বিজ্ঞান যেভাবে গণমাধ্যমে আসা উচিত

বিজ্ঞান নিয়ে কৌতূহল পৃথিবীর প্রায় সব অগ্রসরমাণ সমাজের সাধারণ মানুষের ভেতর দেখা যায়। বিজ্ঞানের অবদান প্রতিটি শিক্ষিত সমাজ একবাক্যে স্বীকার করে নেয়। বিজ্ঞানকে খালি ল্যাবরেটরি বা বিজ্ঞান প্রকাশনায় বন্দী করে রাখলে হয় না। সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হয় বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর জন্য, মানুষকে বিজ্ঞান সচেতন করতে। এ জন্যই বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে বিজ্ঞানের অবদান রাখার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক। প্রায় এক শ বছরের কাছাকাছি ধরে সংবাদমাধ্যমগুলো এই কাজটি করে যাচ্ছে [তথ্যসূত্র ১ ]।
কিন্তু, বিজ্ঞানকে সাধারণের মতো করে তুলে ধরা একটু জটিল কাজ বটে। প্রথমত, বিজ্ঞানের যেকোনো শাখা অনেক দিনের অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সাধনার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই, বিজ্ঞানের যেকোনো একটি শাখার গবেষণার ফলাফল সাধারণ শিক্ষিত মানুষ বা অন্য শাখার বিজ্ঞানী-গবেষকদেরও বুঝতে কষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত, বিশেষ বিশেষ বিজ্ঞানের শাখায় বিশেষ বৈজ্ঞানিক ভাষার ব্যবহার হয়। এই ভাষাগুলো কেবল ওই শাখার বিজ্ঞানী এবং গবেষকেরা বুঝে থাকেন। অন্যরা বুঝতে চাইলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন, অনেক পড়াশোনা এবং সাধনা করতে হয়।
তৃতীয়ত, যিনি বিজ্ঞান গবেষণার যেই শাখায় দক্ষ হন, তিনি তার সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানের ভাষাতেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সাধারণের মতো বুঝিয়ে তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলকে ব্যাখ্যা করা তার জন্য কঠিন হয়। এ জাতীয় আরও অনেক কারণে অনেক ভালো ভালো বিজ্ঞান গবেষণার ফলাফল সাধারণের কাছে অব্যক্ত থেকে যায়।
বিজ্ঞান ও সাধারণের এই দূরত্ব কমিয়ে আনতে বর্তমানে গবেষণা সংস্থাগুলো আলাদা যোগাযোগ বিভাগ রাখে। তারা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সহায়তা নিয়ে গবেষণার ফলাফল সাধারণের উপযোগী করে গণমাধ্যমে উপস্থাপন করেন। যোগাযোগ ও গণমাধ্যমের এই কার্যক্রম বিজ্ঞান ও গবেষণার ফলাফলকে বৃহত্তর সামজে অবদান রাখতে বেশ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু, আদৌ সেই গবেষণার ফলাফল মানুষের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে কিনা, সেটা নির্ধারণ করতে পারে কে? ওই বৈজ্ঞানিক ফলাফল সঠিক বৈজ্ঞানিক পন্থায় হয়েছে কিনা; ফলাফলগুলো বিজ্ঞান-গবেষণাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে কিনা; বিজ্ঞানী, গবেষক, ছাত্র-শিক্ষকদের জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে অবদান রাখবে কিনা; বিজ্ঞানের নামে নকল হয়েছে কিনা; মানুষ ও পরিবেশের জন্য ওই গবেষণা ক্ষতিকর কিনা—এই বিষয়গুলো নির্ধারণ করবে কে? এটি যোগাযোগ, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের কাজ না। এগুলোর জন্য গবেষণার প্রকারভেদে বিভিন্ন প্রোটোকল বা পর্যায় আছে। সেগুলো না মেনে চলে কোন ভালো গবেষণাও স্বীকৃতি পায় না। এমন চারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রটোকল হচ্ছে—১. পিয়ার রিভিউ, ২. গবেষক দল ও সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ৩. সঠিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশনা এবং ৪. নৈতিকতার ছাড়পত্র।
১. পিয়ার রিভিউ হচ্ছে কোন একটি গবেষণার ফলাফলকে সেই শাখায় দক্ষ অনুরূপ কোন বিজ্ঞানী বা গবেষকদের মাধ্যমে পর্যালোচনা করা। এতে গবেষণায় দুর্বলতাগুলো অনেক কমে যায়। যত বড় বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রবন্ধ পাঠানো হয়, সাধারণত তত বেশি গভীর পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে এত বিষয়ভিত্তিক দক্ষ বিজ্ঞানী থাকেন না বা গবেষকদের নিজেদের ভেতর পরিচয় থাকার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা হয় না। তাই, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রবন্ধ আকারে গবেষণার ফলাফল পাঠাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার এতে দীর্ঘসূত্রতা কাজ করে। তাই, স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য গবেষণাকে স্থানীয় পর্যায়ে পর্যালোচনা করা হয় স্থানীয় অভিজ্ঞদের মাধ্যমে, স্থানীয়ভাবে বিশেষায়িত সংস্থার মাধ্যমে। যেভাবেই সেটা করা হোক না কেন, এই পদ্ধতিটি বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই কোন গবেষণার ন্যূনতম স্বীকৃতি পেতে হলে।
