বর্ণবাদের আঁধার কাটবে

রাজিয়া উদ্দিন। ১৯৭১ সালে পাতাকা হাতে মার্কিন পররাষ্ট দপ্তরের সামনে বিক্ষোভে ছবি সংগৃহীত
রাজিয়া উদ্দিন। ১৯৭১ সালে পাতাকা হাতে মার্কিন পররাষ্ট দপ্তরের সামনে বিক্ষোভে ছবি সংগৃহীত

আমেরিকাজুড়ে আজ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে আবারও সোচ্চার হয়েছে। আমাদের অনেকের ধারণা ‘ব্ল্যাক লাইভ মেটার’ আন্দোলন কেবল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের আন্দোলন। কথাটি যে ঠিক নয়, তা আমাদের অভিবাসন আর বৈষম্যের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে উঠে।
এশীয় অভিবাসীরাও আমেরিকায় বর্ণবাদের শিকার হয়েছে বা হচ্ছে নগ্নভাবে। আজকের চলমান আন্দোলন বৈষম্যের নানা পথ পেরিয়ে আসা সংগ্রামী মানুষের আন্দোলন হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলনে শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই নয়, বৈষম্যের শিকার সব বর্ণের মানুষ উপকৃত হওয়ার সুযোগ সব সময় বিদ্যমান ছিল। 

আমেরিকায় প্রতিটি অভিবাসীর নিজস্ব একটি ইতিহাস আছে। একজন বাংলাদেশই আমেরিকান হিসেবে আমার নিজেরও এমন একটি ইতিহাস রয়েছে। ১৮৮২ সালে মার্কিন কংগ্রেস চায়নিজ এক্লিউশন আইন পাশ করে। আমেরিকার ইতিহাসে এটাই কোন প্রথম আইন, যা একটি দেশের মানুষকে আইন করে আমেরিকায় আসা নিষিদ্ধ করে। এরপর কংগ্রেস ১৯২৪ সালে এশিয়ান ইমিগ্রেশন আইন পাস করে, যা মূলত এশিয়া থেকে সব মানুষের অভিবাসন নিষিদ্ধ করেছিল।
আমার বাবা, মহিব উদ্দিন ১৯৩০ দশকের শেষ দিকে ব্রিটিশ মার্চেন্ট মেরিনের কর্মী হিসেবে আমেরিকার উপকূলে এসেছিলেন। শীতকালের হিমশীতল আবহাওয়ায় আমার বাবা অন্য এক সিলেটী সহকর্মীসহ আমেরিকায় অবৈধভাবে ঢুকতে জাহাজ থেকে সটকে পড়েছিলেন। এটি ছিল মহামন্দার সময়। তখন আমেরিকায় ভিন্ন বর্ণের মানুষের জন্য কাজ পাওয়া শক্ত হয়ে উঠেছিল। ১৮০০ শতাব্দীর শেষ দিকে আমেরিকায় ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববাংলা থেকে আরও কিছু মানুষের আগমন ঘটেছিল একই ধারায়। যারা নিউইয়র্কের হারলেমসহ নিউজার্সির বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
আমার বাবা মহিব উদ্দিন ১৯৪৪ সালে আমেরিকার নাগরিক হয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি মিশিগানের ডেট্রয়েট নগরে স্থায়ী হন। সেখানে তিনি ফোর্ড মোটর কোম্পানির স্টিল বিভাগের একটি প্ল্যান্টে কাজ নিয়েছিলেন।
কংগ্রেসপ্রণীত ১৯৫২ সালের এবং ১৯৬৫ সালের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি আইন এশীয় অভিবাসীদের আমেরিকায় আসা এবং নাগরিকত্ব গ্রহণের বাধা দূর করে। আমার বাবা মহিব উদ্দিন তখনই দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলেন একজন বৈধ অভিবাসী হিসেবে। বিয়ে করলেন আমার মা রাজিয়া উদ্দিনকে। আমার মা রাজিয়া ১৯৬৫ সালে আমেরিকায় আসেন এবং তিনি আমেরিকায় আসা দ্বিতীয় কোন বাংলাদেশি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) নারী, যিনি আমেরিকান নাগরিককে বিয়ে করে অভিবাসী হতে পারলেন। আমি ও আমার বড় ভাই আমেরিকায় জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি কোন বৈধ অভিবাসী দম্পতির সন্তান, যাদের জন্ম আমেরিকায় হয়েছে।
১৯৬৫ সালের পর থেকে বেশ কিছু বাংলাদেশির আগমন ঘটে আমেরিকায়। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়। আমেরিকার সরকার তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আমেরিকায় বসবাসরত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খুব বেশি লোকজন ছিলেন না। ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছিল। আমার মা রাজিয়া উদ্দিন মিশিগান থেকে ছুটে আসেন ওয়াশিংটন ডিসিতে। যোগ দেন বিক্ষোভ সমাবেশে। বাংলাদেশের পতাকা হাতে অন্য একজন নারীও যোগ দেন এই সমাবেশে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ আমার মা রাজিয়া উদ্দিন আজ আর অন্য সেই বাঙালি নারীর নাম স্মরণ করতে পারেন না। যারা নিজেদের যৌবনে স্বদেশের স্বাধীনতার পতাকা হাতে মুক্তির স্লোগান উচ্চারণ করেছিলেন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশে। যেখানে উন্নত জীবনের সন্ধানে আমার বাবা তাঁর প্রাক যৌবনে জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে আমেরিকার অভিবাসী জীবনের কঠিন সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কঠিন পরিশ্রম করেও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। সমাজ সভ্যতা এগিয়ে গেলেও এ দেশে বৈষম্যের আওয়াজ আজও উঠছে। বর্ণবাদী এই বৈষম্যের আঁধার একদিন কাটবেই।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, মনমাউথ ইউনিভার্সিটি, নিউজার্সি।