এই দুর্যোগ নিজের কাছে ফিরতে বলছে মানুষকে

নতুন করোনাভাইরাস যে বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে, তা মানুষকে নিজের দিকে ফিরতে বলছে। ছবি: রয়টার্স
নতুন করোনাভাইরাস যে বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে, তা মানুষকে নিজের দিকে ফিরতে বলছে। ছবি: রয়টার্স

নভেল করানোভাইরাস বর্তমান বিশ্বে ভয়ংকর এক ত্রাসের নাম। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আক্রান্ত আর মৃত মানুষের খবরে সয়লাব থাকে গণমাধ্যমগুলো। কানাডার পরবাসী জীবনে নিজের দুটি সন্তান ও চেনাজনদের সঙ্গে কানাডা সরকারের পাবলিক হেলথ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে হাত ধোয়ার, জনসমাগম থেকে দূরে থাকার ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষাসহ প্রাসঙ্গিক স্বাস্থ্য নির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করি।

নিজের স্বাভাবিক মানবিক আবেগকে প্রশমিত করে সব এড়িয়ে জীবনের নিয়মিত চেনা রুটিনে রপ্ত হতে পারছি না। প্রতিদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ যাচ্ছে টিভি চ্যানেল, পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালের নাম না জানা অগণিত মৃত্যু সংবাদে। আধুনিক মানুষ আমি। একবিংশ শতকের সভ্যতার উৎকর্ষ ও সুষমায় আলোকিত হয়েছি। পাশাপাশি অন্ধকারের নিষ্ঠুরতার তিক্ততায় দগ্ধ হয়েছি। মানুষের ওপর নির্যাতন, নারীর অবস্থান ও অবদানের প্রতি অবমাননা, শিশু নির্যাতন, ক্ষমতার মোহে নৃশংস লড়াই, ক্ষেত্রবিশেষে আধুনিকতার লেবাসে ব্যভিচার, পারিবারিক ও ব্যক্তিপর্যায়ে নির্বোধ প্রতিহিংসা, কপটতা, ধর্মের অপব্যাখ্যা, বিশ্বাসের অমর্যাদা, অসুস্থ ভোগবাদী প্রতিযোগিতা, স্বার্থের দম্ভ—সব মিলিয়ে অস্থির উন্মত্ততার জোয়ারে মানবসভ্যতার ক্লেদময় অধ্যায়ের কি কিছুটা অবসান হয়েছে এই প্রাণঘাতী কামড়ে?

চীন, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ অধিবাসী কি রাষ্ট্রনেতা কি সাধারণ মানুষ—কম-বেশি সবাই আজ আক্রান্ত। অধিকাংশ দেশই যাচ্ছে এক জরুরি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে।

আপাত অদৃশ্য জীবাণুর আক্রমণে অন্যদের মতো আমাদেরও অবরুদ্ধ, বিচ্ছিন্ন ও গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। স্মৃতির মণিকোঠায় আমার জীবনের নানা চিত্র উঁকি দিচ্ছে। কিশোরী বেলার দিন, খেলার সাথি তুলতুলে বেড়াল ছানারা, অধ্যাপক মায়ের ও আমার বই পড়ার ও সংগ্রহের প্রবল আকর্ষণ, মায়ের সর্বংসহা রূপ, শৈশবের ঢাকার সেগুন বাগিচার আবাসের দুই অংশে বড় দুটি আম ও একটি জলপাই গাছের গন্ধ, অজস্র পাখির কুজন, মায়ের কোলে শুয়ে রূপকথা আর হিতোপদেশ শুনে সর্ব শ্রেষ্ঠজন হওয়ার তাৎক্ষণিক নীরব প্রতিজ্ঞা, চিকিৎসক বাবার বাসার এককোণে এক্স-রে বিশ্লেষণের ভিউ বাক্স, নিকট বন্ধু পরিজনদের ভালোবাসা, একই সঙ্গে অনেকের ক্রমাগত মিথ্যাচার অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বি-মুখিতা থেকে জীবনের অন্ধকার স্বরূপকে উপলব্ধি করা, মায়ের কর্মসূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার নতুন নিবাস, কলেজজীবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, প্রেম ও প্রেমিক এহসানকে বইপ্রেমী করার প্রয়াসে দীর্ঘ সময় অজস্র বই উপহার, অতঃপর পারিবারিক সম্মতিতে শুভ পরিণয়, আব্বার সঙ্গে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের কথোপকথন, তাঁর প্রয়াণ ইত্যাদি বিভিন্ন দিক।

