'ট্রাম্প আমেরিকানদের বিভাজিত করছেন'

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন নয়, পুলিশের গাড়ির সাইরেনে আমেরিকার বড় বড় নগরীর রাত কাটছে এখন। ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ আর লুটপাটের বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে আমেরিকার নাগরিক আন্দোলন নতুন মাত্রা পাচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের উচ্চারণে এখন শুধু পুলিশের হাতে নিহত জর্জ ফ্লয়েডের বিচার নয়, জনতার দাবিও বিরাট হয়ে উঠেছে। স্থানে স্থানে সামাজিক সাম্যের দাবিতে রাস্তায় অবস্থান করছেন বিক্ষোভকারীরা। কারফিউ ভেঙে চলছে ক্ষুব্ধ মানুষের উত্তাল আন্দোলন। এ অবস্থায় নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে সেনা মোতায়েনের হুমকি দিয়ে এখন সব পক্ষের ছোড়া সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

সপ্তম দিনের মতো ৩ জুন নিউইয়র্ক হাজারো মানুষের বিক্ষোভে উত্তাল ছিল। বৃষ্টিভেজা রাতেও নগরীর ব্রুকলিন থেকে ম্যানহাটন পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের স্লোগানমুখর পদচারণা চলছে। আগের রাত থেকে পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। তবে লুটপাটের বিচ্ছিন্ন ঘটনা চলছে। আন্দোলনকারী ও পুলিশের সতর্ক অবস্থানের কারণে আগের রাতের লুটপাটের পুনরাবৃত্তি ঘটছে না।

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও একেবারে থামেনি। নিউইয়র্কে ২ জুন ৫৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হলেও জনতার আন্দোলনের কাছে এ সংবাদ এখন চাপা পড়ছে। অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিলেও স্বাস্থ্যসেবীরা মনে করছেন, ভাইরাসের সংক্রমণ এতে বেড়ে যেতে পারে। আগামী দু-তিন সপ্তাহে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তার দিকেই উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে সবাই।

এদিকে চলমান বিক্ষোভ দমনের মূল দায়িত্ব সেনাবাহিনীর ঘাড়ে দিতে চান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প সত্যিই এমন কাজ করলে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের একটি হাতিয়ারে পরিণত হবে পেন্টাগন, এই আশঙ্কায় ভীষণ চাপে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর। ৩ জুন বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ কোথাও কোথাও সহিংস রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন শহরে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। হোয়াইট হাউসের বাইরেও বিক্ষোভ হয়েছে। ভয়ে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের ভূগর্ভস্থ বাংকারে আশ্রয় নেন। উসকানিমূলক নানা কথা বলার পর সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামানোর হুমকিও দেন তিনি।

হোয়াইট হাউসের সামনে থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার ঘটনার পর একটি গির্জায় ট্রাম্পের সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার ও সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফস চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলিকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখা যায়। তাঁরা একসঙ্গে ছবিও তোলেন। এই ঘটনার পরই ট্রাম্প বিক্ষোভ দমনে হাজারো সশস্ত্র সেনা রাস্তায় নামানোর হুমকি দেন। দেশের ভেতরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা নামাতে হলে বিদ্রোহ আইন বলবৎ করতে হবে, যার প্রয়োগ বিরল। পেন্টাগন বলছে, বিদ্রোহ আইন কার্যকর নেই। কিন্তু ট্রাম্পের হাবভাবে অনেকের মধ্যে এই আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে যে তিনি তাঁর দেওয়া হুমকিকে বাস্তব রূপ দিতে পারেন। অর্থাৎ, বিক্ষোভ দমনে সেনা নামাতে পারেন ট্রাম্প।

নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে সেনা ব্যবহারের মতো ট্রাম্পের যুদ্ধংদেহী মনোভাবে পেন্টাগন ভীষণ চাপ অনুভব করছে। কারণ, ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সেনা ব্যবহারের মতো পদক্ষেপ নিলে বলির পাঁঠা হবে পেন্টাগন।

