নিস্তরঙ্গ নগরে এখন জীবন যেমন

বাসা থেকে পেশাগত কাজ করছেন মল্লিকা খান মুনা
বাসা থেকে পেশাগত কাজ করছেন মল্লিকা খান মুনা

এগারো বছর আগে প্রথম আমেরিকা আসি। আসা–যাওয়ার মাঝেই ছিলাম, আমার ছোট মামা বাফেলো থাকে সেই সুবাদে। কিন্তু পাঁচ বছর হলো, বিয়ের পর চলে আসি নিউইয়র্ক শহরে। আমেরিকার জীবন সম্পর্কে ধারণা আমার অনেক আগে থেকে, কিন্তু ধারণা বা ঘুরতে আসা এবং এই শহরে বসবাস করা এক বিষয় নয়। এই শহর এমন কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাকে দিয়েছে, যেখানে আমার ভেতরের বেশ কিছু ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। তা ছাড়া যে বিষয়টি আমি একজন মানুষ হিসেবে পেয়েছি, তা হলো স্বতন্ত্রতা। এক জীবনের কোটি কোটি মুহূর্ত থাকে, কোনো এক মুহূর্ত ধরে রাখা বা সেই মুহূর্তের মাঝে জীবন ধারণ এক বিষয় নয়। প্রবাস জীবনের মধ্যে যে বিষয়টা অনেকটা সাধারণ সেটি হলো, এখানে গতিশীল জীবন। গতিশীলতা এই শহরের এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বসে থাকা, গল্প করা বা আত্মীয়ের বাসায় হঠাৎ করে বেড়াতে যাওয়া বিষয়টি হয় না। কাউকে ফোনে সব সময় পাওয়া যায় না। শনিবার বা রোববার ছুটি থাকলে, সেটা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।
বিষয়টি ঠিক বাংলাদেশের বিপরীত। তা ছাড়া কারও সময় হবে কী করে, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি শহর, টিকে থাকার লড়াই। যেখানে ট্যাক্স থেকে শুরু করে সব জিনিস যেন মাথাচাড়া। যেখানে অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে সেই অর্থ জমা করার সুযোগ থাকে না। বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, চলাফেরা, খাবারদাবার নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত পুরো শহর। বাসাবাড়িতে ঠিক মানুষগুলো যেন একটু দম ফেলতে পারে, কিন্তু এখানে বাসাগুলো বারান্দা না থাকার কারণে আলো–বাতাস থেকে বঞ্চিত হয় বেশি। আর এখানকার বাড়ি, যেগুলো শহরে সেখানে অনেক বেশি দাম। কিন্তু সেই তুলনায় ঘরের আয়তন অনেক ছোট। অবশ্য নিউইয়র্ক নগর থেকে একটু দূরে আবার কিছু ঘরবাড়ির ভালো সুযোগ-সুবিধা আছে। কিন্তু লোকালয় কাছে দেখে কেউ দূরে যেতে চায় না। সবই যেন ছুটছে, না ছোটার দেশে।
আমার সাংসারিক কাজে ব্যস্ততা শেষে লেখাপড়া, লেখালেখি ও গবেষণা আমার জীবনের কিছু পরিবর্তন আনে। নিউইয়র্ক শহরের সেন্ট জনস ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার শেষ করে এখন অপেক্ষা করছি পিএইচডি করব। যত দূর পড়াশোনা করা যায়, সঙ্গে লেখালেখি করে যেতে চাই। আমার নিজস্ব বলতে এই কিছু জিনিস। একজন নারী হিসেবে সময়ের আর নিজের বেশির ভাগ জিনিস আমার পারিবারিক ও সাংসারিক দায়িত্বে দিয়ে রেখেছি। তারপরও কিছু সময় পেলে নিজস্ব কিছু রেসিপি দিয়ে রান্না করি, দাবা খেলি অথবা খেলা দেখি। সন্তান হওয়ার পর সময় কমে গেছে, কিন্তু পড়ালেখা কেন যেন আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে, কিছু পড়ালেখা না করলে আমার দিন ঠিকভাবে পার হয় না। সময় পেলে পড়তে ভালোবাসি।
আমেরিকায় এসে মনে হয় সময়ের দ্রুতগামিতা। সময়কে নিয়মের মধ্যে আনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। আমেরিকা অনেক সুন্দর দেশ, প্রথম থেকেই ঘুরে দেখেছি ২০টি অঙ্গরাজ্য। কিন্তু বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে ও রক্তে মিশে আছে।
