায় ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ।
বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২১ জন বাংলাদেশির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই ঘাতক ভাইরাস। এ নিয়ে আমেরিকায় মোট ৫৬ জন মৃত্যুবরণ করেছে।
করোনায় নিউইয়র্কে প্রাণ হারিয়েছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম–পরিচয় পাওয়া গেছে। এঁরা হলেন সাহারা বেগম, মোস্তাক আহমদ, জিল্লুর রহমান, মো. ওয়াজিল্লাহ, মালেকুজ্জামান, আবদুল মালেক খান, আফজাল আহমদ, মো. মহসিন, রাশেদা আক্তার, শিপন মিয়া, আইয়ুব খান, সৈয়দা খাতুন, বদরুল হক, মহিকুজ্জামান, রহমান স্বপন, আবদুর রউফ, বিএনপির নেতা তানভীর হাসান, মুনিম চৌধুরী, নুসরাত মজুমদার ও সুরুজ খান, আনোয়ারুল আলম চৌধুরী, নিশাত চৌধুরী , মুক্তিযোদ্ধা মো. ইব্রাহীম, জ্যামাইকার বাসিন্দা খালেদ হাসমত, আলোকচিত্রী স্বপন হাই, কায়কোবাদ, শফিকুর রহমান মজুমদার, আজিজুর রহমান, মির্জা হুদা, বিজিত কুমার সাহা, মো. শিপন হোসাইন, জায়েদ আলম, মুতাব্বির চৌধুরী, ইসমত ও মোশাররফ হোসেন। এ তালিকায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় যোগ হচ্ছে নতুন নাম। পত্রিকা ছাপা হয়ে পাঠকের হাতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত এই সংখ্যা নিশ্চিত বাড়বে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় অনেক বাংলাদেশি আমেরিকান বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে এখন কোন প্রশ্ন নেই। মানুষের অসহায় আর্তনাদের অবসান কবে হবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন?
নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যে আকবর নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন ও ৭২ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া মিশিগান অঙ্গরাজ্যে আরও দুই বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমেরিকায় ৫৪ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে।
আমেরিকায় এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৫ হাজার ১৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ২৬ হাজারেরও বেশি। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত করোনায় নিউইয়র্কে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৮৪ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মোট মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২২০ জনের।