করোনাকালের ঘটনা সারা জীবন তাড়া করে যাবে

ব্রুকলিনের কোনি আইল্যান্ড হাসপাতালে কর্মরত যশোরের মেয়ে হালিমা হালিনা। ছবি: সংগৃহীত
ব্রুকলিনের কোনি আইল্যান্ড হাসপাতালে কর্মরত যশোরের মেয়ে হালিমা হালিনা। ছবি: সংগৃহীত

নিউইয়র্কে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর সংখ্যা ৩২ হাজার বলা হচ্ছে। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হাসপাতালের বাইরে যাদের মৃত্যু হয়েছে, কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার আগে উপসর্গ নিয়ে যারা মারা গেছে, সংখ্যার হিসাবে তাদের ধরা হয়নি। চার মাসে এত মৃত্যুর শোক নিয়ে এ নগরী আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আমেরিকার দূরান্তরের রাজ্যে আবারও সংক্রমণের বিস্তার দেখে নিউইয়র্কে লোকজন আতঙ্কিত। অনেকেই ফিরে দেখছেন তাঁদের বিপন্ন সময়ের বাস্তবতা। যাঁরা সামনে থেকে দেখেছেন এ মৃত্যুর মিছিল, তাঁদের কাছে করোনাকাল শুধু এক মানবিক বিপর্যয়ের স্মৃতিই নয়; সম্মুখসারির এসব করোনা যোদ্ধার কাছে বিপন্ন সময়ের এ লড়াই সারা জীবনকে তাড়িত করার ঘটনা।

ব্রুকলিনের কোনি আইল্যান্ড হাসপাতালে কাজ করেন যশোরের মেয়ে হালিমা হালিনা। মা-বাবার বাড়ি কুমিল্লায় হলেও বাবার চাকরিসূত্রে যশোরেই তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। প্রায় ১০ বছর থেকে আমেরিকাপ্রবাসী হয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবী হিসেবে পেশা শুরু করার আগে হালিমা জানতেন না, তাঁর জীবনে এমনও কিছু ঘটবে। আতঙ্ক আর মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বিপর্যস্ত মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। নিজের মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন কাজ করেছেন কোনি আইল্যান্ড হাসপাতালের এ স্বাস্থ্য সহকারী। হাসপাতালের ইন্টারভেনশন রেডিওলজিতে কাজ করার সুবাদে দেখেছেন একের পর এক মৃত্যুপথযাত্রী করোনায় সংক্রমিত রোগীকে।

হালিমা বলেন, মধ্য মার্চের আগেই কোভিড-১৯ সামাল দিতে হাসপাতালে তাঁদের প্রস্তুত রাখা হয়। পিপিপি ব্যবহারসহ নিজেদের সুরক্ষিত রেখে রোগীর সেবা দিতে তাঁদের দ্রুত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সময়েই নিজের জীবন নয়, অন্যের জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। মার্চের শেষ থেকে একের পর এক মৃত্যু আর হাসপাতালের বেসামাল অবস্থা দেখেও দমে যাননি হালিমা। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর শরীর থেকে রক্ত নিতে হয়েছে, মারা যাওয়ার আগে শেষবারের মতো বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরতে হয়েছে। প্রতিবার ভয় না পেয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছেন হালিমা।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশিরা শুরুর দিকেই করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে হালিমা বলেন, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়গুলো শুরুতেই সবার কাছে পৌঁছানো হয়নি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বার্তা পৌঁছালেও স্বদেশিদের মধ্যে এ নিয়ে গুরুত্ব দিতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া নিউইয়র্কের অনগ্রসর ঘনবসতি এলাকায় তাঁদের কমিউনিটির বিপুলসংখ্যক লোকজনের বসবাস। জীবনমানের সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টা নিউইয়র্কে করোনায় নানা কমিউনিটির মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আবার প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। হালিমা নিজেও মনে করেন, এসবের কারণেই নিউইয়র্কে বেশ কিছু বাংলাদেশির অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আগাম সতর্কতা গ্রহণ করতে না পারায় দুঃখজনক সব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

করোনার সময় ঘরে নিজের ৬৬ বছর বয়সী মাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন হালিমা। প্রতিদিনই কাজে যাওয়া-আসার সময় নিজের কারণে মা সংক্রমিত হবেন কি না, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন থেকেছেন। নিজেকে নিয়ে উদ্বেগ যে ছিল না, তা নয়। তবে পেশাগত জীবনে দায়িত্ববোধই তাঁকে তাড়া করেছে সব সময়। নিজের পেশাটাকে ভালোবাসেন হালিমা। যেকোনো পরিস্থিতিতে রোগীকে প্রাধান্য দেওয়াই তাঁর পেশার ব্রত বলে জানালেন। মানুষের জন্য এ সময়ে নিজেকে কাজে লাগাতে পেরেছেন বলে নিজেকে ধন্য মনে করছেন। নিউইয়র্কে যখন স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্যসেবী–সংকটের কারণে রাজ্য নেতা থেকে সব মহলে হাহাকার ওঠে, হালিমা তখনো কাজ করেছেন নির্দিষ্ট সময়ের অনেক বেশি। মনে করেছেন, তিনি এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধের এক সৈনিক হিসেবে তাঁর ওপর দায়িত্ব পড়েছে। এ দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। যদিও গত চার মাসের সময়টা তাঁর সারা জীবনকেই তাড়া করে যাবে। চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে বহু চোখের চাহনি তাঁর জীবনকে যেন বদলে দিয়েছে। মানুষের জন্য, মানুষের পাশে থেকে বাকি জীবনটা যেন উৎসর্গ করতে পারেন, এমন কামনা করেন এ স্বদেশি স্বাস্থ্যকর্মী।

করোনা সংক্রমণ চলে যায়নি। এ অদৃশ্য ভাইরাস তাড়া করবে আরও বহুদিন—উল্লেখ করে হালিমা বলেন, বাংলাদেশে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। ভয় না পেয়ে, আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। সংক্রমিত হওয়ার আগে কীভাবে সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব, তা সবাই জানেন। নির্দেশগুলো সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করা এবং সংক্রমিত হয়ে গেলে ভয় না পেয়ে সাহসের সঙ্গে তা মোকাবিলা করার আহ্বান জানান হালিমা হালিনা।

নিজে স্বাস্থ্যসেবী হয়েও করোনার সময়ে কাজ করা সব জরুরি বিভাগের কর্মীদের স্যালুট জানালেন হালিমা। তিনি নিজেও এ অভিবাদনের যোগ্য হয়েও বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে আসা এ বঙ্গকন্যা মনে করেন, ইতিহাসের দায় মেটানোই মানুষের কাজ। একজন স্বাস্থ্যসেবী হিসেবে সময়ের দায়িত্ব পালন করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভাইরাসটি নিয়ে একটা সমাধানে না আসা পর্যন্ত সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই। সংকট শেষ হয়ে যায়নি, বরং অসাবধানতার সময়ে সংকট আরও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। এ কারণে স্বাস্থ্যবিধি কঠিনভাবে মেনে চলাসহ ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে সচেতন থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানালেন নিউইয়র্কের এ স্বাস্থ্যকর্মী হালিমা হালিনা।