মাকে খোলা চিঠি

আম্মা,
তোমাকে মাঝে মাঝে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে। কখনো কখনো নিজের অজান্তে অনেক কথা মনে মনে বলি। জানি না, তুমি শুনতে পাও কি না। তবে আজ কেন জানি তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। মনটা একটু বিক্ষিপ্ত। তাই ভাবলাম, তোমাকে খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখব। আম্মা জানো, মে মাসে মা দিবস নামে না একটা দিন বেরিয়েছে। সেটি হয় তোমার চলে যাওয়ার দিনটি বা তার আগে–পিছে কোন দিন। সবাই মাকে এটা-সেটা উপহার দেয়। ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে। কিন্তু আমি স্তব্ধ হয়ে সবারটা পড়ি, দেখি। আমারও তোমাকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে। সুন্দর একটি সাদা শাড়ি। তুমি সাদা শাড়ি কেন পরতে? আব্বা ছিলেন তারপরও! আমারও খুব সাদা পছন্দ। ভাবছি সাদা শাড়ি পরা শুরু করব। দেশে যখন অফিসে কাজ করতাম, তখন বেশির ভাগ সালোয়ার কামিজ ছিল সাদা। একদিন আমাদের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়া উদ্দীন স্যার, জিজ্ঞেস করে ফেললেন—
-তুমি এত সাদা পরো কেন?
-ভালো লাগে স্যার তাই।
-গুড, ভেরি গুড! হোয়াইট ইজ দ্য ডিগনিফাইড কালার। এটা তোমার ব্যক্তিত্বকে বাড়িতে দেয়।
-ধন্যবাদ স্যার।
এই গুণটা কি তোমার আর আব্বার কাছ থেকে এসেছে? সেই স্যারও নেই আম্মা। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। যখন অসুস্থ ছিলাম, খুব খোঁজ নিতেন।
আম্মা শোনো তো, একটি বই আছে নাম ফেসবুক। না এটি কোনো বই না। তুমি যে সিনেমাকে বলতে বই, দেখতে যাই হোক বুঝলে আম্মা, তোমার বাংলা সিনেমার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ আকর্ষণ এই ফেসবুকের। আজকাল সবাই এটি পড়ে। সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রচলন থাকলে নির্ঘাত সবাই ফার্স্টক্লাস পেয়ে পাস করত। মিথ্যে বলছি না। আমি কিন্তু মন দিয়ে পড়ি আম্মা। যে রকম আগে দম বন্ধ করে গল্পের বই পড়তাম, ঠিক সে রকম। আমার টাইম লাইনে অনেক ভালো ভালো লেখক আছেন। কি যে ভালো লেখেন তাঁরা। তোমারও খুব পড়ার আগ্রহ ছিল। বেঁচে থাকলে হয়তো তুমিও পড়তে।
আম্মা, আমরা সব ভাইবোন মোটামুটি যার যার স্থানে ভালো আছি। তারপরও মাঝে মাঝে অনেক ভাঙন কষ্ট ওঠে আসে জীবনে, যা সামলানো কখনো কঠিন হয়ে যায়। তবে সুখের বিষয়, দুঃখ–কষ্টে তোমার সব ছেলেমেয়ে সবাই সবার পাশে থাকে। আমাকে এই সুদূর আমেরিকায় বসে অনেক খবরদারি করতে হয়। কষ্ট হলেও আমার কথা শুনে সবারই ভালো লাগে। তোমার বড় ছেলেটা সেই আগের মতোই আছেন। জীবনের প্রতি উদাসীন, কিছুটা বাউন্ডুলে। এখনো ছেলে মানুষ, তবে দিন চলে যাচ্ছে। তোমার দুই নাতি তাঁকে দেখে রাখছে। সজীব আর সৌরভ। সজীবকে তো তুমি চেনো। সৌরভ আর তামিমা—এদের জন্ম হয়েছে অনেক পরে। এরাও অনেক বড় হয়েছে, এখন চাকরি করে। সজীবের একটা ছেলে হয়েছে সজীবের অবিকল কপি। সে আমার খুব ভক্ত। তাঁকে নিয়ম করে আমেরিকান বিমানগুলো দেখাতে হয়। ওরা খুব ভালো আছে আম্মা। তবে গত দুই সপ্তাহ ধরে ঘরে বসে আছি। তাঁকে বিমান দেখাতে পারছি না।