বাংলাদেশ আমাকে জন্ম দিয়েছে, লালন–পালন করেছে, কিন্তু আমেরিকা আমাকে জীবনের কিছু কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যেখানে আমি বেড়ে উঠছি একটু নতুন করে। তবে আমার দেশ ও মাটির গন্ধ খুব মনে করি, দেশে বৃষ্টি হলে আশপাশের সব বাচ্চাকে নিয়ে ভিজতাম, গরম-গরম গাঢ় দুধের চা পান করতাম আর মিষ্টি কিছু গান গুণ গুণ করে গাইতাম। কিন্তু আমেরিকায় বৃষ্টিতে ভেজা মানে পরের দিন জ্বর, যে জ্বর থামবার নয়, অ্যান্টিবায়োটিক না নিলে জ্বর সারতে চায় না।
আসলে আবহাওয়ার বিষয়টি চলে আসে। তা ছাড়া সূর্যের দেখা পাওয়া যায় ঠিক কয়েক মাস। কিন্তু বাংলাদেশে সূর্যের আলোকে কখনো এইভাবে দেখিনি। এখানে সূর্যের আলো কম পাই, ফলে ভিটামিন ডি ট্যাবলেট ঠিকই নিতে হয়, অভাব পূরণ করতে হবে বলে। যাই হোক, আমার কাছে নিউইয়র্ক ও ঢাকার মধ্যে এখন তেমন আর পার্থক্য আর দেখি না, নিজেকে মানিয়ে নেওয়া—এই যা। এখন মনে হয়, বিশ্বের সব জায়গায় আমরা কিছু না কিছু অভাব পাব, তা থাকবেই। শুধু নিজেদের মানিয়ে নিতে হয় সেই পরিবেশের সঙ্গে।
এখন নিউইয়র্ক আর সেই শহর নেই, যেখানে মানুষ বিদ্যুতের বেগে ছোটে। এখন এই শহর নিস্তরঙ্গ। এখন এখানে সকাল হলে হাজার হাজার মানুষ কাজে যায় না। এখন আর রাস্তাঘাটে সহসা কেউ যোগব্যায়ামও করে না। কারণ, এখন এই শহর ঘুমিয়ে গেছে। আর কত দিন ঘুমিয়ে থাকবে তা অনুমান করা বেশ মুশকিল। কারণ, এখন এই শহর লড়াই করছে করোনাভাইরাস নামক মরণব্যাধি ভাইরাসের সঙ্গে। এখন কেউ আর কাজে যাচ্ছে না, কেউ ম্যানহাটনের সুবিশাল গির্জায় প্রার্থনা করছে না বা এখন আর শহরের সবচেয়ে বড় জ্যামাইকা মসজিদে কেউ নামাজ পড়ছে না। জীবন কেমন যেন মন্থর হয়ে গিয়েছে।
এই ভাইরাস কত লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে কিংবা আরও কত লোকের প্রাণ নেবে, তা জানা নেই। তবে এর অনেক সুফল নেমে এসেছে প্রকৃতিতে, পরিবেশ দূষণ অনেক কমেছে, প্রকৃতি নিশ্বাস নিচ্ছে। এখন সাগরে কোনো ময়লা ফেলা হচ্ছে না, মাছগুলো নিশ্বাস নিচ্ছে। হয়তো প্রকৃতি নিজের মতো করে নতুন হচ্ছে। প্রকৃতির প্রতি অবিচার যেন এখন আমাদের ওপর ফেরত আসছে। হয়তো আমরাই একটু বেশি অন্যায় করে ফেলেছিলাম। তাই আমরা অনেক আপন মানুষ হারিয়েছি, হারাচ্ছি।
কথায় আছে, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়। হয়তো বা আমরা যারা পরিবারে সময় দিতে পারি না, এখন সেই সময়টা দিচ্ছি বা অনেক বেশি নিজেদের মাঝে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, হয়তো অনেক কিছুর মধ্যে আমরা গভীরতায় যাওয়ার সুযোগ পাইনি। এখন প্রকৃতি সেই সুযোগ দিচ্ছে। অন্যদিকে অনেক মানুষ জীবিকা হারাচ্ছে, অনেক মানুষ হয়তো এই পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে দুর্দশার দিকে চলে যাচ্ছে। কখন এই গতিহীন নগরী আবার স্থিতিশীল হবে, সে জন্য হয়তো এখন সহনশীলতা খুব প্রয়োজন। হয়তো এখন আমাদের মধ্যে মানসিক রোগ–প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা নিজেদের মধ্যে আবার তৈরি হতে সক্ষম হব। যেই অবস্থা–ই আমরা থাকি না কেন, প্রত্যেক মুহূর্তেই বলি, আলহামদুলিল্লাহ। কারণ আজকে যদি এই মুহূর্ত ভালো না লাগে, কোনো মুহূর্ত ভালো লাগবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।