সাহসই পারে বাঁচাতে মহাসংকট থেকে

আমেরিকায় নতুন করোনাভাইরাসের প্রকোপ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এরই মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৩০ হাজার পেরিয়ে গেছে। মৃতের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশি আমেরিকানদের মৃত্যুর তালিকাও ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি এক ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে মানুষের মধ্যে। কিন্তু আতঙ্কের এই বিস্তার এই মহাসংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে না, এর জন্য চাই সাহস।
করোননাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যমতে, ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ লাখ ৯০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মৃতের সংখ্যা প্রায় ৮৯ হাজার। আক্রান্তের সংখ্যা বিচারে একক দেশ হিসেবে সবার ওপরে রয়েছে এখন আমেরিকা। আমেরিকাজুড়ে নিশ্চিত সংক্রমণের সংখ্যা এরই মধ্যে ৪ লাখ ৩২ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। শুধু ৮ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় আমেরিকায় মারা গেছে ১ হাজার ৯০০ জন।
আমেরিকায় সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে। শুধু এই অঙ্গরাজ্যেই দেড় লাখ মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর মৃতের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শুধু ৮ এপ্রিলেই নিউইয়র্কে মারা গেছে ৭৭৯ জন, যা আগের রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে। এর আগে ৭ এপ্রিল একদিনে ৭৩১ জনকে হারিয়েছিল নিউইয়র্ক। এর মধ্যে শুধু নিউইয়র্ক নগরেই মৃতের সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শহরটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৮১ হাজার।

আমেরিকাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশেরই বাস নিউইয়র্কে। আরও ভালো করে বললে নিউইয়র্ক নগরে প্রচুর বাংলাদেশি বাস করেন। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত। এরই মধ্যে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮৫ জন বাংলাদেশি। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।
৮ এপ্রিল নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো বলেন, নিউইয়র্কে এখন পর্যন্ত যতজন মারা গেছে বলে জানা গেছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে। কারণ, যেসব কোভিড-১৯ রোগী নিজ বাসায় মারা গেছেন, তাঁদের হিসাব এই তালিকায় নেই। এখানে শুধু হাসপাতালে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্যই রয়েছে।
পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে আরেকটি তথ্যের দিকে। পুরো আমেরিকায় যখন মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার, তখন শুধু নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি অঙ্গরাজ্য মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা সাড়ে সাত হাজারের বেশি। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের মহামারির কেন্দ্র যদি আমেরিকা হয়, তবে আমেরিকার কেন্দ্রটি রয়েছে নিউইয়র্কে। মুশকিল হচ্ছে শুধু যে বয়স্ক বা আগে থেকে শারীরিক সমস্যা রয়েছে—এমন ব্যক্তি মারা যাচ্ছে, তা নয়। অনেক তরুণ ও সুস্থ-সবল মানুষও ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়ার পর কাবু হয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে নিউইয়র্ক নগরের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের চিকিৎসক ডায়না টোরেস বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘রোগীদের বেশ ভালো মনে হলো, মনে হলে শঙ্কা নেই, তারপর আপনি অন্যদিকে মনোযোগী হলেন। ফিরেই দেখলেন যে, রোগী কোনো সাড়া দিচ্ছেন না।’
এই পরিস্থিতি এমনকি চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য ও জরুরি সেবাকর্মীদের মধ্যেও আতঙ্ক সঞ্চার করেছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করা আতঙ্কের মাত্রাটি সহজেই অনুমেয়। এই পরিস্থিতিই দাবি করছে, মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর, পরস্পরকে সাহস জোগানোর।
গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো যেমনটা বলেছেন, ‘প্রতিটি সংখ্যাই এক-একজন ব্যক্তি, একেকটি মুখ। তুলনামূলক দুর্বল ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষেরাই বেশি মারা যাচ্ছেন। একটি সমাজ হিসেবে আমাদের উচিত তাদের রক্ষায় একযোগে কাজ করা।’
গভর্নরের এই বক্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই ভয়াবহ সংকটের সময় যদি সবাই সবাইকে সাহসটা দেয়, একটা আশ্বাসের কথা বলে, সুপরামর্শ দেয়, একজনের দুর্যোগে অন্যজন এগিয়ে আসে, তবে এটি সামাল দেওয়া তুলনামূলক সহজ হবে। নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেক পরিচিত মুখ ঝরে যাচ্ছেন, যারা কমিউনিটির যেকোনো সংকটকালে মাঠে ছিলেন, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই মানুষগুলোর চলে যাওয়া সবাইকে ব্যথিত করছে। একই সঙ্গে এই সময়ই এমন কিছু মানুষকে সামনে নিয়ে এসেছে, যারা অন্যদের সহযোগিতায় কাজ করছেন নিরন্তর। বহু মানুষ নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অনলাইন বা ফোনের মাধ্যমে পরিচিতজনদের সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন। এটি অনেক বড় বিষয়।
সংখ্যার হিসাব যখন বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তখন আশাব্যঞ্জক তথ্যও কিন্তু আছে। গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো জানিয়েছেন, নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলোয় উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া লোকের সংখ্যা কমছে। আগের চেয়ে বেশি মানুষ এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি মেনে চলছে। ফলে ভাইরাসটি বিস্তারের গতি কমে এসেছে। তবে এখনকার মতোই আগামী কয়েক দিন মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। কারণ বর্তমানে যারা গুরুতর অসুস্থ, তাদের অনেককেই হয়তো ধরে রাখা যাবে না।
আমেরিকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেন, ‘আমরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। তবে আশার আলোও দূরে নয়। কারণ, গত দুদিন ধরে হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে সুস্থ হয়ে ফিরে যাওয়াদের সংখ্যা বেড়েছে।’
এগুলোই আশাবাদ। এই আশাবাদের কথাই এখন সবাই সবাইকে শোনানো প্রয়োজন। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিকে না তাকিয়ে থেকে কতজন সুস্থ হয়ে ফিরে গেল, তার সংক্রান্ত দিকে এখন বেশি তাকানো দরকার। দরকার চিকিৎসক, নার্স, জরুরি স্বাস্থ্যসেবাকর্মী থেকে শুরু করে সেই সব মানুষের দিকে তাকানো, যারা এই দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে সাহায্যের হাত। কারণ এই মানুষগুলোই আশার উৎস। এই ভয়াবহ সংকটে আশা ছাড়া আর কী বাঁচাতে পারে?