শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা

নিউইয়র্কে লকডাউন শিথিল করা হলেও এখনো বাসাতেই থাকছে  সবাই। বাবা রেশাদ ও মা আইরিন কোয়ালিটি টাইম দিচ্ছেন এখন মেয়ে রিদাকে
নিউইয়র্কে লকডাউন শিথিল করা হলেও এখনো বাসাতেই থাকছে সবাই। বাবা রেশাদ ও মা আইরিন কোয়ালিটি টাইম দিচ্ছেন এখন মেয়ে রিদাকে

ইতিবাচক মনোভাব শরীর মন দুটোকেই সুস্থ আর চাঙা রাখতে সাহায্য করে। যে কারণে পরিবারের একজন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর যথেষ্ট দুশ্চিন্তা থাকা সত্ত্বেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়িনি। এরই মধ্যে বাড়িতে বসে একাডেমিক-অফিশিয়াল কাজকর্মে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বাড়ির লোকজনেরা। কোভিড-১৯-এর প্রচুর নেতিবাচক দিক আছে, অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু একই সঙ্গে ইতিবাচক দিকও একেবারে কিন্তু কম নেই। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে দিকগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচিতি গড়ে উঠেছে।
লকডাউনের কারণে আমাদের প্রায় সবার হাতে প্রচুর সময়। যেসব কাজ সময়ের অভাবে করা হয়ে ওঠেনি এত দিন, সেগুলো আস্তে ধীরে করে নেওয়ার দারুণ সুযোগ পাওয়া গেছে। ঘরের কাজে বেশি সময় বরাদ্দ করা সম্ভব হয়েছে। বাগান কিংবা বাড়ি ক্লিনিংয়েও শুধু উইকেন্ডের আশায় বসে না থেকে যেকোনো দিন হাত লাগানোর সুযোগ পাওয়া গেছে। আমাদের বেসমেন্টে অব্যবহৃত জিনিসপত্র ঢাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে বহুদিন ধরে। এবার সেগুলোর একটা ব্যবস্থা নেবারও সুযোগ পাওয়া গেছে। এ বছর বাগান করা হবে না—এমনটা ভাবলেও শেষমেশ বাগানপ্রিয় আপুটা ঠিকই নিজের মতো স্বল্প পরিসরে বীজ থেকে চারা তৈরি করে গাছ লাগিয়ে ফেলেছে। কাজের ব্যস্ততায় আগে গাছ লাগাতে গিয়ে বেচারির কাহিল অবস্থা হতো। অন্যরাও তেমন সাহায্য করতে পারত না, এ বছর বাগানের কাজে বড় ছেলেটা আর ভাইয়া খুব সাহায্য করেছে। টমেটো, মরিচ, বেগুন, লাউ, ঢ্যাঁড়স, জুকিনিসহ বেশ কিছু ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে সময় নিয়ে। সময়ের টানাটানির কারণে আগের মতো হুটোপাটি করা লাগেনি।
আমাদের পরিবারের খুদে সদস্যটি আর দশটা শিশু থেকে আলাদা। ওকে বিশেষ তদারকিতে রাখতে হয়। এই দেখাশোনার দায়িত্বটা আমরা নিজেরাই বরাবর করে আসছি। এ জন্য সময় দিতে হয় যথেষ্ট। খাওয়া-দাওয়া, গোসল ইত্যাদি কাজ আমাদের সাহায্য ছাড়া ওর একার পক্ষে করা সম্ভব না। সবাই বাড়িতে থাকায় ওকে দেখাশোনার কাজটা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজে করা সম্ভব হয়েছে। স্কুল যেতে হয় না বলে ওর খাওয়া-দাওয়াতেও একটা রুটিনে আনা গেছে লকডাউনে। স্কুলের শিক্ষকেরা যথেষ্ট চেষ্টা করেও হয়তো অনেক সময় তাকে খাওয়াতে ব্যর্থ হতেন। ফলে দিনের অনেকটা সময় বাচ্চাটা না খেয়েই কাটিয়ে দিত। এখন সারাক্ষণ বাড়িতে থাকায় সময় দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা চালানো যাচ্ছে। এমনিতেই এসব বাচ্চা একটু অস্থিরমতি হয়ে থাকে। হঠাৎ স্কুল বা বাইরে যাওয়া কেন বন্ধ, সেটা ওরা বুঝতে পারছে না ঠিকঠাক। যে কারণে হতাশাজনিত অস্থিরতায় ওরা আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের বাচ্চাটি যেহেতু কথাও বলে না, ওর অস্থিরতা বুঝে নেওয়া একার পক্ষে অনেক সময়ই কঠিন হয়ে যায়। এখন বাড়িতে সবাই থাকার কারণে সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে ওর অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা সহজ হচ্ছে। প্রয়োজনে যখন-তখন ডাক্তারের পরামর্শও নেওয়া যাচ্ছে। আর চোখের সামনে পুরোটা সময় বাবা-মা-ভাই সবাইকে দেখতে পেয়ে সেও কিন্তু কম খুশি নয়। সময়ে সময়ে সেটা ওর আনন্দে ভরা ছোটাছুটি জানান দেয়।
হাতে যথেষ্ট সময় থাকায় পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের সঙ্গে গল্প আড্ডায় যখন-তখন সময় কাটাতে পারাটাও তো অনেক বড় পাওয়া। ভাইয়া সব সময় বাড়িতে থাকায় কম্পিউটারসহ নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে দিনের যেকোনো সময় তাঁর সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে; ভাইয়ার কাছ থেকে অনেক অজানা বিষয় শেখার সুযোগও হচ্ছে। বাড়ির বড় ছেলেটাকে পড়াশোনার জন্য বছরের বেশির ভাগ সময়ই বাইরে থাকতে হয়। সে পড়াশোনা করে পার্ডুতে, থাকে ইন্ডিয়ানায়। শান্ত স্বভাবের ছেলেটা বাড়ি না থাকলে গোটা বাড়িটাই আমাদের কাছে কেমন ফাঁকা লাগে। আসলে বাড়ির একজন সদস্য বাড়িছাড়া থাকলে যেকোনো অছিলায় তার অনুপস্থিতিটা মন খারাপ করিয়ে দেয়। ভালো কিছু রান্না হলে, কোথাও বেড়াতে গেলে সেটা আরও বেশি মাত্রা পায়। লকডাউনের পুরোটা সময় ছেলেটা বাড়িতে আছে। এটা আমাদের সবার জন্য দারুণ একটা পাওনা।
আগে প্রায় খাওয়ার টেবিলে আপুর মন খারাপের দীর্ঘশ্বাস শোনা লাগত, ‘ছেলেটা কী খাচ্ছে না খাচ্ছে।’ মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করা রান্নাপ্রিয় আপু এখন প্রায় নানা রকমের সুখাদ্য রান্না করছে আর আমরা সবাই সেটা একসঙ্গে বসে খাচ্ছি। এটা কী কম বড় আশীর্বাদ! সেই সঙ্গে কঠিন এই সময়টা আমাদের খুব ভালো করে শিখিয়ে দিয়েছে, কোনোভাবেই যেন খাবার নষ্টের বিলাসিতায় না ভাসি। বহু মানুষ এখন একবেলা খাবার জোগাড়ের চিন্তায় অস্থির। এটাও একটা বড় শিক্ষা বৈকি।
আমরা যারা বই পড়তে ভালোবাসি অথচ সময়ের অভাবে পছন্দের বইগুলো পড়া হয়ে ওঠে না। তাদের জন্য কঠিন এই সময়টা যেন একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ফলে জমে যাওয়া প্রচুর বই পড়ে নেওয়া যাচ্ছে। অনেক অচেনা লেখকের সঙ্গেও পরিচয় ঘটছে। বই পড়ার পাশাপাশি নিয়মিত সিনেমা দেখতে খুব পছন্দ করি। অনলাইনে চলা বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবও চুটিয়ে দেখে নেওয়া গেছে। করোনার কারণে দেশ-বিদেশের প্রচুর ভালো ভালো সিনেমা দেখার সুযোগ পাওয়া সম্ভব হয়েছে। করোনা সংকটের কারণে বিশ্বের অনেক নামী চলচ্চিত্র উৎসব একসঙ্গে অনলাইনে প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেয় এ বছর। ট্রাইবেকা এন্টারপ্রাইজ এবং ইউটিউব হাত মিলিয়ে ‘উই আর ওয়ান: আ গ্লোবাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-প্ল্যাটফর্মে সেসব দেখানোর আয়োজন করে। ২৯ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত দেখানো হয় বেশ কিছু নতুন ছবি ও ক্ল্যাসিক সিনেমা। অনলাইনে ১০ দিনের গ্লোবাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শামিল হয়েছিল ‘বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ‘সানড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ‘সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ‘টোকিও ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ‘টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ‘ট্রাইবেকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যা একেবারে সামনের সারিতে। ইউটিউবে নির্বাচিত সেসব সিনেমা বিনা মূল্যে দেখার সুযোগ ছিল। অবশ্য অনেকেই কোভিড-১৯-এর জন্য গঠিত ফান্ডে ডোনেট করেন যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। স্বাভাবিক সময়ে এভাবে একসঙ্গে এত সিনেমা দেখা কখনো সম্ভব হতো না। হয়তো এভাবে পাওয়াও হতো না মহতী একটা কর্ম প্রচেষ্টার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ।
বাড়তি খরচের হুজুগ থেকে আমার মতো অনেককেই দিব্যি বাঁচিয়ে দিয়েছে কোভিড ১৯ এর রূঢ় বাস্তবতা। আমি অনলাইনে প্রচুর টুকিটাকি কেনাকাটা করি। চোখে না দেখে কেনা লাগে বলে অনেক সময় পুরো পয়সাই জলে পড়ে। ভূরিভোজের দাওয়াত এড়িয়ে মলে ঘুরতেও আমার বেশি আগ্রহ। শুধু শুধু কী আর ঘুরে বেড়ানো যায়। এ দোকান, সে দোকান করতে গিয়ে ঠিকই কিছু না কিছু কেনাকাটা হয়েই যায়। আড়াই মাসের বেশি সময় পেরিয়েছে, সব রকমের কেনাকাটা একদম বন্ধ। তাতে কিস্যু ক্ষতি কিন্তু হয়নি। বরং বাড়তি কেনাকাটার হুজুগ থেকে বিরত থাকার একটা অভ্যাস জন্ম নিয়েছে নিজের মধ্যে। ভবিষ্যতের জন্য এই অভ্যাসটা ধরে রাখার চেষ্টা থাকলে আখেরে নিজেরই লাভ।
বিশ্বাস শব্দটায় একটা জাদু আছে। কোভিড-১৯ আচ্ছন্ন এই অসহ্য সময়টা একদিন নিশ্চয়ই ফুরাবে। ঝড় থামবেই—এমন বিশ্বাসে আস্থা রাখা সম্ভব হলে মন অনেকটাই ভারমুক্ত থাকার ফুরসত পাবে। কিন্তু চারপাশে প্রতিদিন একাধিক মৃত্যুর খবর, মানুষের স্বার্থপরতার মন ভাঙা বৃত্তান্ত, নেতিবাচক প্রচার, ইত্যাদি এড়িয়ে কীভাবে সম্ভব মনকে সতেজ রাখা? তেমনটা করতে কিছুটা স্বার্থপরই না হয় হলেন। হঠকারী কিংবা অপরিণামদর্শী আবেগ শুধু আপনার একার নয়, গোটা