বিক্ষোভের ভেতর শ্বাস নিচ্ছে ক্ষুব্ধ আমেরিকা

নিউইয়র্কে ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কে জনতার বিক্ষোভ মাইলের পর মাইল ছাড়িয়ে যায়। ছবি: রয়টার্স
নিউইয়র্কে ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কে জনতার বিক্ষোভ মাইলের পর মাইল ছাড়িয়ে যায়। ছবি: রয়টার্স

হোয়াইট হাউসের নাকের ঢগায় সিক্সটিন স্ট্রিটে এখন সাইনবোর্ড ঝুলছে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার স্ট্রিট'। অদূরেই হোয়াইট হাইসের উত্তর দিকে প্রতিবাদী পোস্টার হাতে নিয়ে বসে আছেন মানবাধিকার কর্মী ফিলিপস। ৬ জুন পুরো আমেরিকার চলমান মিছিলের গন্তব্য হয়ে ওঠে ওয়াশিংটন ডিসি। সকাল থেকে দলে দলে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ ঘটতে থাকে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার স্ট্রিটের মোড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ মাইলের পর মাইল ছাড়িয়ে যায়। সবার হাতেই ন্যায় বিচার দাবির পোস্টার। বর্ণবাদ আর অসাম্যের বিরুদ্ধে জনতার সম্মিলিত আওয়াজে এক ভিন্ন আমেরিকা এখন দেখছে বিশ্বের মানুষ।

লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং বক্তব্য দিয়েছিলেন। একই মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে আজকের নাগরিক অধিকারের নেতারা বলছেন, দিনের পর দিন আমরা মানুষ খুন হতে দেখছি। ডিজে কুইকসিলভা নামের একজন বলেন, বর্ণবাদ মাত্র শুরু হয়নি। বর্ণবাদ আজ ভিন্ন রূপ নিয়েছে। আমরা ন্যায় বিচার আর পুলিশি সহিংসতার স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত থামব না।
আশপাশের রাজ্য আর নগরী থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিক্ষোভকারীদের হাত তালি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে সবাই। আর্লিংটনে পুলিশকে মিছিলকারীদের হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিতে দেখা যায়। প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে মিছিলের নগরী হয়ে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি।

বর্ণবাদ আর অসাম্যের বিরুদ্ধে জনতার সম্মিলিত আওয়াজে এক ভিন্ন আমেরিকা এখন দেখছে বিশ্বের মানুষ। ৬ জুন, ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্ক। ছবি: রয়টার্স
বর্ণবাদ আর অসাম্যের বিরুদ্ধে জনতার সম্মিলিত আওয়াজে এক ভিন্ন আমেরিকা এখন দেখছে বিশ্বের মানুষ। ৬ জুন, ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্ক। ছবি: রয়টার্স

৫ জুন ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র মুরিয়েল বোসার নিজেই হলুদ দাগ দিয়ে হোয়াইট হাউসের সামনের সিক্সটিন স্ট্রিটের (এনডব্লিউ) নাম 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজা' নামকরণ করেন।

মিনেপোলিসে নিহত জর্জ ফ্লয়েড এভাবেই এখন আমেরিকার বৈষম্য আর বিদ্বেষের চাপা আর্তনাদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমনের জন্য সপ্তাহের শুরুতেই হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে ১০ হাজার সেনা মোতায়েনের চাহিদার কথা জানানো হয়। প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে সেনা মোতায়েনের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। নগরীর মেয়র পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনা উপস্থিতি নাকচ করে দেন। মেয়রের পক্ষ থেকে অ্যাকটিভ ডিউটির সেনা সদস্যদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। হোয়াইট হাউস ঘিরে নগরীর পুলিশ ও নাগরিক পোশাকে কয়েক হাজার নিরাপত্তা রক্ষী কাজ করছে বলে মার্কিন বার্তা সংস্থাগুলো জানাচ্ছে।

নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কয়ারে ৬ জুন প্রতিবাদ সমাবেশে বাংলাদেশি অধিকার কর্মীদের যোগ দিতে দেখা যায়। ছবি: প্রথম আলো
নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কয়ারে ৬ জুন প্রতিবাদ সমাবেশে বাংলাদেশি অধিকার কর্মীদের যোগ দিতে দেখা যায়। ছবি: প্রথম আলো

