ভিন্ন এক মা দিবসের গল্প

প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় দেবতাদের মা ‘রিয়া’ ও ‘কিবেলি’–কে অর্চনার মধ্য দিয়ে মা দিবসের সূচনা হলেও বর্তমানে পুরো বিশ্বে প্রতিটি মায়ের জন্য এই দিবস পালন করা হয়। কিন্তু অন্য বছর থেকে এই বছরের মা দিবস ছিল একেবারেই ভিন্ন।

আট সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আমরা বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে আছি। ভয়াবহ করোনা সংকটে বাইরে বেরোনোই যেন আতঙ্কের বিষয়। চারদিকে মহামারি ও মৃত্যুর মিছিল। মানুষ যখন ঘরবন্দী, লকডাউনের কারণে প্রিয় মায়ের সঙ্গেও দেখা করতে যেতে পারছে না অনেকে। কোভিড–১৯ আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে এক নতুন ধাঁচে ফেলতে বাধ্য করেছে—এই সত্যটি নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। ছুটির দিনগুলোও ব্যতিক্রম নয় এখন আর। অতীতের তুলনায় এই বছর অবশ্যই অনেক দিক থেকেই আলাদা।

রোববার মা দিবস পালিত হলো ভিন্নভাবে। প্রতিবারের মতো মাকে জড়িয়ে বা ফুল–কেক নিয়ে উপস্থিত হতে পারেনি অনেকে। তবে জুম, ফেসটাইম ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে মা দিবস পালন করেছেন কম–বেশি সবাই। কেউবা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে মা বা গ্র্যান্ডমায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন; ছয় ফুট দূরে দাঁড়িয়ে, জানালা দিয়ে হ্যালো বলছেন।

টপক্যাশব্যাক ডটকমের সাম্প্রতিক জরিপের তথ্যমতে, প্রায় ৬৫ শতাংশ আমেরিকান এই মা দিবসে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেছেন।

আমাদের বাঙালিরাও এই মা দিবস পালন করেছেন তাঁদের মতো করে। এ নিয়ে লেখক, সাংবাদিক এইচ বি রিতা জানালেন, ‘মাকে ভালোবাসতে বিশেষ কোনো দিনের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রতিদিন আমি মায়ের যত্নে এবং প্রশংসায় জানান দিই যে—মা তোমাকে খুব ভালোবাসি।’

এই দিনটিতে আমার মায়ের খুব মন খারাপ থাকে। কারণ, এই দিনে তিনি সন্তান হারিয়েছেন, নিজের মাকে হারিয়েছেন। এই দিনটি এলেই কাঁদতে থাকেন। আমি আমার মাকে বলিনি যে, আজ মা দিবস! আমি চাইনা তিনি কান্না করুন। কারণ, আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর পানি হচ্ছে আমার মায়ের চোখের পানি। মা আমার পরিকল্পনা করেছেন যে, দীর্ঘদিন পর বিল্ডিংয়ের নিচে যাবেন সবজি বাগান করতে। বাগান করতে গিয়ে তিনি এটা-ওটা খুঁজে পাবেন না, চিৎকার করবেন, ট্রাম্পকে গালি দেবেন... আর আমি শুধু মায়ের প্রাণোচ্ছ্বল মুখটা তাকিয়ে দেখব! তারপর ভাবব—এই মানুষটা চলে গেলে, কে আমার সঙ্গে চিৎকার করবে।

সাংবাদিক রওশন হক বলেন, ‘আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হলেন আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সমস্ত অর্জন তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া—নৈতিকতা, বোকামি ও বুদ্ধিমত্তা। আর ক্লান্তিহিন শারিরীক পরিশ্রম ও মাল্টিটাস্ক করাটাও আমি মায়ের কাছ থেকেই শিখেছি। ছোটবেলা থেকে দেখেছি মাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে। করোনার সময়ে আমার মা দেশে। আমরা চার ভাইবোনের সবাই মায়ের কাছ থেকে দূরে। প্রকৃতির এই কঠিন সময়ে মা তাঁর নাতি আর ছেলের বউ নিয়ে ঘরবন্দী জীবন পার করছেন এবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে। কষ্ট আর আতঙ্ক নিয়ে দূর থেকে মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলি আর পার্থনা করি—পৃথিবীর সব মায়েরা যেন ভালো থাকেন।’

সাংবাদিক মনিজা রহমানের কাছে মা দিবস নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘এই মহামারিকালে কোথাও বের হওয়ারর সুযোগ নেই। তবু যদি কখনো কানে দুল পরি, আমার বড় ছেলে প্রশ্ন করবে—“আম্মু, তুমি কোথায় যাচ্ছ?” মাথার চুল আঁচড়ালে ছোট ছেলে জুতা নিয়ে ছুটে আসে—মা মনে হয় বাইরে যাবে। মা চাকরি করলে বেশির ভাগ সন্তান হয়তো অখুশি হয়, কিন্তু আমার ছেলেরা খুব আনন্দিত হয়। কারণ, মা তাহলে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবে। রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে পারবে! দুই ছেলেকে নিয়ে এই প্রবাসে আমার লড়াই আমার সংগ্রাম। যত দিন মা ছিলেন, মা দিবসের বিশেষত্ব ছিল, এখন আর নেই। প্যালেস্টাইনি আমেরিকান গায়ক মাহের জেনের গাওয়া “অনলি ওয়ান ফর মি” গানটা এক মা দিবসে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম মায়ের উদ্দেশ্যে। মা সারাদিন বারবার ওই গানটা শুনেছিলেন। আগের দিবসগুলোতে মাকে নিয়ে কিছু বললে, মা আমাদের বাসার ভাড়াটিয়া খালাম্মাদের বাসায় ডেকে দাওয়াত দিয়ে আয়োজন করে ওই লেখা পাঠ করতেন। ২০১৯ সালে মা মারা যাওয়ার পর এখন আর কিছু লিখি না। আসলে হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালো লাগে না।’

লেখক শেলী জামান খান বলেন, ‘আমাদের মায়েরা আকাশের মতো উদার। ফুলের মতো সুন্দর। মধুর মতো মিষ্টি। ভোরের আলোর মতো স্নিগ্ধ। বিকেলের রোদ্দুরের মতো কোমল। বৃষ্টির ফোটার মতো উচ্ছ্বল। আমরা যখন শিশু ছিলাম, এই মায়েরা আমাদের আগলে রেখেছেন আদর, যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে। আমরা বড় হয়ে গেছি। তাঁরা এখন শিশু হচ্ছেন। এখন আমাদের পালা। তাঁদের আদর দিয়ে, যত্ন দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার পালা।’

মায়েদের মুখের এই মধুর হাসি অমলিন হোক। ঠোঁটের হাসিটি অটুট থাকুক চিরকাল। জগতের সব মমতাময়ী মায়েদের জন্য অজস্র ভালোবাসা। যদিও করোনার কারণে এবার দিবসটিতে তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা দেখা যায়নি। তারপরও প্রতিটি মানুষ নিজেদের মতো করে পালন করেছে মা দিবস। প্রতিটি মায়ের জন্য রইলো শুভকামনা। আর যেসব মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে, তাঁদের জন্য রইল অনেক দোয়া। ওপরেও যেন ভালো থাকেন আমাদের মায়েরা।