বিশেষ শিশু লজ্জার নয়, ভালোবাসার

মা–বাবা ও ভাইবোনের সঙ্গে জল (সবার বামে)
মা–বাবা ও ভাইবোনের সঙ্গে জল (সবার বামে)

যখন একটি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু জন্ম নেয়, তখন সংশ্লিষ্ট পরিবারের সে ব্যাপারে কোনো হাত থাকে না। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন কেন তিনি তাকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর তাই পরিবারকেই সবার প্রথম বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সেই শিশুকে স্বীকৃতি দিতে হবে। একই সঙ্গে এই সমাজকেও জানতে হবে এবং মেনে নিতে হবে যে, অটিজম আক্রান্ত শিশু লজ্জার নয়, ভালোবাসার। সঠিক সেবা ও ভালোবাসা দিয়ে এসব শিশুকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। মা–বাবার অনুপস্থিতিতে ভবিষ্যতে তাদের যেন কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে না হয়, সেভাবে তাদের তৈরি করতে হবে।
আজ জানব আমরা কাজী জহিরুল ইসলাম ও মুক্তি জহির দম্পতির মেয়ে জলের কথা। কাজী সারাফ জল, বয়স ১৭ বছর। জলের মা মুক্তি জানালেন, জলের ছোটবেলাটা কেটেছে ঢাকার নিকেতনে।
প্রতি মাসে অন্তত চার-পাঁচটা করে নতুন শব্দ বলত জল। আর এটা সে শুরু করেছিল নয় মাস বয়স থেকেই। কিন্তু ওই শব্দগুলো এক–দু মাস বলার পর হারিয়ে ফেলত। কিছু কিছু শব্দ সে রিপিট করত। কিন্তু কিছুদিন পর সেগুলোও ভুলে যেত। এর মাস তিনেক পর মুক্তি খেয়াল করলেন একা থাকতেই বেশি পছন্দ করছে জল। টেলিভিশন দেখছে। কিন্তু টেলিভিশন বন্ধ করলেই কান্নাকাটি শুরু করত। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক দেরিতে প্রায় পনেরো মাস বয়স থেকে হাঁটা শুরু করে জল। প্রায়ই মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে শব্দ করত এবং চিৎকার করে কান্না করত লম্বা সময় ধরে। এমন সময় মা হতবিহ্বল হয়ে ভাবতেন তাঁর মেয়ের হয়তো ক্ষুধা লেগেছে। তাই খাবার এনে দিতেন। তারপরও কান্না থামত না। এর পর খেলনা এনে দিতেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হতো না। সে সময় মায়ের স্পর্শ পাওয়ার জন্য মেয়ের কোনো অনুভূতিও কাজ করত না। কী করলে আদরের মেয়ের কান্না থামবে—এসব ভেবে চোখ জলে ভরে যেত মুক্তির।
জলের বয়স যখন এক বছর তখন মুক্তি চাকরিতে যোগ দেন। সে সময় পর্যন্তও মুক্তি কিছুই বুঝতে পারেননি। মা কাজে চলে গেলে সারা দিন বাসায় বেবি সিটারের সঙ্গেই থাকত জল। অনেক স্বপ্ন নিয়ে কাজ শেষে মুক্তি ঘরে ফিরে খেয়াল করতেন, ঝাঁপিয়ে পড়ে মাকে জড়িয়ে ধরা, সারা দিন দেখতে না পাওয়ার যে তৃষ্ণা, মাকে দেখে আনন্দিত হওয়া, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা, তার কোনোটিই জলের মধ্যে দেখতে পেতেন না মুক্তি।
জল একা খেলতে পছন্দ করত। সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলত না। নাম ধরে ডাকলে আই কন্টাক্ট বা কোনো ধরনের রেসপন্স করত না। আচার-আচরণেও বড় ধরনের পার্থক্য চোখে পড়ত। তখন জলের বয়স দেড় থেকে দু বছরের মাঝামাঝি।
এমন পরিস্থিতিতে মুক্তি তাঁর কিছু বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে এই ব্যাপারগুলো শেয়ার করলেন। বন্ধুরা সবকিছু শুনে ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলেন। তখন মেয়ের বয়স ছিল দু বছর। পরিবারের খুব কাছের লোকজন দোষারোপ করে বলেন, মুক্তি চাকরি করছে বলেই মেয়ের এই পরিণতি। তাই মেয়েকে বেশি সময় দিতে মুক্তি তাঁর চাকরিটি ছেড়ে দিলেন। এবার মায়ের যুদ্ধটা শুরু হলো।
তিন বছর বয়সে জলের (লেভেল মডারেট) অটিজম এক্সপেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার ডায়গোনোসিস হয়। মুক্তির অভিযোগ, ঢাকায় এসব শিশুর জন্য সেবা বা থেরাপির ব্যবস্থা ছিল সে সময় খুবই অপ্রতুল। বলতে গেলে আলাদা করে স্পিচ, অকুপেশনাল থেরাপি জন্য তখন থেরাপিস্ট ছিল না। সাড়ে তিন বছর বয়সে জলকে স্পেশাল নিড স্কুলে ভর্তি করা হলো। স্কুলে শুধু ইন্ডিভিজুয়াল অ্যাক্টিভিটি করাতো, যা কি না জলের প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুব নগন্য।
