বাজেটে কৃষিতে গুরুত্ব দিতে হবে

খাদ্য অপরিহার্য, তা শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণীর জন্যই প্রযোজ্য। তারপরই বাসস্থান, নিরাপত্তা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য উপাদান। অথচ মানুষ আজ তার মৌলিক ও প্রাথমিক আবশ্যক খাদ্য চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে খাদ্যসংকট শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বগ্রাসী রূপ ধারণ করতে পারে। তার পূর্বাভাস ইতিমধ্যে স্পষ্টতই দৃশ্যমান। সম্ভাব্য চরম খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনেতারা যথেষ্ট চিন্তিত। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ নয়, আমেরিকার মতো অতি উন্নত দেশের পক্ষেও খাদ্যসংকটের প্রভাবমুক্ত থাকা সম্ভব হবে না।

আমাদের ভবিষ্যতে প্রজন্ম যে তীব্র খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হতে পারে, তার পূর্বাভাস অর্থনীতিবিদরা বহু আগে দিয়ে রেখেছেন। ২০০ বছরের বেশি আগে অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বে খাদ্যাভাব জর্জরিত ভবিষ্যতে বিশ্বের রূপ চিত্রায়িত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জ্যামিতিক হার এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির গাণিতিক হারের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতাকে খাদ্যসংকটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন ওই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ। যাই হোক, বর্তমান বিশ্বে ক্রমপ্রকটমান খাদ্যসংকটকে প্রত্যক্ষভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করা এ লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পায়ন-নগরায়ণ কীভাবে খাদ্যসংকটে এক ভয়াবহ মাত্রার সংযোজন ঘটিয়ে চলেছে, সেটি এ রচনার মূল বিষয়।

শিল্পায়ন ও কৃষিবিকাশ একে অন্যের পরিপূরক। যন্ত্রপাতি, সার, কীটনাশক ইত্যাদির জোগানোর মাধ্যমে শিল্পায়ন কৃষি বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা তথা শিল্পায়নে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান কৃষির পক্ষে ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে কৃষির সামগ্রিক উৎপাদন বাড়লেও তা সাধারণ মানুষের খাদ্যসংকট মোচনে সক্ষম নাও হতে পারে। শিল্পায়ন কৃষিক্ষেত্রে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের চেয়ে অর্থকরী শস্যের উৎপাদনকে অধিক উৎসাহিত করে। তা ছাড়া, এসব শস্যের উৎপাদন কৃষকদের কাছে অধিকতর লাভজনক হওয়ায় তারা খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমিয়ে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত অর্থকরী শস্যের উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব দেন। বর্তমানে উচ্চবিত্তদের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত ফুডের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বিপুল খাদ্যশস্য সংশ্লিষ্ট কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ফলমূল, দানাশস্য, দুধ, মাংস সবই রয়েছে। ফলে ওই সব খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন বাড়লেও তা সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের নাগালের বাইরে।

শিল্পায়নের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনিক শ্রেণি ও দরিদ্র শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার তুলনামূলক ব্যবধান। ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের এ যুগে বেশির ভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এত নিম্ন যে, তাদের পক্ষে খাদ্যের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী মজুত থাকলেও এদের কাছে তা সহজলভ্য নয়, কেননা এদের ক্রয়ক্ষমতা শূন্যের কাছাকাছি।

শিল্পায়নের ক্রমব্যাপ্তি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে হ্রাস পাচ্ছে কৃষিজমি। বনাঞ্চল বা ঊষর ভূমিতে যে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে উর্বর কৃষিজমি শিল্পকারখানার দখলে চলে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষরূপে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে। শিল্পায়নের ফলে বাড়ছে নগরায়ণ, কমছে চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ।

খাদ্যসংকট সৃষ্টিতে শিল্পায়ন-নগরায়ণের পরোক্ষ প্রভাব অনেক জটিল, সুদূরপ্রসারী ও বহুমুখী। এ প্রভাব এখন তেমন প্রকট না হলেও আগামী দশক কয়েকের মধ্যে এর ভয়াবহ রূপ বিশ্ববাসী দেখা যাবে। শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন আগামী বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে তীব্র খাদ্যসংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনেতারা এ নিয়ে তাঁদের আশঙ্কার কথা ইতিমধ্যে ব্যক্ত করেছেন।

উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্যশস্য উৎপাদনের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুর অবাঞ্চিত পরিবর্তনের ফলে কোথাও প্রচণ্ড খরা আবার কোথাও প্রচণ্ড বর্ষণ ও বন্যা ভয়ংকর বিপর্যয় ডেকে আনছে। দেখা যাচ্ছে, আরও আশ্চর্যজনক ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। গ্রীষ্ম-বর্ষায় বৃষ্টির আকালে দেখা দিচ্ছে খরা আর কোন কোন অঞ্চলে শীতকালে প্রচুর বৃষ্টিতে হচ্ছে বন্যা। জলবায়ুর এ তুঘলকি কাণ্ডে মার খাচ্ছে কৃষি, খাদ্যশস্যের উৎপাদন।

শিল্পায়ন-নগরায়ণের ফলস্বরূপ বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় অ্যান্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড তথা হিমবাহের বরফ গলে সমুদ্রের পানি পৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ থেকে ২.৫ মিটার অবধি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এমন ঘটনা যে এক অবর্ণনীয় বিপর্যয় ডেকে আনবে, তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। উপকূলীয় অঞ্চল ও অনেক দ্বীপমালা পানিহীন হয়ে যাবে। এতে বেকারত্ব, দারিদ্র্য তথা খাদ্যসংকট এক বিভীষিকাময় রূপ ধারণ করবে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে আগামী বিশ্বে চরম পানি সংকট দেখা দেবে, খাদ্যসংকট তীব্রতর হবে। নদী-নালায় প্রবাহিত পানির উৎস হিমবাহ। হিমবাহ থেকে নিরন্তর প্রবাহ রূপে পানি সাগরে গড়াচ্ছে। আবার সাগর থেকে বাষ্পাকারে এ পানি পুনরায় হিমবাহে জমা হচ্ছে। এ জমাট ও গলন প্রক্রিয়ায় পুরো বিষয়টি চক্রাকারে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অথচ উষ্ণায়নের ফলে বর্তমানে এ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। অত্যধিক বরফ গলনের কারণে নদী-নালা এক সঙ্গে এত পানি ধারণ করতে না পারায় দেখা দিচ্ছে অকাল বন্যা, বিঘ্নিত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন, দেখা দিচ্ছে খাদ্যসংকট। গবেষকেরা বলছেন, পৃথিবীর ক্রম উষ্ণায়নের কারণে সাগর থেকে জলীয় বাষ্প উঠে এলেও তা হিমবাহ গাত্রে জমাট না বেঁধে বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ছে। তাই শীত-বসন্তে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এ জন্য দেখা যাচ্ছে বর্ষায় খরা আর শীতে অকাল বৃষ্টি-বন্যা।

এক সময় বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হতো। এর ফলে নদীনালা-খালবিল ভরাট থাকত। পানির অভাবে কৃষিকাজ বিঘ্নিত হতো না। কিন্তু কয়েক বছর থেকে উষ্ণায়নের প্রভাবে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত খুবই কম হচ্ছে। এদিকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বেশির ভাগ নদীর উজান দিকে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক গতিপথকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা তাদের দেশের জন্য পানি সংরক্ষণ করায় বাংলাদেশ তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে কৃষিকাজে ব্যাপক অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে, মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, মত্স্য চাষ ব্যাহত হচ্ছে, নানারকম রোগের সৃষ্টি হচ্ছে, গাছপালা মরে যাচ্ছে। জাতীয় এ সমস্যার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কৃত্রিম নদী ও জলাশয় খনন করে পানি ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, উষ্ণায়নের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে হিমবাহগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ফলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দক্ষিণ আমেরিকাসহ চীন, বাংলাদেশ, ভারত ও এশিয়ার আরও অনেক দেশ। সবচেয়ে বেশি বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষিক্ষেত্রে। নদী-নালার পানিধারার উৎস হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হলে অনেক নদী-নালা অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে, যা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে নদীকে কেন্দ্র করে যে কৃষিভিত্তিক মানবসভ্যতা বিকশিত হয়েছিল, তার বিপর্যয় ঘনিয়ে আসবে।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস সৃষ্টিকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে, জৈব জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ জৈব জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা খাদ্যশস্যের উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জৈব জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট তৈলবীজের উৎপাদনে নানারকম উত্সাহমূলক সরকারি ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের সরকারি নীতি জৈব জ্বালানির উৎপাদন বাড়িয়ে শিল্পায়ন-নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও এর ফলে খাদ্যসংকট আরও প্রকট হওয়ার স্পষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জৈব জ্বালানির কাঁচামাল (ফিডস্টক) উৎপাদনের ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যসংকট তীব্রতর হচ্ছে। তার কারণ, সরকারি ছাড় তথা অধিক অর্থকরী হওয়ায় অনেক কৃষক চিরাচরিত খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছেড়ে তাদের উর্বর জমিতে পাম, জেট্রোফা আদি জৈব জ্বালানি তৈরির কাঁচামাল চাষ করছেন। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে জমির উত্পাদনমান ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। জৈব জ্বালানি হিসেবে পাম তেলের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে এ তেল ভোজ্যতেল হিসেবে সহজলভ্য হচ্ছে না। তাই বিশেষজ্ঞরা জৈব জ্বালানি বিষয়ে সঠিক নীতি রচনার আবশ্যকতা বোধ করছেন। জৈব জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিঘ্নিত হলে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র জনবহুল দেশগুলো অধিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। যেহেতু খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি তথা খাদ্যসংকটের জন্য জৈব জ্বালানির উৎপাদনও একটি কারণ, তাই বিশ্বের অন্যতম পাম তেল উত্পাদক দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া জৈব জ্বালানি উৎপাদনের বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে পর্যালোচনা করার আবশ্যকতা উপলব্ধি করছে। উর্বর জমিতে জৈব জ্বালানি উৎপাদনের আশু অবসান না ঘটলে আগামী দিনে খাদ্যসংকট আরও ঘনীভূত হবে; সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর এ উদ্বেগের বিষয়টি মোটেই অমূলক নয়।

বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে ভয়ংকর খাদ্যসংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। এ দেশে ধানের উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশে চাহিদানুপাতে ধানের উৎপাদন কমে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় কুড়ি লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে, যা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। বাংলাদেশের মতো খাদ্যসংকটের কবলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও নেপালও। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর সূত্রে প্রকাশ, নেপালে খাদ্যাভাব ও অপুষ্টির শিকার এক কোটিরও বেশি মানুষ। খাদ্যশস্য উৎপাদনে নেপালেও দারুণ ভাটার টান লক্ষিত হচ্ছে। ওই দেশের কিছু কিছু জেলায় টানা পাঁচ বছর তেমন ফসল উৎপাদন হয়নি। বর্তমানে নেপালের প্রায় নয়টি জেলার কয়েক লাখ মানুষ মারাত্মক খাদ্য সংকটে। এশিয়ার আরেক দেশ উত্তর কোরিয়ায় ১৯৯৫ সাল থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা খাদ্যের আকাল বিগত কয়েক বছরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

এ তো গেল উন্নয়নশীল দেশের কিছু উদাহরণ। আপাত অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি সত্য, মার্কিন মুলুক দারিদ্র্য ও খাদ্যসংকটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রতি বিশ্বে যে ভয়াবহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্যশস্য উৎপাদনে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে ধনী দেশ আমেরিকার প্রায় দুকোটি মানুষ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রভাবিত হতে পারেন। প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে এ তথ্য পেশ করেছেন জাতিসংঘের এক শীর্ষ কর্তা। কারণ হিসেবে বলেছেন, সেখানে শিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনের হার অনেক কমানো হয়েছে। অধিকন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব খাদ্যশস্য উৎপাদনের ওপর পড়ছে। ‘শতাব্দীর উন্নয়ন’ শীর্ষক এক আলোচনা চক্রে এ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, উত্তর আমেরিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ এখন চরম দারিদ্র্য ও খাদ্যসংকটের শিকার।

এটি পরিষ্কার—শিল্পায়ন, শিল্পায়ন সৃষ্ট উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়ন রোধে অনুসৃত কিছু ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিশ্বে খাদ্যসংকট তীব্রতর করে তুলছে। তৎসঙ্গে ধনী-দরিদ্রের আয় ও ক্রয়ক্ষমতার বৈষম্য দিন দিন এত প্রসারিত হচ্ছে যে, এ দুই শ্রেণির জীবন শৈলীতে অদ্ভুত বৈপরীত্য প্রকট হয়ে উঠছে। দরিদ্র শ্রেণি তার ন্যূনতম খাদ্যের প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, পক্ষান্তরে ধনিক শ্রেণির আহার তালিকায় বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানুষের ন্যূনতম খাদ্য নিশ্চিতকরণ উন্নয়নের প্রথম লক্ষ্য হওয়া আবশ্যক। সভ্য সমাজে খাদ্যের অধিকার মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত হতে হবে। সমাজের গরিষ্ঠ মানুষকে অভুক্ত, পশ্চাৎপদ রেখে স্বল্প সংখ্যক মানুষের ভরপুর স্বাচ্ছন্দ্যে দ্রুত অগ্রগমন প্রকৃত উন্নয়নের দ্যোতক নয়। বর্তমান শতাব্দীর মাঝামাঝি বিশ্বের জনসংখ্যা নয় শ কোটি হতে পারে। খাদ্যসংকটের বিষয়টি এখন গভীরভাবে বিবেচিত না হলে অদূর ভবিষ্যতে অপরিমেয় মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই কৃষিকে উপেক্ষা করে শিল্পায়ন মানবজাতির সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে না, পারবেও না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।