এ বিষয়ে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী জো বাইডেন বলেছেন, ট্রাম্প মার্কিন জনগণের বিরুদ্ধে তাদেরই সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে চাইছেন।

আর সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিবর্গ ট্রাম্পকে রীতিমতো ধুয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা এ ক্ষেত্রে বাইডেনের মতো রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ধারও ধারছেন না। ৩ জুন রাতে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস বলেন, ‘আমার দেখা আমেরিকার প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার কিংবা ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করার অভিনয়টা পর্যন্ত না করে সবাইকে বিভাজিত করছেন।’ ২০১৮ সালে পদত্যাগের পর থেকে নীরব থাকা ম্যাটিস বলেন, ‘গত তিন বছর ধরে আমরা দায়িত্বশীল নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’

একই ধরনের সমালোচনা করেন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল জন এলেন। আফগান যুদ্ধের সাবেক এই কমান্ডার নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অবস্থানে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে নতুন দিন আসছে বলে আশাও প্রকাশ করেছেন তিনি। সমাজের নিচু তলা থেকেই পরিবর্তন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এলেন ও ম্যাটিসের এমন বক্তব্য তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত, নাকি এটি দায়িত্বের কারণে কথা বলতে অপারগ ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদেরও বক্তব্য, সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্য দেওয়ার ঘটনা আর নেই।

এর আগে নিউইয়র্কে ১ জুন রাতে কারফিউ ভেঙে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। ৭ জুন পর্যন্ত রাত ৮টা থেকে ভোর ৫টা অবধি কারফিউ জারি থাকবে। তবে জরুরি বিভাগ চালু রাখা হয়েছে। ইয়েলো ও গ্রিন ক্যাব রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগের কর্মীদের পরিবহন করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে যাত্রীদের জরুরি কাজের প্রমাণ দেখাতে হবে পুলিশকে।

১ জুন কারফিউ জারির প্রথম রাতে নিউইয়র্কে রেকর্ডসংখ্যক ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যান্য নগরীতে রাত ৮টা থেকে কারফিউ জারি হলেও নিউইয়র্কে রাত ১১টায় কারফিউ জারি করা হয়। গভর্নর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সেনা মোতায়েনের নির্দেশনার সমালোচনা করে বলেন, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার এ উদ্যোগে তিনি নেই। এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল ল্যাটেসিয়া জেমস।

এর আগে গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর সমালোচনা করে ট্রাম্প এক টুইটে বলেন, ‘লুটপাটকারী, ডাকাত, চরমপন্থী বাম এবং অন্যান্য নিম্ন শ্রেণির কাছে হেরে গেছে নিউইয়র্ক। গভর্নর সেনাবাহিনী মোতায়েনে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিউইয়র্ককে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে।’ আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে বামপন্থীদের নেপথ্যে থাকার দাবির পক্ষে ট্রাম্প কোনো প্রমাণ হাজির করেননি।

এদিকে বিক্ষোভ দমনে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ জুন কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের গভর্নরদের সমালোচনা করেন। বিক্ষোভ চলাকালে পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ট্রাম্প এই সমালোচনা করেন। এর পর থেকে চলমান বিক্ষোভে আরও উত্তেজনা বেড়েছে।

ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ লেঙ্গিয়েল বলেছেন, ১ জুন রাতে বিভিন্ন শহরে সহিংসতা কমেছে। যদিও বিক্ষোভ আগের মতোই আছে। রাতে কোনো সেনাসদস্য আহত হননি। সেনা কর্মকর্তা জানান, ২৯টি অঙ্গরাজ্যে ১৮ হাজার সেনাসদস্য স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করছেন এবং এই সংখ্যা বাড়ছে।

আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকানকে ২৫ মে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে নির্যাতন করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এতে সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণ করা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে চাওভিন ফেঁসে যান। ভিডিওটি ভাইরাল হলে চাওভিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বিচারের অপেক্ষায় এখন কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন।