আত্মা-পরমাত্মার খোঁজে বাউল

লালন শাহ, শাহ আবদুল করিম
লালন শাহ, শাহ আবদুল করিম

হৃদয়বান মানুষের আজ বড় অভাব। মানুষ বহু আছে কিন্তু মন নেই, হৃদয় নেই, ভালোবাসা নেই, কিচ্ছু নেই।
মন মরে গেছে অথবা স্বার্থ, সম্প্রদায় ইত্যাদির কারণে মনের সৌন্দর্য কদর্য হয়েছে সারা বিশ্বে। মন মানে আত্মা, আত্মা মানেই অনন্য এক সত্তা, যা অদৃশ্য-অবিনশ্বর, অতল, অমূল্য রতন।
দেহের যেমন খাদ্য লাগে, গাছে যেমন জল-সার লাগে, তেমনি আত্মারও পরিচর্যা লাগে, যত্ন লাগে। কেন মনের খোঁজ করি না, কেন মন খুঁজেও তল পাই না, তার বহু কারণ আছে।

অর্থনীতি ঝোড়ো, নীতি টালমাটাল, প্রেম প্রীতিহীন, প্রাণ প্রাচুর্যহীন, আর ভাব জগতের দরজা বন্ধ, প্রবেশ নিষেধ, আমরা কোথায় যাব? আমরা কী করে প্রকৃত মানুষ হব, কী করে আপনাকে চিনব, কী করে আত্মার আত্মীয়, পরমাত্মাকে খুঁজে পাব জানি না। আজ দেহ জানে না দেহের খবর, মন জানে না মনের খবর, রাজা জানে না প্রজার খবর, ব্যাংক জানে না টাকার খবর। সব যেন জানা, তবু যেন অজানা, অচেনা আস্তাবলের বাসিন্দা আমরা, মায়ার দুনিয়া চিনি না। বন্দে মায়া লাগাইছে, প্রীতি শিখাইছে...। তবু মায়া নেই...বন্দের খবর নেই—এই বে-খবরের মধ্যেও যারা দিলের খবর রাখে, তারা আউলা ঝাউলা, তাদের সমাজে কদর নেই।
তবু তারা আছে, মুঘল সাম্রাজ্য নেই, কিন্তু তারা আছে। তারা কারা? তারা বাউল, তারা সাদা মনের মানুষ, মনের মানুষ। অসুন্দরের চাপে-তাপেও যারা আত্মার গহিনের খোঁজ করেন তারা বাঊল। বাউলেরা উদার, অসাম্প্রদায়িক, সাধক, তারা মানবতার বাণী প্রচারক। আমি তাই বাউল গান, কীর্তন গান শুনলেই কান পাতি, যদি একটু মধু পাই, শান্তি পাই—এই আশায়।

বাজার অর্থনীতির এই যুগে ‘বাউল তরী’ এক অনন্য সংগঠন যারা বাউলদের সম্মান করেন, গুণীদের কদর করেন। আমি তাই তাদের ডাকে আসি এবং বারবার আসি। সংগঠনের সভাপতি কবি মফিজকে ভালোবাসি।
২০০৫ সালে ইউনেসকো বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক ও দৃশ্যমান ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। [৪০ ]

বাউল সাধকদের সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছেন জগন্মোহন গোসাঁই, সিরাজ সাঁই ও লালন সাঁই। লালন (জন্ম: ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দ-মৃত্যু: ১৭ অক্টোবর, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ) [২] ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। [৩ ]
তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজসংস্কারক এবং দার্শনিক। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ‘বাউল-সম্রাট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। [৪ ][৫] তাঁর গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সব ধরনের জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তাঁর গান রচনা করেছেন। [৬] তাঁর গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, [৭ ][৮ ][৯] কাজী নজরুল [১০] ও অ্যালেন গিন্সবার্গের [১১] মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তাঁর গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সংগীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। [৬] গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তাঁকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। [১২ ]

এ ছাড়া বাউল কবিদের মধ্যে জালাল খাঁ, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুনশি, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম, ফকির দুরবিন শাহ, হাছন রাজা ভাটি বাংলায় জন্ম গ্রহণ করেন।

পূর্ণদাস বাউল ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত রামপুরহাটের সন্নিকটে একচক্কা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম নবনী দাস বাউল। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মন্বন্তরের সময় দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারকে আহার জোগাড় করতে তিনি রেলস্টেশন ও প্ল্যাটফর্মে গান গেয়ে রোজগার করেন। এই সময় সীতারাম ওঙ্কার নাথ নামে এক সাধকের প্রেরণায় পূর্ণদাস বাংলার বাইরেও বাউল গান গাইতে বের হন। তিনি মাত্র নয় বছর বয়সে বাউল গান গেয়ে জয়পুরে এক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জয় করেন। কৈশোরে তিনি কলকাতা শহরে রংমহল থিয়েটার এবং বঙ্গসংস্কৃতির মেলায় গান গেয়েছিলেন। পিতার সঙ্গে যুগ্মভাবে নির্মিত তাঁর গানের রেকর্ডিং এই সময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। [৩ ]