পরিবারের বিপদের কারণ হতে পারে, সেরকম পদক্ষেপ নাইবা নিলাম এখন। পরিবারের সবার কথা মাথায় রেখে কিছুটা স্বার্থপর হলে এ ক্ষেত্রে ক্ষতি তো নেই, বরং লাভই। কারণ, আপনার সুস্থ থাকা মানে আর পাঁচজনকেও সুস্থ নিরাপদ থাকায় অনুপ্রাণিত করা। আর অন্যকে সাহায্য করার জন্য সরাসরি জড়িত না হয়েও সেটা করার বিভিন্ন উপায় আছে। কমিউনিটিতে খোঁজখবর করলে তার হদিস পাওয়াটা খুব কঠিন নয়। বহু জায়গায় মসজিদ থেকে কিংবা ক্র্যাফ্টার বন্ধুরা মিলে ঘরে বসে বিপুলসংখ্যক মাস্ক তৈরি করে যাদের প্রয়োজন সেখানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যাদের অবস্থা, ‘আজ জুটেছে, কাল কী হবে? কালের ঘরে শনি’— সেরকম পরিবারের খাবারের ব্যবস্থায় দূরে থেকেও আপনি দিব্যি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন।
মন ভালো করার নিজস্ব কৌশলও কাজে লাগানো যেতে পারে। আমার এক বন্ধু যেমন করোনা শুরুর দিকে একদিন প্রস্তাব দিল, চারপাশের চাপযুক্ত খবর থেকে নিজেদের কিছুটা মুক্ত রাখতে এসো আমরা একটি কাজ শুরু করি। সেটা কী রকম? সে বলল, প্রতিদিন আমরা একে অন্যকে দিনের শুরুতে একটা ছবি তুলে পাঠাব। ছবির বিষয়বস্তু যেকোনো কিছু হতে পারে। এতে করে মন অন্য দিকে ঘুরবে। সত্যিই তাই হয়েছে। একটা চুলের ক্লিপ, গাছের একটা পাতা, পড়তে থাকা কোনো বইয়ের কয়েকটা লাইন—কত কত ছবি যে আমরা এই সময়ে নিজেদের মধ্যে চালাচালি করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। অনেকের কাছে সেটা হয়তো কিছুই না, আমাদের কাছে সেটা একটা মজার খেলা। একটা গোটা গল্প, যা মন ভালো রাখতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
আরও কয়েকটি বিষয়ে নজর দিলে মন খারাপেরা ছুটি নিয়ে দূরে কোথাও হাঁটা দেবে। যেকোনো সম্পর্ককে এখন আগের চেয়ে আরও বেশি যত্নআত্তিতে রাখতে হবে। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সুসম্পর্কের বিষয়টাকে গুরুত্ব দিলে মনটা জট পাকানোর চাপ থেকে মুক্ত থাকবে। এই যে চলমান পরিস্থিতি, সেটা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের অনেকের নেতিবাচক মনোভাব প্রথমদিকে আমাদের জন্য যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হয়েছে বলেই মনে করি। পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারাটাও একটি চমৎকার ইতিবাচক দিক। যেহেতু আমরা কেউ জানি না, করোনার এই দমবন্ধ সময়টা কবে যাবে, কবে পৃথিবী আবার পুরো মাত্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। তাই নিজেকেসহ আশপাশের সবাইকে সুস্থ নিরাপদ রাখার জন্য সাবধানতা অবলম্বনের পাশাপাশি আমাদের প্রচণ্ডভাবে আশাবাদী থাকতে হবে। অন্যকেও শোনাতে হবে সেই আশার অমৃত বাণী। অসহ্য সময়টা দ্রুত কেটে গিয়ে পৃথিবী ফিরে আসুক নিজস্ব ছন্দে। আবার মানুষের প্রাণের ছন্দে-আনন্দে উৎসবমুখর হোক পৃথিবী নামের প্রিয় গ্রহটি। শুভ হোক, মঙ্গল হোক।