তোমার বড় মেয়ে! মানে আমাদের বড় আপা। তেমন ভালো নেই গো। একমাত্র মেয়েটাকে হারিয়ে কেমন এলোমেলো হয়ে গেছেন। দেখলে মনে হয় কত বেশি বয়স! তোমার কী ঊর্মির সঙ্গে দেখা হয়েছে? শুনেছি মরে গেলে সব প্রিয়জন একসঙ্গে হয়ে যায়। সত্যিই কি কাই? তোমার দেখা তোমার সবচেয়ে ছোট নাতনি, যার জন্ম তোমার হাতে হয়েছিল বাসায়। সেই ঊর্মি নেই। কি থেকে যে কী হয়ে গেল? আমার দোয়া কাজে লাগল কী লাগল না, জানি না। আমি সব সময় তাঁর জন্য ফানাহ চেয়েছি। ফানাহ, মানে যে মুক্তি সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। হয়তো আল্লাহ তাঁকে ব্যথা থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর কষ্টে আমি পথে–ঘাটে চোখের জল ফেলেছি। এখানে কেউ ছিল না, যাকে ধরে একটু কাঁদব। খুব অদ্ভুতভাবে আমি একা হয়ে গেছি সবার কাছ থেকে।
প্রথমে পড়াশোনার জন্য, তারপর জীবনই পড়ে গেছে এমন এক ছকে। তবে এক ফেরেশতা, অ্যাঞ্জেল, পরি যে নামই বলি না কেন, তাঁকে মানায়। সে সব সময় আছে আমার সঙ্গে। তোমার সে ঊর্মি একদিন চলে গেল। যাওয়ার দিন সন্ধ্যা রাতে বলল, আন্টি আমার মনে হয়, আমি গরুর গোশত দিয়ে চারটা ভাত খেলে ভালো হয়ে যেতাম। আবার এটাও বলেছে, আন্টি তোমার হাতের রান্নাই (আখনি) আমি শেষ খেলাম অপারেশনের আগের দিন। কে জানত, ও চলে যাবে তাই আমাকে মনে করিয়ে যাচ্ছে সব। এ সব মনে হলে চোখে জল আসে। বাচ্চা আমার, কত দিন ভাত খেতে পারেনি।
মনে করতে চাই না, তবু মনে পড়ে যায়। এই যে গতকাল ডিম ভুনা দিয়ে ভাত খেতে গিয়েও মনে হল। ও বলত, আন্টি তোমার হাতের ডিম ভুনা খুব মজা। তাই আমি ওর জন্য বাড়তি ডিম রান্না করতাম। যাতে সঙ্গে দিয়ে দিতে পারি। ও এখানেই ছিল, নিউইয়র্কে। এক ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে দুঃস্বপ্নের মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাই। তা হয়ে গেছে বছরের বেশি।
সবার মিলিয়ে তোমার অনেক নাতি–নাতনি। মামুনের দুটি ছেলেমেয়ে। দেখলে যমজ মনে হয়। মেজো আপা ভালো আছেন। চার ছেলেমেয়ে। তোমার বড় নাতনি লাকী ঢাকায় বেশ নাম করা ব্যবসায়ী। প্রায়ই দেখি টিভি চ্যানেলে সাফল্যের সাক্ষাৎকার দেয়। দুলু আপা ভালো, তবে লন্ডনে খুব একা হয়ে গেছেন। রুকু তোমার ছোট মেয়ে ভালো আছে তার মতো করে। কামরান আমেরিকায় আছে, তবে আমার থেকে