করোনায় এক কাপুরুষের কান্না

বেজে ওঠা মোবাইলে নামটি দেখে অনুমিত আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল! পাশের বাসার প্রতিবেশী ভাইয়ের ফোন। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে হাউমাউ কান্না, দমকে দমকে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, ‘আরিফ ভাই! আপনার ভাবিকে আর রাখতে পারলাম না।’ এক সপ্তাহ যাবৎ ভাবি ভেন্টিলেশনে ছিলেন। এক দিন আগে ভাই জানিয়েছিলেন, হাসপাতাল তাকে ডেকে পাঠিয়েছে বাচ্চাদের নিয়ে ভাবিকে (শেষবারের মতো) দেখে আসতে। আমি ফোন হাতে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। যিনি ছিলেন আমার নিজের পরিবারের সদস্যের মতো, যিনি সকাল–বিকেল–সন্ধ্যা আসা–যাওয়ার মাঝে হাসিমুখে গল্প করতেন, তিনি এখন আর বেঁচে নেই।
তার কান্না আমাকে গ্রাস করল। আমি নিজেকে সামলাব নাকি তাকে সান্ত্বনা দেব! আবারও বুঝলাম, আমি বাংলা–ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালো করে শিখিনি। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো উপযুক্ত কোনো শব্দই খুঁজে পাচ্ছি না! মন চাইছে দরজা খুলে এক্ষুনি ছুটে যাই! বুকে জড়িয়ে ধরি! কাঁদি! শোক ভাগাভাগি করি। প্রাণের প্রতিবেশী, যিনি সুখ-দুঃখে প্রথম এগিয়ে আসেন!
এখন আমার ছুটে যাওয়ার পালা! নাহ, পর মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করি। এখন তো যাওয়ার উপায় নেই! দুই সন্তান নিয়ে তিনিও কোয়ারেন্টিনে। এ এক অচেনা অক্ষমতা! নাকি কাপুরুষতা? নাকি এটাই সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব। সামাজিক দূরত্ব না মেনে আবেগের কাছে ভেঙে পড়ে নিজে সংক্রমিত হলে পরবর্তীতে আমিও অন্যদের সংক্রমিত করে ফেলব। ভাইকে বললাম, কথা দিচ্ছি আমি বেঁচে থাকতে দেখে রাখব যেন আপনার সন্তানরা মানুষ হয়, যেন ভাবির স্বপ্ন পূরণ হয়!
৭ বছর আর ১৩ বছর বয়সী দুটি শিশু, যে মা তাদের সারাক্ষণ বাঘিনীর মতো আগলে রাখতেন, তিনি নিজেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন এই অবেলায়! ভাবি ২০ বছর আগে এ দেশে এসেছিলেন। তারপর বৈধতা-অবৈধতার জটিলতার বেড়াজালে আর দেশে ফিরে যাননি। তারপর সংসার-সন্তান হয়েছে। আর প্রতিদিন প্রহর গুনেছেন একদিন দেশে ফিরে যাবেন। সবার আগে তার মাকে জড়িয়ে ধরবেন। অথচ এখন তার লাশও দেশে যাবে না! এ কোন অচেনা সময়! চিরবিদায়ের আগে স্বামী তার স্ত্রীর মুখ, সন্তান তার মায়ের মুখ দেখতে পারবে না, স্পর্শ করতে পারবে না, কাছেও যেতে পারবে না। প্লাস্টিক ব্যাগে তিনি চিরকালের জন্য সিলগালা হয়ে গেছেন।
আমার মনে শঙ্কা! মনে সন্দেহ! নতুন রোগীদের অত্যধিক চাপে ওরা আগেভাগেই ভাবির ভেন্টিলেশন খুলে নিল না তো! ভাবি কি তখনো নিশ্বাস নিচ্ছিলেন? ভাবির মস্তিষ্কের কোষে কোষে কি বারবার ভেসে উঠছিল নাড়িছেঁড়া দুটি সন্তানের মুখ, স্বামী, সংসার, স্বপ্ন...ভাবি কি বোবা স্বরে আর্তনাদ করছিলেন! যা ডাক্তার-নার্সরা উপেক্ষা করেছিল কিংবা শুনতে পায়নি— ‘প্লিজ আমার ভেন্টিলেশন খুলে নিয়ো না। আমি এখনো বেঁচে আছি! প্লিজ আমাকে আরেকটু অক্সিজেন দাও, আরেকটু সময় দাও, আরেকটু বাঁচতে দাও! আমি চলে গেলে আমার বাচ্চাগুলোর কী হবে? এই দেখো আমি এখনো বেঁচে আছি! প্লিজ আমাকে আরেকবার সুযোগ দাও! কথা দিচ্ছি আমি দুদিন পরেই তোমাদের হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাব! চলে যাব আমার বাচ্চা দুটির কাছে...’
গত কয়েকদিন এক শুভাকাঙ্ক্ষী বড় ভাই ঠাট্টাচ্ছলে বা শাসনের মতো করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আরিফ, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ফেসবুকে তোমার পোস্ট দেখে তা-ই মনে হচ্ছে।’ আসলে আমরা যাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে জানি, তেমন পরিস্থিতিতে এখন আর বাস করছি না। কয়েক সপ্তাহ ধরে ধীরে ধীরে এই দুর্যোগ, এই মহামারি শুধু ঘনীভূতই হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে মার্চের প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। অনেকের রোগ এখনো শনাক্ত হয়নি, পরীক্ষাই হয়নি। প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। উপচে পড়া রোগীদের চাপে পৃথিবীর মহাপরাক্রমশালী দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেন ভেঙে পড়ছে!
আশঙ্কা মহামারির চেয়ে আরও দ্রুত সংক্রমিত হয়, ভোগায় আরও বেশি। কখনো নিজেকে মিথ্যা প্রবোধ দিই, কখনো অন্যকে। খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা। কারণ, কাছে দূরে সবখানেই তো আমার আপনজন ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। এখানে, এ দেশে, অন্য মহাদেশে, বাংলাদেশে। মন চায় সবাইকে এখন বুকের মাঝে আগলে রাখি। আরেকটিবার যদি বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম! সারা দিন ঘরবন্দী! জানলা দিয়ে দেখি শুধু ধাবমান অ্যাম্বুলেন্স, অনবরত কানে ভেসে আসে সাইরেনের বিকট শব্দ! শিশুরা এতে মনোবৈকল্যের শিকার হতে পারে, যেখানে বড়রাই বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেছে। পুরো শহর, পুরো রাজ্য, পুরো রাষ্ট্র, পুরো পৃথিবী বিষণ্ন। দুর্যোগে ও শঙ্কায় কাঁপছে। সুতরাং আমার আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতা ফুটে উঠবে, হয়তো এটাই এখন নতুন ‘স্বাভাবিক’।
প্রতিদিন পরিচিতদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাচ্ছি। দুঃসংবাদ পাচ্ছি কারও কারও চলে যাওয়ার। কেউ সুস্থ হয়ে উঠছে শুনলেই মনটা আশ্বাসের আনন্দে চনমনে হয়ে ওঠে। যেন হঠাৎ একটু সুবাতাস! কিন্তু ক্ষণিকের সুবাতাস এই দীর্ঘ গুমোট পরিবেশটাকে কাটাতে যথেষ্ট নয়। খোঁজ খবর নিচ্ছি, যারা আক্রান্ত তারা ঠিকমতো আইসোলেশন মানছেন কী-না, ঘরে বাজার খাবারদাবার আছে কিনা। যথাসাধ্য চেষ্টা করছি সাহায্যের হাত বাড়াবার। দূর পরবাসে প্রতিবেশী এবং বন্ধুরাই আপনজন, আত্মীয়। যেমন আত্মীয় ছিলেন এই ভাবি।
ভাই ফোনে অনবরত কাঁদছেন। আবারও বলেন, ‘আরিফ ভাই, ও আমারে এইভাবে ফাঁকি দিয়া চইলা গেল!’
আমি অনুরোধ করলাম তার বাচ্চাদের হাতে ফোনটা দিতে। সাত বছরের শিশুটিকে ডেকে ফোন দিলেন। এক ঘণ্টা আগে তার মা মারা গেছে। আমি মনে মনে দ্রুত কথা সাজাই কী বলব! মনে করার চেষ্টা করি, এমনি বয়সের কথা যখন আমিও আমার মাকে হারিয়েছিলাম। তখন কে কী বলেছিল যা আমার মনে সেদিন সাহস–শান্তি জুগিয়েছিল।
কিছুই মনে করতে পারি না!
শিশুটি ফোন ধরে বলল, ‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম!’
ওর মা চলে গেছেন, কিন্তু এই ছোট্ট শিশুটির ভেতর ঠিক রেখে গেছেন তার শিক্ষা আর তার অনুশাসন। আমি এবার আর কান্না ধরে রাখতে পারলাম না।
আসলেই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কারণ আমি জানি না, এই দুঃখের শেষ কোথায়।
‘আমি পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে
সেই দুঃখের চোখেরও পানি...’