হ্যালিফ্যাক্স কানাডার প্রবাসী জীবনে আমাদের সংগ্রাম ছিল নিরন্তর। এর মধ্যেই আমার বাচ্চা দুটিকে নিয়ে নানা বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করেও সর্বশক্তিমানর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তবু প্রতিদিন হেসেছি। ওদের বিকাশ ও হাসির মধ্যে নিজের জীবনে নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সংযোগ। সংসারের নিত্য দায়িত্ব শেষে প্রতিদিন ভোরে বা অনেক রাতে যখনই সুযোগ মিলেছে লিখেছি। অশেষ কৃতজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি।

বর্তমানে করোনাভাইরাসের আগ্রাসী আক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকতে এই অবরুদ্ধ জীবনের দিনলিপির চিত্র ভিন্ন রকমের এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন শঙ্কিত হই এই বুঝি মরণ-কামড়ে সব সাঙ্গ হলো। মৃত্যু ধ্রুব সত্য জেনে যখন ঘর থেকে বিভিন্ন বর্জ্য ফেলার প্রয়োজনে দরজা খুলে বাইরে যাই, তখনো মনে হয় অদৃশ্য এই জীবাণু এই বুঝি ধরে ফেলবে আমাকে। সূর্যের আলোও আশ্বাস দেয় না কোনো। হ্যালিফ্যাক্স শহর ও এর পরিবেশ আচানক এক নিস্তব্ধতার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুগে আমরা সবাই অনেকটাই জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার আর ছুটে চলার প্রতিযোগিতায় কম-বেশি অভ্যস্ত। তবে ভাইরাস প্রতিরোধে বাধ্যতামূলক অবরুদ্ধতার রুটিনে অনেক ছন্দপতন হলেও ঘুমকাতুরে আমার ও বাচ্চাদের স্কুলের আয়োজনের তাড়াহুড়া নেই। দেরি করে ঘুম উঠছি। বহু প্রত্যাশার ঘুমের এই প্রাপ্তিতে এত কষ্টের মধ্যেও আনন্দে আপ্লুত হই। কানাডিয়ান বাংলা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় মানবিক দায়বদ্ধতা থেকেই প্রতিদিন বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপে তথ্য বিনিময় করি। কেউ যদি এর মাধ্যমে উপকৃত হন, তাতেই আমি সার্থক। কয়েকটি বইয়ের কাজ করছি। সেদিকে মনঃসংযোগ করা কিছুটা কঠিন হচ্ছে অবশ্য।

নিজেকে প্রায়ই প্রবোধ দিই যে, মহান সর্বশক্তিমান যেদিন জীবনাবসান নির্ধারণ করেছেন তাকে নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় নেই। তবে জীবনের অনিশ্চয়তার মধ্যেও আমাদের চেষ্টা করা প্রয়োজন—যে যার অবস্থান থেকে আগামীর প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহ করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার।

তবে এই ভয়াবহ ভাইরাসের আক্রমণ মানব সমাজকে এক সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা যতই ক্ষমতার দম্ভ ও শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করি না কেন, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষ এক। সর্বশক্তিমানের অপার মহিমা ও ক্ষমতার কাছে সবাই তুচ্ছ। মাত্রাতিরিক্ত ভোগসর্বস্ব বিভাজিত সংস্কৃতির নির্বোধ দাস হয়ে আমাদের এই বিরামহীন ছুটে চলা। অর্থ, বাড়ি, প্রতিপত্তি, কপটতা, নানা অনুষ্ঠান আয়োজন ও শ্রেষ্ঠত্বের সুখ্যাতির প্রত্যাশাকে এটি এক নিমেষেই মুছে দিতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে আমরা সোনার হরিণের সন্ধানে মরীচিকার পিছে বিরামহীনভাবে ছুটে প্রতিনিয়ত হারিয়ে ফেলেছি সুখের মূল মর্ম। বৈশ্বিক দুর্যোগ কি অনেক প্রাণ সংহারের মাধ্যমেও আমাদের মানবিক চেতনার প্রতিষ্ঠার দুয়ারে পুনরায় আঘাত হানছে না?