বেশ দূরে। তারও একটি মেয়ে পুতুলের মতো। খুব মায়াবতী। তোমার বোনের ছেলেমেয়েরাও ভালো আছে। কয়ছর লন্ডনে। সে একটা গ্রুপ বানিয়েছে, নাম ‘ঘরবন্দী’। সে গ্রুপে বসে বিভিন্ন সেশনে আমাদের অনেক কথা হয়। মাঝেমধ্যে মতানৈক্য হয়ে হাউকাউ লাগে। তবে খুব মজা আম্মা। এই দুর্দিনে ফেসবুকের মেসেঞ্জারের জন্য আমরা এখনো একে অন্যের খোঁজ রাখতে পারছি। কেউ কারও বাড়ি যেতে পারছে না। এ ফোনই সবার ভরসা।
জানো, খুব ভয়ংকর অবস্থা আমাদের পৃথিবীর। খুব সামান্য এক অণুজীবের কাছে আমরা পরাস্ত। মানব জাতি ঘরে বন্দী। তার নাম করোনা। রোগের নাম কোবিড। আমেরিকায় নিশ্চিত কেস সাড়ে তিন লাখের বেশি, মৃত্যু ১১ হাজারের কাছাকাছি। তার বেশির ভাগই আমি যে শহরে আছি সেখানে। আমার বাসার একটু দূরে বাঙালি পাড়া, সেটা বেশি আক্রান্ত। চেনা–অচেনা মানুষের শব দেহে ফেসবুক ভরে ওঠে, যা সহ্য করা দায় আম্মা। আমি অনেক সাহসী আম্মা। নিজের মন খারাপ হয় এমন কিছু মনে করি না। মনকে, চিন্তাকে সবকিছু গুছিয়ে নিতে শিখেছি। ভাবছি যত দিন বেঁচে থাকব, মানুষকে শিখিয়ে যাব সে মন্ত্র। যাতে একজন মানুষও মনে কষ্ট নিয়ে না থাকে। কঠিন বিপদের যেন না কাঁদে।
আমি অনেক দিন হয় কান্না ছেড়ে দিয়েছি। আমার অ্যাঞ্জেল কাঁদতে দেয় না। সেই চার–পাঁচ বছর বয়স থেকে। আমি আর কাঁদি না। সে বিপদের জন্য আমাদের এখন ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। সবকিছু ঘরে আছে। কিছু কিছু শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু অ্যাঞ্জেল আমাকে যেতে বারণ করে। বলে লাগবে না। ওয়ালেটে ডলার আছে, ক্রেডিট কার্ডে ব্যালেন্স আছে, তবু কিনতে পারছি না। অনলাইনে এখনই ডেলিভারি অনিশ্চিত। সামনে কী দিন আসছে, জানি না। তোমার নাতনি খুব লক্ষ্মী এক মেয়ে আম্মা। যেমন সুন্দর, তেমন নম্র। আব্বা থাকলে নির্ঘাত ওকে বলতেন, ‘ও বিশ্ব সুন্দরী, নানুর কাছে আসো।’ আমার মেয়েটি তোমাদেরকে দেখল না। কাউকেই পেল না। আমি মাঝে মাঝে বলি, কেন আমার মতো মায়ের পেটে এলি? তোর তো কোনো প্রাসাদে জন্মানোর কথা ছিল। তখন যা বলে, তা খুবই হাস্যকর। আমি ওকে নিয়ে সুখে আছি। আর দুঃখের যে অংশ, তুমি শুনলে কষ্ট পাবে। কিছু ভুল গভীর ছাপ ফেলে যায়। থাক না সে সব। আমি বেশ ভালো আছি। মনে অপার শান্তি। এখন শুধু এই গ্রহটির জন্য কষ্ট। সব মানুষের জন্য কষ্ট। আমাদের এ কষ্ট কবে শেষ হবে জানি না। আমি প্রতিদিন বলি, ‘কুন ফায়া কুন’। কিন্তু কই, তিনি তো আমার ডাক শোনেন না। আমার মতো মায়েরা সন্তানের মঙ্গল চিন্তায় দিন কাটায়। তুমি আমাদের সব মায়ের জন্য একটু সুপারিশ করো। যেন এ পৃথিবী আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ হয়ে ওঠে। যেন মুছে যায় সব দুঃখ।

ইতি
সুরমা