টানা ১১ দিনে নিউইয়র্কের আন্দোলনে জন সম্পৃক্ততা আরও বেড়েছে। ব্রুকলিন থেকে ম্যানহাটন, কুইন্স, স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে ৬ জুন অন্তত ৩০ টি স্থানে সমাবেশ হয়েছে। নিউইয়র্কে নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম স্থাপনা ম্যানহাটনের ইউনিয়ন স্কয়ার। সেখানে হাজারো বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছিলেন প্রবাসী সাংস্কৃতিক সংগঠক গোপাল স্যান্যাল। তিনি জানালেন, গত কয়েক দিন থেকে চলমান আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। বাংলাদেশ থেকে আসা এ অভিবাসী বললেন, এ আন্দোলন কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন নয়। এ আন্দোলন আমাদের সবার। এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশিদেরও আহ্বান জানান।
একই সমাবেশে যোগ দেওয়া 'সেক্যুলার মুভমেন্ট ফর বাংলাদেশ' নামের সংগঠনের আহ্বায়ক শুভ রায় বলেন, ক্ষোভ আর দ্রোহের এ উচ্চারণ শুধু আমেরিকার নাগরিকদের উচ্চারণ নয়। বৈষম্য আর বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবতার এ আহ্বানে বিশ্বের সব অধিকার সচেতন মানুষের সম্পৃক্ত হওয়ার সময় আজ।

মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকানকে গত ২৫ মে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে নির্যাতন করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এতে সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। ২৬ মে থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ গত ১১ দিন থেকে বড় বড় নগরীতে হয়েছে। ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। প্রায় ১২ হাজার লোক এ আন্দোলনে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
৬ জুন সপ্তাহান্তের দিন আমেরিকার এ বিক্ষোভ বড় বড় নগরীতে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছোট ছোট প্রান্তিক নগরীতেও লোকজন বেরিয়ে এসেছে রাজপথে। দীর্ঘ লকডাউনে থাকা নগরীগুলোতে চমৎকার আবহাওয়া লোকজন উপভোগ করছে দ্রোহের উচ্চারণে। মিছিল আর বিক্ষোভকারীদের রং কালো নয়। কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন বলে চলমান এ আন্দোলনকে সংজ্ঞায়িত করার কোনো উপায় নেই। সব বর্ণ, ধর্মের মানুষের ব্যাপক সমাবেশ সর্বত্র। যুব তরুণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নাগরিক অসন্তোষের চরম বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে।

নিউইয়র্কে ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কে জনতার বিক্ষোভ মাইলের পর মাইল ছাড়িয়ে যায়। ছবি: রয়টার্স
নিউইয়র্কে ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কে জনতার বিক্ষোভ মাইলের পর মাইল ছাড়িয়ে যায়। ছবি: রয়টার্স

এ আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গদের ঐক্য আরও সুদৃঢ় হচ্ছে মনে করছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক। আমেরিকার রাজনৈতিক কাঠামোতে আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকান দলকে দুই ভাবে মূল্য দিতে হতে পারে। প্রথমত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন। এ নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। উদারনৈতিক ডেমোক্রেটদের কাছে বাইডেনের ব্যাপক সমর্থন থাকলেও রাজপথের অতি উদারনৈরিক মহলটি বাইডেনকেও নিজেদের নেতা মনে করে না। এ কারণেই এ গণআন্দোলন ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন কতটা ঠেকাতে পারবে, তা নিয়ে নিশ্চিত নয় কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। চলমান গণআন্দোলনে রিপাবলিকান দলকে মূল্য দিতে হতে পারে সিনেটে তাদের আসন ধরে রাখা নিয়ে। প্রায় তিন ডজন সিনেট আসনে রিপাবলিকান নেতাদের নির্বাচনে নিজেদের ধরে রাখতে হবে। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয়ভাবে হেরে যাবেন। ফলে সিনেটেও রিপালিকান দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে হতে পারে। এ নিয়ে রিপাবলিকান দলের মাঠ পর্যায়ে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। যদিও রিপাবলিকান দলের নেতারা এখনও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁদের মতপার্থক্যের কথা জোরালো ভাবে বলছেন না।

আমেরিকাজুড়ে পুলিশি সহিংসতা ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে নতুন নতুন আইন প্রস্তাব আসছে রাজ্য পর্যায়ে। পাশাপাশি কংগ্রেসেও এ নিয়ে আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে। নগর ও রাজ্য সরকারগুলো নিজেদের পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার আবার খাতিয়ে দেখছে। চলমান এ আন্দোলন দীর্ঘায়িত হবে এবং নাগরিক আন্দোলনের নেতারা মনে করছেন, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলনকে ধরে রাখতে হবে। নাগরিক আন্দোলনের নেতা আল শার্পটন নিউইয়র্কের সভায় আগেই বলেছেন, আমরা এ আন্দোলনকে নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দেব। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রক্ষণশীল রাজনীতির চাপে আমেরিকা যেন নিশ্বাস ফেলছে জর্জ ফ্লয়েডের নিহত হওয়ার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে।