করোনা-পরবর্তী বিশ্বে স্পর্শহীন মুদ্রা!

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ফলে পৃথিবীটা পরিবর্তন হয়ে যাবে। বড় বড় দুর্যোগের পরে নানাভাবে পৃথিবী পরিবর্তিত হয়েছে।
করোনা–পরবর্তী বিশ্বে সব অনলাইন হয়ে যাবে, স্পর্শবিহীন লেনদেনের দিকে মানুষ ঝুঁকে যাবে। যেন বিশেষ বিপদের মুহূর্তে বাসায় বসে মানুষ সব করতে পারে। ভাইরাস ছড়াতে না পারে। এমনিতেও পানি সেদিকেই গড়াচ্ছিল, সেটাতে তাড়া দিল কোভিড-১৯। এই লকডাউনে আপনি চাইলে একটা নতুন বইও কিনতে পারছেন না। তাই বাংলা বইও এই ধাক্কায় ডিজিটাল হয়ে যাবে। পয়সা দিলে কম্পিউটারে এসে যাবে। অথবা মোবাইল ফোনে, যখন ইচ্ছা পড়বেন। যেমন আমাজন কিন্ডেলে বই ডাউনলোড করে পড়া যায়, তেমনটা বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে হবে। বাংলাদেশ ও পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও ব্যাপারটি দ্রুত ঘটবে।
এখন দেশে কাউকে টাকা পাঠালেও সে টাকাটা নিতে পারছে না। হোক বিকাশ, হোক ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, ব্যাংকে বা কোনো এজেন্টের দোকানে তো যাওয়া যাচ্ছে না। পাবে কীভাবে? এর ফলে ধীরে ধীরে চলে আসবে ক্রিপ্টো-মুদ্রা, যার একটির নাম সবাই জানে—বিটকয়েন। হতেই হবে, তাতে ব্যাংকে কখনোই যেতে হবে না। এর অন্যান্য সুবিধার কারণেও প্রচলনের বিষয়ে জোর কথাবার্তা চলছিল। তবে ঠিক বিটকয়েন নয়, অন্য কিছু। ফেসবুকের লিব্রার তো যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বিভিন্ন দেশের সরকারও নিজেদের ক্রিপ্টো-মুদ্রা তৈরি করতে পারে।
তেমনি অনলাইন ক্লাস প্রসার পাবে। ‘ইউনিভার্সিটি অব ফিনিক্সের’ মতো ক্যাম্পাস ছাড়া শুধুই অনলাইন, ভার্চুয়াল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে মানুষ এগিয়ে যাবে। চাকরির ক্ষেত্রে বাসায় বসে কাজ করাকে আরও অনেক বেশি উৎসাহিত করা হবে।
একটা বিমান দুর্ঘটনার পরে মানুষের মনে সেটা অনেক দিন গভীর প্রভাব ফেলে, মানুষ বিমানে উঠতে চায় না। তেমনি, করোনার পরে মানুষ অনেক দিন ভাববে, যদি গৃহবন্দী থাকতে হয়? আবার যদি দীর্ঘদিন থাকতে হয়? সেটি মোকাবিলার জন্য সে অনেক কাজ করবে। তার মধ্যে সবকিছু যা যা হওয়া সম্ভব, অনলাইন হয়ে যাবে। হয়তো বিশ্বব্যাপী এমন দীর্ঘ লকডাউন আর ৫০ বছরেও হবে না। কিন্তু মানুষের মন এভাবেই চলে। মাত্র ঘটে যাওয়া বড় ঘটনা নিয়েই সে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে, সেটি আরেকবার ঘটার সম্ভাবনা বিচার না করেই। এমনকি আরেকজন মানুষকেও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু নিয়েই বিচার করে, সামগ্রিকভাবে নয়।
মানুষের অন্তর্গত পরিবর্তন তো হচ্ছেই। জীবনের ও জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তাটা মানুষ দেখতে পাচ্ছে। ‘ঝুঁকি’ জিনিসটা সে বুঝতে শিখছে। ঝুঁকি প্রশমনের জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তাটা উপলব্ধি করছে। পরবর্তী বিপদের জন্য প্রস্তুতি বাড়বে। ভয়কে জয় করতে শিখছে।
বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটবে। তার কারণটা একটু বলি। করোনাকে অনেক মানুষই শত্রু বা বিভীষিকা হিসেবে দেখছে না। দেখছে একটা দূত হিসেবে। তারা ভাবছে, এটা তাদের পক্ষেই এসেছে। এসেছে তাদের শত্রুর বিপক্ষে। কিছু কিছু অতি উৎসাহী পরিবেশবাদী ভাবছে, পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে পৃথিবীর ও জীব জগতের যে ক্ষতি মানুষ করেছে, তার বিরুদ্ধে প্রকৃতি নিজেই নেমেছে। সবাইকে ঘরে আটকে রেখেছে। কলকারখানা, গাড়িঘোড়া বন্ধ করে রেখে নিজেকে সরিয়ে তুলছে। ডলফিন দেখা যাওয়ায় মানুষ খুবই উদ্দীপ্ত। অথচ ভাইরাসজনিত মহামারি অনাদিকাল থেকেই চলে আসছে। এই মহামারিতে শেক্‌সপিয়ারকেও দীর্ঘদিন গৃহবন্দী থাকতে হয়েছে। কিন্তু তখন এই পরিবেশ দূষণ ছিল না। প্রকৃতি কোনো বুদ্ধিমান জীব নয় যে, এক সময় না পেরে হঠাৎ নিজেই মানুষের ওপরে চড়াও হবে। পরিবেশ দূষণ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাতে হবে। সেগুলো সব দেশের সমন্বয়ে করতে হবে, ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার কমিয়ে, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করে এসব করতে হবে। ইতিমধ্যেই সে বিষয়ে দেশে দেশে সচেতনতা এসেছে। তবে ভাইরাস পরিবেশ দূষণের সমাধান কোনোভাবেই নয়।
যে রসুন ও কালোজিরা দিয়ে বিভিন্ন রোগ সারিয়ে এসেছে বা তার ওপর ভক্তি যাদের আছে, তারা এবার আরও জোরেশোরে লেগেছে। প্রত্যেক ধর্মমতে, গজবের ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। সমাজতন্ত্রের পক্ষে যারা, তারা করোনাভাইরাসের মাধ্যমে পুঁজিবাদের অসারত্ব দেখতে পাচ্ছেন। অণুজীব বিজ্ঞানী ভাবছেন, তাদের গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থ জোগান হলে এত বড় মহামারিকে ঠেকানো যেত। কেউ ভাবছেন চীন বানিয়েছে, কেউ ভাবছে আমেরিকাও যুক্ত আছে। কেউ ভাবছে, আফ্রিকানদের হয় না। কেউ ভাবছেন সরকারের জন্য, কেউ ভাবছেন বিরোধী দলের জন্য। করোনা যেন একটা বুদ্ধিমান, মানুষের মন বুঝতে পারা বিচারক এবং একই সঙ্গে শাস্তি দানকারী মহৌষধ।
অথচ করোনার আক্রমণে সত্যিকারের যা বোঝা গেছে তা হলো—পৃথিবীজুড়ে মানুষ একের সঙ্গে অপরে যুক্ত। তাদের বিপদ ও মহাবিপদগুলো এক। এককাট্টা হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই বিপদের মোকাবিলা করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা প্রতিষ্ঠা পায়নি। যা হোক, বোঝা যাচ্ছে করোনা–উত্তর পৃথিবীতে প্রায় সবাই তাদের মতামত আরও পোক্তভাবে আঁকড়ে ধরবে। এইটা ক্ষতিকর ব্যাপার। মানুষে মানুষে, দেশে দেশে ভেদাভেদ না কমে, বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
ভালো দিকের মধ্যে একটা হচ্ছে, কীভাবে মহামারি ছড়ায়, পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটাইজেশন, সুস্থ আচরণবিধি—এসব সম্পর্কে মানুষের খুব ভালো একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভালো কিছু অভ্যাস তৈরি হয়েছে, যা করোনা–উত্তরকালে টিকে থাকতে পারে।
অর্থনীতিতে ধাক্কাটা বড় হবে। মানুষ, ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই আর্থিক সংকটে। এছাড়া বিশ্বজুড়ে মন্দা আসছে। এসব যখন মানুষ উতরে যাবে, তখন তার ভেতর সঞ্চয়ী স্বভাব দেখা দেবে। বিভিন্ন দেশ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টায় নামবে। যেন অন্য দেশ থেকে কাঁচামাল বা যন্ত্রাংশ আমদানির মুখাপেক্ষী থাকতে না হয়। তাহলে দুর্যোগের দিনেও যখন এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে, তখনো দেশটির উৎপাদন ও জোগান থেমে থাকবে না। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাবে। তবে সব দেশে সেটা যে হবে, তা নয়। বিশ্বজুড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। সাম্প্রতিক রমরমা অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা দীর্ঘদিনের জন্য ব্যাহত হতে পারে। মানুষ সাশ্রয়ী জীবনযাত্রা খুঁজে নেবে। বিশেষত, সুবিধা–বঞ্চিত, দরিদ্র–জনগোষ্ঠীর জন্য সময়টা বেশ কঠিন হতে পারে।
তবে ভালো যেটা হবে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্বশক্তি নেমে পড়বে। ভাইরাস হাজার হাজার বছর ধরেই মানব সভ্যতাকে থেকে থেকে তছনছ করে দিয়ে যায়। এর জন্য প্রয়োজন গবেষণা। বড় রকমের গবেষণা, তার জন্য দরকার অতিকায় বরাদ্দ। সব দেশ মিলে একক এবং সমন্বিতভাবে সেই বরাদ্দ দেবে। গবেষণার ঝড় তুলবে। ফলে জীববিজ্ঞানে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে যাবে। সেটা একটা আশীর্বাদ। মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার পরিকল্পনাটা একটু স্থগিত রেখে বিশ্ববাসী যদি সেই মনোযোগ, সেই অর্থ জীববিজ্ঞান, অণু জীববিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিনিয়োগ করে, তাহলে অনেক রোগের প্রতিষেধক, অনেক রোগের ওষুধ এবং মানুষ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্যই উদ্ঘাটিত হতে পারে। এমনকি এসব গবেষণায় যুগান্তকারী কিছুও ঘটে যেতে পারে। বিজ্ঞানের প্রতি, বিজ্ঞানীদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়বে। অনেক নীতি নির্ধারণে তাদের মতামতের গুরুত্ব থাকবে। পরিবেশ দূষণ ও গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যক্রম জোরদার হবে।
সন্দেহ নেই কোভিড-১৯ মহামারি–উত্তর পৃথিবীতে এমন অনেক কল্যাণকর বিষয়ও মানব জাতির জন্য অপেক্ষা করছে।