স্টে হোম-এর বিড়ম্বনা

নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য যখন ২২ মার্চ রাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা দিলে আর কেউ না হোক, আমি অনেক খুশি হলাম। এই ভেবে যে, কর্ম জীবনে এ রকম টানা ছুটি আর পাইনি। ঘরে বসে থাকব আর আমার প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক বেতন দেবে। কোন ঝামেলা নেই। ঘরে বসে খাব আর যা ইচ্ছে তাই করতে পারব। পারিবারিক পিকনিক বা পারিবারিক হানিমুন। আগে নিজের পাওনা ছুটি নেওয়ারর জন্য কত বাহানা করে নিতে হত। একলা ব্রাঞ্চের দায়িত্বে থাকায় এই ঝামেলা আর কি!

আমার ছুটির দিন শুরু হল হালকা ঠান্ডা জ্বর দিয়ে। ভাবলাম, শরীরটা একটু ভালো করে অন্য কাজ ধরব। শুরু হলো পারিবারিক বিপত্তি। মাসে ৩০ ডলারে আনলিমিটেড টাইম মোবাইলে থাকায় মনে হলো, এই বন্ধে সবার সঙ্গে থাকা সম্পর্কগুলোকে একটু রিনিউ করে নিই। আর এ থেকেই শুরু হলো কাছে থাকা পরিবারের আপন মানুষগুলোকে নতুন করে চেনা। আগে জানতাম, পরিবারের বয়স্ক মানুষ পরিবারে বোঝা হয়! কিন্তু এই আমি কী দেখলাম। দীর্ঘদিন পরে ছুটি পাওয়া আমি হয়ে গেলাম সবার বিরক্তির কারণ! ইনস্যুরেন্স এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করা আমার স্বামী ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ আর বড় মেয়ে ‘সফট ওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং’ ছাত্রী হিসেবে অনলাইন ক্লাস করে। ফোনে কথা বলার দুদিনের মাথায় তাদের আপত্তি।

বাপ-মেয়ে দুজনের জন্য দুই রুম থাকার পরও লিভিং রুমে কথা বললেও তাদের নাকি ডিস্টার্ব হয়! যাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে যাই, তাদের অনেকের সঙ্গেই দেখা গেছে ১৫/২০ বছর পর কথা বলছি। অত বছর পর কথা বলায়, একটু বেশিই বলা হয়ে যায়। তো কথা বলার দুই দিনের মাথায় স্বামী বলে, কী শুরু করছ তুমি। এত কথা কি কেউ বলে? 

ওকে বললাম, দেখ, যেহেতু অনেক বছর পর বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলা, একটু বেশি কথা বলা হয়। কই আছিস, কি করিস, ছেলেমেয়ে কয়টা, কী করে—এসব আর কি! বড় মেয়ে বলে, মা তুমি তো কথা বলতে বলতে পাগল হয়ে যাবা।

স্বামী আর বড় মেয়ের আপত্তিতে চেঞ্জ করলাম ট্র্যাক। শুরু করলাম পুরোনো গুণাবলি ঝালাই। সকালে কোরআন শরিফ নিয়ে বসলে, বিকেলে হারমোনিয়াম। তাতেও তাদের ডিস্টার্ব। এবার শুরু করলাম ছোট মেয়ের সঙ্গে টিভি দেখা। সময় কাটবে। সে এবার বলে উঠল, মাম্মি তুমি সারা দিন আমার কাছে থাক কেন? ডিস্টার্ব হয় আমার। আমার সাড়ে বারো বছরের মেয়ের কথা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। মনে পড়ল, কত দিন অফিসের কাছে বাসা হওয়ায় মেয়েকে স্কুলের পরে বাসায় রেখে অফিসে যেতে হয়েছে। মেয়েকে একা ১২ তলার ওপরে ঘরে রেখে আসার সময় কত রক্ত ঝরেছে হৃদয়ে!

দীর্ঘ ২০ বছরে ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামীর সঙ্গে যে ঝগড়া হয়নি, এই স্টে হোমের কারণে তাও হয়ে গেল। এবার কুকিংয়ের পালা। উইক ডে’তে সিরিয়াল-পাউরুটি নাশতায় চললেও উইক–এন্ডে ভাবলাম, একটু অন্যরকম ব্রেকফাস্ট হলে ভালো হয়। আগে চাকরি করার কারণে স্বামী অনেক সাহায্য করত। এখন আমার কাজ নেই বলে তিন বেলা রান্নার দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। এমনকি বিকেলের চা–টুকু বানাতে চায় না। করোনা মহামারির ভয় না থাকলে নিশ্চিত রাগ করে ভাইদের বাসায় চলে যেতাম, এখন তো সেটাও সম্ভব না!

বিশুদ্ধ বাতাসের অজুহাতে যখন অ্যাপার্টমেন্টের কমপ্লেক্সে যেতাম তখন সাদা, গোলাপি ফুটে থাকা চেরি ফুল দেখে মন হালকা করতাম। আর মনে মনে হায়দার হোসেনের মতো গাইতে ইচ্ছে হতো—‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে গিয়েও করিতে পারিনি চিৎকার’।