চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার পাহাড়

স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় হঠাৎ করেই যেন অদৃশ্য ঝড়ের তাণ্ডবে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতার লাইনগুলোর মতো। ‘ভাঙ রে হৃদয়, ভাঙে বাঁধন, সাধ রে আজিকে প্রাণের সাধন,

 লহরীর পরে লহরী তুলিয়া, আঘাতের পরে আঘাত কর।’ আঘাতটি করোনাভাইরাসের। অদৃশ্য এই ভাইরাস পাল্টে দিয়েছে অনেক কিছু। অনেক স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। সামনে যেন এক অসীম শূন্যতা, অনিশ্চয়তার সীমাহীন হাহাকার!

করোনাভাইরাসে আমেরিকায় মৃত্যুর সংখ্যা ৭৫ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ১২ লাখের বেশি মানুষ। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ঠিক কোথায় গিয়ে থামবে, সেটা ঠিক কেউই বলতে পারছে না।  সেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পাল্লায় আরেক ভয়ংকর তথ্য হলো, দেশটির সবচেয়ে ব্যস্ততম রাজ্য নিউইয়র্কের ৯ লাখ কর্মজীবী জুন মাস শেষ হওয়ার আগেই কর্মহীন হয়ে পড়বেন। লকডাউনে থাকা নিউইয়র্ক ধাপে ধাপে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনাও চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ রয়েছে। নিউইয়র্কের কম্পট্রোলার অফিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউইয়র্কের কর্মজীবীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের একজন চাকরি হারাবেন।

কম্পট্রোলার স্কট স্ট্রিঙ্গার বলেছেন, মহামারি শুরু হওয়ার আগে নিউইয়র্কে কর্মহীনের সংখ্যা ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগে মহাদুর্দিনেও নিউইয়র্কের সর্বোচ্চ কর্মহীন লোকের সংখ্যা ছিল ১০ দশমিক ১ শতাংশ। এবার তা ২২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি আমেরিকানরা। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে ৫০ দিনে প্রায় আড়াই শ বাংলাদেশি মারা গেছেন। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ। বেশির ভাগ বাংলাদেশি আমেরিকান ক্যাবচালনা, ফুড ডেলিভারি, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল ও গ্রোসারি দোকানে কাজ করে থাকে। এঁদের ৯০ ভাগ কর্মীজীবী মানুষ কাজ হারিয়ে এখন ঘরবন্দী। সমস্যার এখনেই শেষ নয়! বেকারভাতার জন্য আবেদনকারী কর্মহীন মানুষ দীর্ঘ অপেক্ষার পর পাচ্ছেন না সেই সুবিধা। যার কারণে তৈরি হচ্ছে আরও গভীর সংকট। ইতিমধ্যে অনেকের ঘরে দেখা দিয়েছে খাবারের সংকট। আর যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরা আছেন মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে।

এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা জীবনযুদ্ধে টিকে আছেন তাদের অবস্থাও করুণ। বিশেষ করে যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই। করোনাযুদ্ধের আগে স্বপ্নের এই দেশে যখন পাড়ি জমিয়েছেন, তার আগেই ‘সাত সাগর তেরো নদী’ পাড়ি দিয়ে আমেরিকা আসার পর এখন আরেকটি বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধে লড়ছেন। কাগজপত্রহীনদের মধ্যে বাংলাদেশি আমেরিকানের বেশির ভাগই অর্থ সংকট, বাসা ভাড়া, চাকরি হারানোর ফলে দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। বিভিন্ন প্রবাসী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বিপদগ্রস্ত  ব্যক্তিদের সহায়তা করা হচ্ছে। কিন্তু নথিপত্রহীন অভিবাসীদের খুব বেশি তথ্য না থাকার কারণে, অনেকে না খেয়েও কষ্টের জীবন কাটাচ্ছেন।

মানবিক নগর নিউইয়র্ক অমানবিক হয়ে ওঠেনি মানবতার এই চরম সংকটেও। ৩১১–এ ফোন কল করলেও বৈধ–অবৈধের কথা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে না। নগরের বেশ কয়েকটি সেবা সংস্থা এগিয়ে এসেছে। যোগাযোগ হলেই তারা সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, নিউইয়র্কের মতো বড় নগরে নথিপত্রহীনদের পর্যাপ্ত তথ্য নেই কারও কাছে। এর মধ্যে বাংলাদেশি যারাই আছেন, তারা হয়তো কারও আশ্রয়ে আছেন। কাগজপত্র না থাকার কারণে এসব অভিবাসী স্বাভাবিক কারণেই অন্তর্মুখী থেকেছেন। নগর বা কমিউনিটির সুবিধা প্রাপ্তির জন্য যোগাযোগের তথ্যও তাদের কাছে নেই। নিউইয়র্কে বাংলাদেশি নানা সংগঠন এসব মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।

প্রায় ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যুর উপত্যকায় দাঁড়িয়ে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য ধাপে ধাপে খুলবে, এমন কথাই বলা হচ্ছে। সদা ব্যস্ত এ নগরীর লাখো লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে। চিরতরে বন্ধ হয়ে পড়তে পারে নানা ব্যবসা–প্রতিষ্ঠান। জীবনের নানা পথ পাড়ি দিয়ে যারা স্বপ্নের এ নগরে স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন, কি হবে তাদের? নতুন এক বাস্তবতায় জীবন মরণ সংকট আর স্বপ্ন যাত্রার সংঘাত এখন চরমে। লকডাউনের নগরে এমন জটিল প্রশ্ন আজ ঘুরপাক খাচ্ছে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর মনে।