চিকিৎসক মুক্তিকে জানালেন, তাঁর মেয়ের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে স্পিচ, অকুপেশনাল থেরাপির প্রয়োজন। একই সঙ্গে তার রয়েছে অতি মাত্রায় সেনসরি বা সংবেনশীলতার প্রয়োজন।
পাড়া-প্রতিবেশীরা জলকে পাগল অথবা অসুস্থ বলত, বাঁকা চোখে তাকাত। এমনকি অনেক কাছের আত্মীয়রাও অ্যাবনর্মাল বলতে ছাড়ত না। মানুষের এমন অমঙ্গলসূচক, অলক্ষুণে কথা মুক্তিকে মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছিল। অনেক দিন উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে।
জল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে শব্দ করত এবং চিৎকার করতে করতে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দৌড়াত। নিউরোলজি চিকিৎসকের পরামর্শে সিটিস্ক্যান করার পর রিপোর্ট ভালো আসে। তারপর চিকিৎসক মৃগী (Epilepsy) রোগের ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। বেশ কিছুদিন জলকে ওই ওষুধগুলো দেওয়া হয়।
এরপর ওই চিকিৎসকেরই বেশ কিছু ক্লায়েন্টের অভিভাবকের কাছ থেকে মুক্তি জানতে পারেন, তাঁদের সন্তানদের জন্যও আগে এই ওষুধই দিয়েছিলেন তিনি। সেই ওষুধ সেবনের পর থেকে তাদের সন্তানদের অবস্থা আরো খারাপ হয়। এই কথা শোনার পর মুক্তি আর তাঁর বর আরও ভয় পেয়ে যান। তাঁরা তখন সিদ্ধান্ত নেন যে, ওই ওষুধ জলকে দেবেন না। কিন্তু ওই ওষুধ একবার শুরু করলে হঠাৎ করে বন্ধ করা যায় না। আবার রিভার্স করে ধীরে ধীরে কমিয়ে একটা পর্যায়ে গিয়ে তবেই তা বন্ধ করতে হয়।
এর পর জলকে চিকিৎসা করতে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানকার চিকিৎসক জানান, সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। শুধু থেরাপিই জলের জন্য উত্তম। বাবার চাকরির সুবাদে আইভরি কোস্টে যায় জল ও তার পরিবার। সেখানেও চিকিৎসক বলেন, জলের জন্য নেই সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা। মুক্তি আরও যোগ করেন, মেয়ের যথাযথ চিকিৎসার জন্য ২০০৯ সাল থেকে চার বছর লন্ডনে ছিলেন ছেলে অগ্নি ও মেয়ে জলকে নিয়ে। সেখানে একটা স্পেশাল নিড স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন মেয়েকে। আর সেই স্কুল থেকে স্পিচ, অকুপেশনাল, ফিজিক্যালসহ সব ধরনের থেরাপি পেয়েছিল জল।
এর পর মুক্তি তাঁর দু সন্তানকে নিয়ে ২০১৩ সালে চলে আসেন নিউইয়র্কে। এখানে লং আইল্যান্ডের গ্রেহ একাডেমিতে দশম গ্রেডে পড়ছে জল। একই সঙ্গে প্রয়জনীয় সব সার্ভিস ও থেরাপিগুলোও পাচ্ছে নিয়মিত। মুক্তি বলেন, মেয়ে এখন আগের থেকে অনেক ইম্প্রুভড। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ঘরের মেঝেতে দৌড়া-দৌড়ি করে না। চিৎকারও করে না, কান্নাও করে না। আপন মনে ওর নিজস্ব ভাষায় একা একাই কথা বলতে থাকে। তবে মাঝেমধ্যে মধ্যরাতে বাথরুম ব্যবহার না করেও বারবার ফ্লাশ করতে থাকে।
জল নিজে থেকে কথা না বললেও কমন কিছু ইনস্ট্রাকশন দিলে তা সে ফলো করে। পরিবারের সবাইকে চেনে। খাবারে নেই কোনো অপছন্দ। এ ছাড়া টেলিভিশন দেখা ও গান তার প্রিয়। মাঝেমধ্যে নিজস্ব শব্দ দিয়ে গান বানিয়ে গেয়ে শোনায় মা-বাবাকে। এখন জল দৈনন্দিন কাজের অনেক কিছুই নিজেরটা নিজেই করতে পারে। বেশির ভাগ সময় তাকে সুপারভাইজ করতে হয়।
মুখ ভার করে মুক্তি বলেন, সব সময়ই পাড়া-প্রতিবেশীরা কটুকাটব্যের তির ছুড়ে দিতেন তাঁর দিকে। এসব কটুকথা শুনে খুব কষ্ট পেতেন আর ভাবতেন মা হিসেবে তিনি যে কঠিন দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছেন, তা আশপাশের কেউই একটুও বোঝার চেষ্টা করল না!
শুধু তাই নয় পরিবারের খুব আপন সদস্যরাও জলের মাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতেন। জানতে চাইতেন কবে কথা বলবে জল ? রাগে, দুঃখে, অভিমানে মনে মনে মুক্তি নিজেই নিজেকে পশ্ন করতেন—তাকেই কেন সবাই এসব প্রশ্ন করে?
উত্তর যে তাঁর জানা নেই। তবে মা হিসেবে তাঁর বিশ্বাস তাঁর মেয়ে জল একদিন সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হবেই।