১৯৬০ সালে পূর্ণদাস আমেরিকার সান ফ্রান্সেসকো শহরের এক গানের অনুষ্ঠানে বব ডিলানের পূর্বতন ম্যানেজার আলবার্ট গ্রসম্যানের নিমন্ত্রিত পান। পূর্ণদাস পরবর্তী বছরগুলোতে পৃথিবীর বহু দেশে বাউল গান গেয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন। সান ডিয়েগো শহরে তিনি বাউল গানের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন। [৩ ]
রশিদ উদ্দিন নেত্রকোনা জেলায় জন্ম নেওয়া একজন বাউল সাধক। তিনি ১৮৮৯ সালের ২১ জানুয়ারি নেত্রকোনা পৌরসভার বাহিরচাপড়া গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ‘রসিক আমার মন বান্দিয়া পিঞ্জর বানাইছে’। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন আত্মভোলা। ১৯০৯ সনে রশিদ উদ্দিন লেংটা শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নিজ বাড়িতে হালকা জিকিরের জলসায় মেতে ওঠেন।

নেত্রকোনার প্রখ্যাত বাউল কবি জালাল খাঁ তখন রশিদ উদ্দিনের বাড়িতে লজিং থেকে নেত্রকোনা স্কুলে লেখাপড়া করতেন। জালাল খাঁ তখন থেকেই রশিদ উদ্দিনের কাছে বাউল গানের তালিম নেওয়া শুরু করেন।

তখন রশিদ উদ্দিনের গৃহত্যাগের সংবাদ পেয়ে জালাল খাঁ ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে রশিদ উদ্দিনের গৃহত্যাগের অর্থ সংগ্রহপূর্বক সন্ধানে বের হন এবং দীর্ঘ নয় মাস পর রশিদ উদ্দিনকে শারফিনের মাজারে খুঁজে বের করেন। জালাল খাঁ শারফিন থেকে রশিদ উদ্দিনের সঙ্গে নিয়ে বালুয়াখালী ফিরে আসেন।
রশিদ উদ্দিন তখন থেকে প্রায় দুই বছর ভাত খাওয়া ছেড়ে দেন। তখন তিনি শুধু দুধ ও রুটি খেতেন। রশিদ উদ্দিনের এ উদাসী ভাব দেখে বাউল কবি জালাল খাঁ স্থায়ীভাবে রশিদের সঙ্গে থাকার জন্য সিদ্দিক জমাদারের মেয়ের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এবং জালাল খাঁ রশিদের শিষ্যরূপে বাউল সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তাই জালাল খাঁ রশিদ উদ্দিনের অন্যতম সহকর্মী ও শাগরেদ।

রশিদ উদ্দিনের বাড়ি আস্তে আস্তে বাউল তত্ত্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ কেন্দ্রে সহযোগী হিসেবে খালিয়াজুরী থানার বাউল সাধক উকিল মুনশি, মোহনগঞ্জ থানার হাসলার চান খাঁ, মদন থানার হাজরাগাতির পিতাম্বর রবিদাস সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

শাহ আবদুল করিম
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন এবং ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সিলেট শহরের নুরজাহান ক্লিনিকে মারা যান। কিন্তু তিনি মানুষের মনে বেঁচে আছেন। বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...। আসলে তার সৃষ্টির সুবাস পাই আমরা তার বন্ধু হলে তিনি সুবাস পাবেন, তিনি সুবাস আশা করেন। আমি এই সাধককে কাছ থেকে দেখেছি, খুব কাছ থেকে...।

২০০৫ সালে বর্ষাকালে আমি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগ দিই। তবু হাওরের জলরাশি আমাকে প্রথমে ছুঁতে পারিনি। কিন্তু বাউল সম্রাটের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে কেমন জানি মনটা ঘুরে যায়। প্রথম সাক্ষাৎ আর মৃত্যুর আগ মুহূর্তের দেখা সবই আমার মনে গেঁথে আছে। সে সব স্মৃতি আমার আজীবনের সম্পদ এবং শিক্ষাস্বরূপ বেঁচে থাকবে।

প্রথম আলোর সাংবাদিক সুমন কুমার দাশ শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে গবেষণা করছেন। বাউল সম্রাটের রচনা সমগ্র প্রকাশ করেছিলেন বর্তমান সিনিয়র সচিব এবং সিলেটের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার ড. জাফর আহমেদ খান।

২০০১ সালে একুশে পদক পান শাহ আবদুল করিম, কিন্তু শহর-গ্রাম সব মানুষের মন থেকে তিনি অপরিসীম জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তাঁর মতো জনপ্রিয় মনোহরা বাউল বর্তমান বিশ্বে বিরল। বাউল আবদুল করিম মনের মানুষ তাদের, যাদের মন আছে।

দেহ তত্ত্ব চর্চা করতে গিয়ে বাউল সাধকেরা মনের চর্চা করেন, আর মনের খোঁজ করতে গিয়ে মূলত আত্মা এবং পরমত্মার খোঁজ করেন। কোথায় সেই পরমাত্মা? পরমাত্মার সঙ্গে স্রষ্টার সন্ধান যারা করেন, সেই বাউলগণ আমাদের আত্মীয় যদি বিবেচিত না হন, তবে কে আর হবেন আপনজন! সেই ভাবনা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

আমি-আমরা অনেকে বাউল হলে জগতের কোনো ক্ষতি হতো না, তবে আমাদের আত্মার চঞ্চলতা হয়তো কম হতো, হয়তো আত্মার সুবিশালতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মানবিক পৃথিবী তৈরির পথ তাতে সুগম হতো।

তাই প্রার্থনা করি, বিধাতা, বাউল মনের সৌন্দর্য, উদারতা, নির্লোভ মানসিকতা আমাদের দান করো।