জানি না, কবে আমাদের হুঁশ হবে

বাজার করতে গেলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ছবি: হৃদয় অনির্বান খন্দকার
বাজার করতে গেলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ছবি: হৃদয় অনির্বান খন্দকার

মেয়েটি কয়েক দিন আগে আমার লাইব্রেরিতে এসে দেখা করে বলল, ইংরেজি কোর্সে নাম লেখাতে চায়। বলল, সে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এসেছে। আমি তাকে কোর্সে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করে বলেছিলাম—এই কোর্স তোমার জন্য শুধুই সময় নষ্ট করা হবে। কারণ এগুলো হলো যারা কোন ইংরেজি জানে না তাদের জন্য, তুমি বরং সিটি ইউনিভার্সিটিতে কীভাবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি করা যায় তা দেখ, তোমার ইংরেজি খারাপ হলে কলেজই তোমাকে কোর্স করাবে। মেয়েটিকে প্রয়োজনীয় আরও তথ্য দিয়ে হাসি মুখে বিদায় করেছিলাম।
ফেসবুকে হৃদয় ভাঙা খবরটি পেলাম, তমা নামের মাত্র ২৭ বছর বয়সের সেই মেয়েটির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস। এই মৃত্যু সহ্য করা যায় না।
নিউইয়র্কে সরকারি হিসাবে লোকসংখ্যা ৮৬ লাখ, যার মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা কোনোভাবেই ১ লাখের বেশি নয়। অথচ এই ছোট্ট কমিউনিটিতে মৃত্যু প্রায় ১০০ ছুঁই ছুঁই করছে। কারণটি কি? আমাদের তা তলিয়ে দেখতে হবে।
তখনো নিউইয়র্ক নগরে করোনা এত ব্যাপক রূপ লাভ করেনি, কিন্তু আমাদের কমিউনিটির কোন কোন মানুষ হয়তো কর্মস্থলে আক্রান্ত হয়ে এর বাহক হিসেবে কাজ করেছেন আর ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের অজান্তেই।
নিউইয়র্কে বাঙালিদের বসবাসের জনপ্রিয় এলাকা হলো জ্যামাইকা। এখানে করোনা হয়েছে ব্যাপকভাবে। আমাদের বাঙালি কমিউনিটির বেশ কয়েকজন ডাক্তার এই এলাকাতেই চিকিৎসা চর্চা করেন। তাদের মধ্যে তিনজন প্রথম দিকেই আক্রান্ত হয়েছেন এবং এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেননি। অন্যান্য এলাকায়ও বাঙালি ডাক্তাররা আক্রান্ত হয়েছেন এবং এঁদের মধ্যে একজন ইন্তেকাল করেছেন।
আমার এক বন্ধু বললেন, প্রথম দিকে যখন এই ভাইরাস ছড়াতে থাকে, তখন তিনি এই ডাক্তারদের একজনের নিয়মিত রোগী হিসেবে তার কাছে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন, ঘরভর্তি রোগী, জ্বর আর কাশি নিয়ে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছেন। অবস্থা দেখে তিনি ডাক্তার না দেখিয়ে চলে আসেন। আসলে এখন বোঝা যাচ্ছে, কিছু ডাক্তারের চেম্বার ছিল করোনার ‘হটস্পট’, যা থেকে আমাদের ডাক্তাররাও আক্রান্ত হয়েছেন।
আরেকটি ‘হটস্পট’ ছিল বাঙালি গ্রোসারিগুলো। যেগুলোতে প্রথমদিকে সামাজিক দূরত্বের কোন নিয়ম মানা হয়নি। লকডাউন হবে এই আশঙ্কায় আমিও গিয়ে দীর্ঘলাইন দেখে ফিরে এসেছিলাম। এসব গ্রোসারির বেশ কয়েকজন বিক্রয়কর্মী করোনায় মারা গেছেন। কোনো সন্দেহ নেই, এখানে বাজার করতে আসা আক্রান্ত অথবা নিজে আক্রান্ত হননি, এমন কেউ আক্রান্ত হয়েছেন, আবার তার কাছ থেকে বহু মানুষের মাঝে করোনা সংক্রামিত হয়েছে।
আমার এক সাংবাদিক বন্ধু যিনি ব্রঙ্কসে থাকেন বললেন, সেখানে এক মসজিদের সভাপতি তার সঙ্গে হাত মেলাতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, এখন তো হাত মেলান যাবে না। সভাপতি সাহেব মন খারাপ করেছিলেন। তিনি নাকি সদর দরজা বন্ধ করে তার কয়েকজন অনুসারী নিয়ে মসজিদে নামাজও আদায় করেছিলেন। দুই দিন পরেই জানা গেল, সভাপতি সাহেব করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন কমিউনিটি নেতা ইন্তেকাল করেছেন, যাদের অন্যতম হলেন নিউইয়র্কের বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি ও কমিটির একজন সদস্য।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাঙালিরা এখনো বুঝতে পারছেন না যে, নিজে আক্রান্ত না হলেও অথবা সামান্য লক্ষণ নিয়েও অন্যকে করোনাভাইরাস সংক্রমিত করা যায়। জানতে পেরেছি, স্কুল বন্ধ হয়েছে শুনে বাচ্চাদের নিয়ে বেশ কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে পরে অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এবং দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই পরিবারের একজন যিনি সেই দাওয়াতে যাননি তিনি জানালেন, পরিবারে একজন বয়স্ক সদস্য সামান্য জ্বর আর কাশি নিয়ে সেখানে ছিলেন। বাঙালি পরিবারে এখনো বাসার একজন হয়তো আক্রান্ত হয়েছেন, অন্য সুস্থ সদস্য অসুস্থদের জন্য বাজার করতে অথবা ওষুধ আনতে ফার্মেসিতে যাচ্ছেন। অ্যাপার্টমেন্টের এলিভেটর ব্যবহার করছেন। প্রথম দিকে তারা বাঙালির প্রিয় আড্ডাও দিতে ছাড়েননি। আপনি যদি জ্যামাইকা এলাকায় আসেন, তবে দেখবেন রাস্তার পাশে ব্যবহৃত হাতের গ্লাভস আর মাস্ক ছড়ানো–ছিটানো। এর সব যে বাঙালিরা করছে, তা নয়। তবে এই এলাকাতে আমরা বাঙালিরাই যেহেতু বেশি থাকি, তাই আমরা এর দায়িত্ব এড়াতে পারি না।
চারদিকে নীরবতা ভেঙে যখন অ্যাম্বুলেন্সগুলো যায়, তখন মনে হয় যেন আমার বুকের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, তখন ব্যথায় কুঁকড়ে যাই। আমাদের এই হঠকারিতার দাম আমাদের দিতে হচ্ছে। জানি না, আমাদের কমিউনিটির মানুষ কবে সচেতন হবেন। আর কত মৃত্যুর পর আমাদের হুঁশ হবে।

লেখক: গল্পকার ও কুইন্স লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]