মহামারি বনাম ইকোনমি

সেই ১৭২০ সালে ফ্রান্সের মার্সেই (ফরাসি মাখ্সেই) বন্দরে একটা জাহাজকে ‘কোয়ারেন্টিন’ করা হয়। কারণ, খবর এসেছিল, কী এক সংক্রামক রোগে নাকি জাহাজের লোকগুলো একধার থেকে মারা পড়ছিল। কিন্তু সেই ভয়ে জাহাজের মালামাল নামিয়ে দেশের মধ্যে বিলি করতে না পারার কারণে ‘ইকোনমি’ প্রায় ধসে পড়ে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যকে বাঁচানোর জন্য মার্সেইয়ের ডেপুটি মেয়র ‘কোয়ারেন্টিন’ উঠিয়ে নেন। কারণ সরকার তখন মনে করেছিল, জাহাজভর্তি যত সব মূল্যবান সামগ্রী আছে, সেগুলো বাতিল করে দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। যদি তা করা হয়, তাহলে সত্যি সত্যিই ইকোনমি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে কোয়ারেন্টিন উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং জাহাজ থেকে মালপত্র সব নামিয়ে শহরের বাজারে সেগুলো সাপ্লাই দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেভাবেই মালামালের সঙ্গে সঙ্গে ওই সংক্রামক রোগকেও জাহাজ থেকে শহরে নামানো হলো।

এই মার্সেই শহরটি ফ্রান্সের দক্ষিণ প্রান্তের একটি বন্দর নগর, অনেকটা আফ্রিকার নাইজেরিয়ার লাগোস শহরের মতো। যাই হোক, ওই প্লেগের পালা যখন মোটামুটি শেষ হলো, তত দিনে ৯০ হাজারের মধ্য থেকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সাবাড় হয়ে গেছে। অনুপাত করলে অনেকটা লাগোসে ১ কোটি লোক মারা যাওয়ার মতো।

এরপর খালি জাহাজটি লেবাননের সিডন শহরে যায়, সেখান থেকে লিবিয়ার ত্রিপোলি এবং সাইপ্রাস থেকে মানুষ ও মালামাল তোলে। কিন্তু সাইপ্রাসে অলরেডি ওই সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। জাহাজের মধ্যে প্রথমে একজন তুর্কি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

জাহাজের ডাক্তারও মারা যায়। জাহাজটি যখন মার্সেইতে আসে, তখন ডাক্তার সম্প্রদায় এটিকে কোয়ারান্টিন করে। সে সময় মার্সেই ও ‘লেভ্যান্ট’-ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ব্যাপক ও গভীর বাণিজ্যচুক্তি ছিল। ইদানীং আইসিস নামে বহুল প্রচারিত শব্দের সঙ্গে ‘কান টানলে যেমন মাথা চলে আসে’, সেভাবে ‘লেভ্যান্ট’ শব্দটি চলে এসেছিল। শব্দটি তখন ইরাক, সিরিয়া ও কিছুটা লেবানন এলাকা বোঝালেও, প্রকৃতপক্ষে লেভ্যান্ট বলতে বোঝায় ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, সাইপ্রাস, তুরস্ক, ইসরায়েল, জর্ডান ও ফিলিস্তিন—এসব দেশগুলোর সমষ্টি।

এসব দেশের বাণিজ্যিক প্রতিনিধিরা মার্সেইয়ের সরকারকে যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝায় এবং প্রভাবিত করে এই পয়েন্টে যে, জাহাজের মালগুলো নামানোই সংগত হবে। শহরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে ডেপুটি মেয়র নিজেও একজন ছিলেন এবং স্বয়ং ওই জাহাজের মালিক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ব্যবসায়ীরা সরকারের মধ্যে তাঁদের যে সব বন্ধুবান্ধব ছিল, তাদের রাজি করান ‘কোয়ারেন্টিন’ উঠিয়ে নেওয়ার জন্য। এদের মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী ছিলেন যাঁদের জাহাজ থেকে কাপড় ও সিল্ক নামানো খুবই দরকার ছিল। কারণ আসন্ন ‘বিউকেয়ার’ উৎসবে ওই সব মাল সাপ্লাই দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁদের ঘাড়ে। আর এভাবেই মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সারা মার্সেই শহরে রোগটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ল। এত মানুষ মারা গেল যে, শহরে তাদের কবর দেওয়ার মতো জায়গায়ই আর অবশিষ্ট রইল না। রাস্তাঘাটে মৃতদেহ পড়ে থেকে থেকে পচে যেতে লাগল। সেই ভয়াবহ দৃশ্য আজও মার্সেইয়ের মানুষেরা মনে রেখেছে।

অনেকে মনে করে, এখানে সরকার একটি চালাকির আশ্রয় নিয়েছিল। তারা নিজেদের এই বলে বুঝিয়েছিল, ‘আমরা জাহাজ থেকে কেবল সুতো, কাপড় আর সিল্কগুলো নামাব। কিন্তু রোগাক্রান্ত মানুষগুলোকে নামাব না। তাহলে তো জাহাজ থেকে দেশে ওই রোগ আসতে পারবে না।

হায়! তারা বুঝতে পারেনি যে, সুতো, কাপড় ও সিল্কগুলো নামাতে গিয়ে তারা ওর ভেতরের ইঁদুরগুলোকেও নামিয়েছিল। সেই ইঁদুরগুলোই আবার শহরের মানুষকে সংক্রামিত করে। একজন দুজন সংক্রামিত হতে হতে তারা পরস্পর পরস্পরকে সংক্রামিত করতে শুরু করে।

এভাবেই পুরো মার্সেই শহর সংক্রমিত হয়ে যায়। অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, শেষ পর্যন্ত ফরাসি সরকার বাকি দেশটাকে বাঁচাতে মার্সেই শহরকে আলাদা করতে একটা দেয়াল তৈরি করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কারণ, ইতিমধ্যে ১০ হাজার সংক্রামিত মানুষ অন্যান্য শহরে ঢুকে পড়েছে এবং তাতে মার্সেইয়ের বাইরে ৫০ হাজার মানুষ মারা গেছে।

‘গ্রেট প্লেগ অব মার্সেই’ তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল। মার্সেই ও খোদ ফ্রান্সের জন্য এটি এক ভয়ংকর সময় ছিল। হাসপাতালগুলোতে আর রোগী ধরানোর জায়গা ছিল না। নগরবাসী বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিল। রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থেকে পচতে শুরু করেছিল। রোগটি শেষ পর্যন্ত চতুর্দিকে এতটাই ছড়িয়ে পড়ল যে, তখন লোক আর ‘ইকোনমি’ নিয়ে মাথা ঘামাল না। ও নিয়ে আর কোনো কেয়ারই করল না।

এর থেকে অনেকে শিক্ষা নিতে বলছে। এটা নাকি একটি মোক্ষম ওয়ার্নিং। মানুষের প্রাণ ও জনস্বাস্থ্যের চেয়ে ইকোনমিকে গুরুত্ব দেওয়া নাকি কখনো উচিত নয়। সেটি নাকি মস্ত বড়, সাংঘাতিক একটি ভুল।