আমি বিশ্বাস করি এই গৃহবন্দী অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে সম্ভবত কিছুটা সময়ের জন্য হলেও আমি ভাবতে পারি আমাদের একান্ত পরিবারের বন্ধন ও প্রকৃত পরিজন ও প্রিয়মুখদের সান্নিধ্যে সুন্দর সম্পর্কগুলো উন্নত করা যায়। বাসার কোণে ছোট টবে নতুন ফোটা ফুলটির আগমনে সবাই মিলে একসঙ্গে নির্মল আনন্দ উপভোগের মতো দিকগুলো প্রায় ভুলতে বসেছে আধুনিক অনেক পরিবার।

এই দুঃসময়েও আমরা কিন্তু চেষ্টা করতে পারি পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় করে আত্মোন্নয়নের কয়েকটি ভালো বই পড়তে অথবা ঘরের অসমাপ্ত কাজগুলোর ইতি টানতে, ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা অনুসারে অনুশাসনগুলোর চর্চা করতে, শিশুদের নিয়ে ছবি আঁকতে, হাতে তৈরি খেলনার আয়োজন করতে কিংবা বিভিন্ন অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার গল্প লেখা বা কোনো রান্নার আয়োজন করে নান্দনিক বোধগুলোর বিকাশ ঘটাতে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আধুনিক সময়ে অনেক পরিবারের বাস্তবতা হলো একই ছাদের নিচে থেকে তাঁরা প্রায় অচেনা অথবা একে অন্যকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে দুরে সরে যাচ্ছেন। তাঁদের পরস্পরের কাছে ফেরার সময় হতে পারে এই ভয়ানক দুর্যোগই।

কানাডা সরকার এই দুর্যোগ মোকাবিলার অভিপ্রায়ে সব অধিবাসীর জন্য বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা নিচ্ছে। কানাডার অনেকেই নিজ উদ্যোগে নানা স্বেচ্ছাসেবী কর্মের মাধ্যমে খাবারসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করে সাহায্য করছেন নবাগত অভিবাসী, বৃদ্ধ ও অসহায় মানুষদের। আমার জীবনসঙ্গী এহসান হ্যালিফ্যাক্সে স্ব-উদ্যোগে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী দায়িত্ব পালন করছেন। বাসা থেকেই চলছে এ ফুড ব্যাংক কার্যক্রম।

আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশে এই ভাইরাস আঘাত হেনেছে। প্রবাস থেকে আমরা সঠিক স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারি। রাষ্ট্রনেতাদের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষিত সচেতন মানুষদেরও অনেক দায়িত্ব। অতি দরিদ্র বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সময় এটি। মানুষকে সর্বত্রই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে। দেশে বা প্রবাসে স্বল্প আয়ের মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেশে ও প্রবাসে অনেকেই নিজ উদ্যোগে অনেক কিছু করছেন। সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর্তমানবতার সেবায় কাজ করছেন। তাই করুণাময়ের ওপরে বিশ্বাস রেখেই আজও আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সুদিন সমাগত প্রায়।

মানবতার আদর্শদীপ্ত উজ্জীবিত আলোয় বিরাজমান নির্বোধ প্রতিহিংসা, অন্যায়, অবিচার, অনাচারকে সরিয়ে সৎ সুন্দর ও শুদ্ধ আলোকস্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত হবেই। প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া সুবোধের স্থান করে নেবে শুভ সুন্দর চেতনারা। সারা বিশ্বের অণুজীব গবেষক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন এই ভয়াবহ ভাইরাস নাশে একটি সঠিক প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে। সারে সারে এত মৃত্যুও কি আমাদের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোকে সামান্য হলেও জাগাবে না? আমরা সবাই কি এই সংকটে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পারি না আগামী প্রজন্মের জন্য একটি স্বাভাবিক মানবিক বিশ্ব গঠনের?