বেঁচে থাকাটাই এবার ঈদ

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে নিউইয়র্ক নগরীর পথঘাট এখনো ফাঁকা। নগরের বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে নিউইয়র্ক নগরীর পথঘাট এখনো ফাঁকা। নগরের বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ছবি: রয়টার্স

আর কয়েকদিন পরই ঈদ। রমজানের শুরুতে করোনার কারণে যখন জীবন দোদুল্যমান, ঠিকমতো বাজার করারও উপায় নেই, তখন স্থানীয় গ্রোসারি দোকানের কাছ থেকে যে সেবা পাওয়া গেছে, তা এক কথায় দারুণ। এই সময়ে পেন্ডুলামের এক পাশে জীবন আরেক পাশে মৃত্যু। আমার হাজবেন্ডের জন্য গ্রোসারিতে যাওয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশি গ্রোসারিতে যাওয়া কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। এমন অবস্থায় ব্রুকলিনের গ্রিন হাউস গ্রোসারির জাহাঙ্গীর ভাই তালিকা নিয়ে সব প্যাক করে রেখে খবর দিয়েছেন; ছেলে গিয়ে ফোন দিলে সদাইপাতি গাড়িতে তুলে টাকা নিয়ে যেতেন দোকানের কর্মচারীরা। মাস্ক–গ্লাভস পরা সব কর্মচারীই এ সময় ভীষণ সচেতন থাকতেন। কেউই এখন আর কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নন।

স্কুল বন্ধ দিয়ে পরের সপ্তাহে ল্যাপটপ দেওয়ার জন্য, আর গ্র্যাব অ্যান্ড গো'র জন্য ক্যাফেটারিয়া খোলা রাখায় মর্মাহত হয়ে আমি লিখেছিলাম—গাধা জল খায় ঠিকই, ঘোলা করে খায়। সরকারি অর্থ সহায়তা কার্ডের মাধ্যমে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা যেত আগেই। শেষ পর্যন্ত কিছু প্রাণের বিনিময়ে সে পথেই তো এল প্রশাসন। এখন প্রতিটি স্কুলগামী শিক্ষার্থী, যারা বিনা মূল্যে খাবার পেত, তাদের সরকারি সহায়তা হিসেবে ৪২০ ডলার দেওয়া হবে কার্ডের মাধ্যমে।
আসলে আমেরিকায় সামনের দরজা বন্ধ, আর পেছনের দরজা খোলা রেখে যে মারাত্মক ভুল করল, তার মূল্য হিসেবে আমরা হারালাম ৯০ হাজারের বেশি মানুষকে। মৃত্যু চিরন্তন এক সত্য। কিন্তু আচমকা এত মৃত্যু আমেরিকার মতো দেশে রীতিমত অবিশ্বাস্য। উন্নত স্বাস্থ্যসেবাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেন কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক প্রাণ।
লকডাউন আর হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে থাকতে মানুষের অনেক ইতিবাচক দিক প্রকাশ পাচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, রান্না ও ঘর পরিষ্কার করা, বই পড়া, গান শোনা বা গাওয়া, লেখালেখি ও ক্রিয়েটিভ কিছু করা, বাগান করা, ধর্ম পালন, আঁকাআঁকি করা—এই সবই এখন অনেকের মনোযোগ পাচ্ছে। এর মধ্যে হয়তো কিছু নেতিবাচক দিকও তৈরি হয়েছে কারও কারও মধ্যে। ঝগড়া বিবাদও হচ্ছে। তবে পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে এভাবে থাকার সুযোগ আমাদের খুব কমই হয়েছে। এ সময় ১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ে যায়। সে সময় আমরা একসঙ্গে নয় মাস কাটিয়ে ছিলাম নানা উৎকণ্ঠায়। সে সময় শত্রু ছিল পাকিস্তানি সৈন্য, যা দৃশ্যমান। আর এখন শত্রু আমাদের অদৃশ্য, করোনাভাইরাস।
নিউইয়র্কে দক্ষিণ এশীয়দের অধিকার-মর্যাদা নিয়ে কর্মরত সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসে মৃতদের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্প্যানিশ ও আফ্রিকান বলা হচ্ছে। এর পর রয়েছে শ্বেতাঙ্গ ও এশীয়। সিটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯ মে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৬ হাজারের বেশি মৃত্যুবরণকারীর মধ্যে এশীয় ছিলেন ৮৩০ জন। এই এশীয়র মধ্যে বাংলাদেশী কতজন তা সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। অনেকেই এখনো ইন্ডিয়ান হিসেবে তালিকাভুক্ত।
ব্রুকলিনে বাংলাদেশি অধ্যুষিত চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড এলাকার সংগঠক শাহানা হানিপ বলেন, 'প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই শুনি করোনায় বাংলাদেশিদের মারা যাওয়ার দুঃসংবাদ। তাই সিটির যে ডাটা তৈরি করা হয়েছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। এ জন্য আমাদের লোকজনের তালিকা আমাদেরই তৈরি করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশিরা যে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ভিকটিম, সেটি আড়ালেই থেকে যাবে।'
আরেক সংগঠন 'বাপ'-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মৌমিতা আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'বেশ কয়েকজন রোগীর অনুবাদক হিসেবে আমি আমার কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, রোগীদের অনেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। কী ধরনের কষ্ট পাচ্ছেন অথবা কত দিন ধরে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন— সেটিও বলতে পারছেন না অনেকে।'
সুতরাং যারা বাংলাদেশি কমিউনিটির উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের ভাষাগত উন্নয়ন নিয়ে প্রথম কাজ করতে হবে বলে পরামর্শ দেন মৌমিতা আহমেদ। তাঁর আহ্বান হচ্ছে, অনুবাদক ও ভাষা সহায়তা থেকে কেউ যেন বঞ্চিত না হয়, সেদিকটা নিশ্চিত করতে হবে।
যদিও মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তি শুধু একটি সংখ্যা কেবল, তার পরও অনেক কথা থাকে। ভাইরাসটি কোন ধরনের মানুষের বেশি ক্ষতি করেছে, তার

কারণ কী, এদের বসবাসের তরিকা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসচেতনতা—সবকিছুই গবেষকদের গবেষণার বিষয়বস্তু হবে। তাই আসন্ন আদমশুমারিতে সঠিকভাবে তথ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে কেউ ভুলবেন না। ঈদ বেঁচে থাকলে আবার মিলেমিশে করা যাবে। এবার ঘরেই থাকুন। বেঁচে থাকাটাই এবার ঈদ। সবার জন্য ঈদের শুভেচ্ছা।