২. কোন একটা বিষয়ে কারা গবেষণা করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, রোগ বিস্তার সংক্রান্ত গবেষণায় বাংলাদেশের আইসিডিডিআর, বি—এর বিশ্বব্যাপী একটা স্বীকৃতি আছে, তাদের অতীতে এই ধরনের অনেক সফল গবেষণাকর্মের জন্য। ভারতের মহাকাশ গবেষণায় অনেক দক্ষ বিজ্ঞানী তাদের নিজের দেশেই আছে, কারণ তারা মহাকাশ নিয়ে অনেক আগে থেকে গবেষণা করছেন। এখন হঠাৎ করে কোন প্রতিষ্ঠান, দেশ বা কোন বৈজ্ঞানিক দল যদি বিশাল কোন গবেষণার আয়োজন নিয়ে বসেন যে বিষয়ের অতীত অভিজ্ঞতা, স্বীকৃতি বা যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তাদের নেই, অবশ্যই তাদের অনেক বেশি রিভিউয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ রাখতে হবে এবং রাতারাতি তারা স্বীকৃতি পাবেন না।
ব্যক্তিবিশেষকেও অনেক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাদের নিজ শাখায় অবদানের জন্য। যেমন, বাংলাদেশের নগর গবেষণার ক্ষেত্রে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের নিজস্ব মতামতকে গবেষণার কাজে ব্যবহারের সুযোগ থাকে। কারণ, তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের নগর নিয়ে গবেষণা এবং কাজ করেছেন, যেখানে তার একটা খ্যাতি আছে। তবে সেটা সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা। মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে সেই সুযোগ তেমন নেই।
৩. ভালো গবেষণার অন্যতম স্বীকৃতি হচ্ছে সঠিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে গবেষণাকে প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রকাশনা না হলে, বর্তমান যুগে তাকে খুব একটা গ্রহণযোগ্য গবেষণাকর্ম বলা যায় না। বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় নিরপেক্ষ পিয়ার রিভিউ হয়ে থাকে, নকল এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়, গবেষণার বিষয়বস্তু সঠিক বিষয়কে স্পর্শ করেছে কিনা, যাচাই করা হয়। সাময়িকী ভেদে, রিভিউয়ের জবাবের সময় হিসেবে এর দীর্ঘসূত্রতা বিভিন্ন হতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে কোন একটি সমস্যার তড়িৎ সমাধান দরকার হয়ে পড়ে। যেমন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে বিজ্ঞানীদের দ্রুত সমস্যার সমাধান দরকার। এ জন্য, সাময়িকীগুলো দীর্ঘসূত্রতা এড়ানোর জন্য গবেষক দল ও প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে দ্রুত অনলাইনে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে দিচ্ছে। কিন্তু, এর মানে এই নয়, এগুলো সাময়িকীগুলো গ্রহণ করে নিয়েছে। সারা পৃথিবী থেকে তাদের এই গবেষণাগুলো পর্যালোচনা হচ্ছে এবং যখন সাময়িকীগুলো দেখবে এগুলোর তেমন বৈজ্ঞানিক গুণগত মান নেই, তখন তারা এগুলো সরিয়ে ফেলবে। প্রেক্ষাপট যাই হোক, ভালো বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ না পেলে ভালো বিজ্ঞান গবেষণার স্বীকৃতি বর্তমান দুনিয়ায় নেই।
৪. নৈতিকতার ছাড়পত্র কতটা জটিল হতে পারে তা নির্ভর করে গবেষণার ধরনের ওপর। রোগবিদ্যা বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া অনেক বেশি জটিল। এ ক্ষেত্রে আলাদা সংস্থা থাকে। তারা আলাদা কমিটি করে সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ করে মানুষের ওপর পরীক্ষা চলালে কমিটিকে অনেক বেশি যাচাই করতে হয়। দেখতে হয় এতে কোন ক্ষতিকর প্রভাব মানবদেহে আছে কিনা; কীভাবে মানুষগুলো বাছাই করা হবে; যারা গবেষণা করবে তাদের এই বিষয় শিক্ষাগতযোগ্যতা এবং অতীত গবেষণার অভিজ্ঞতা আছে কিনা; গবেষণার প্রস্তাব বা প্রাথমিক ফলাফল পিয়ার রিভিউ হয়েছে কিনা; যেই রোগীর ওপর গবেষণা করা হবে এতে তার সম্মানহানি হবে কিনা; রোগীর সম্মতি কীভাবে নেওয়া হবে সেটা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে কিনা; পরীক্ষা চলাকালে কোন একটা বিষয়ের এদিক-ওদিক হলে সেটা আবার কমিটির মাধ্যমে যাচাই–বাছাই করতে হবে; যথাযথ হাসপাতালের সম্মতি লাগবে, ইত্যাদি আরও নানা বিশয় জড়িত [তথ্যসূত্র ২ ]।
সুতরাং, এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলি উপেক্ষা করে যদি কোন গবেষণার ফলাফল শুধু গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে সেটা সঠিক বিজ্ঞান চর্চার পরিপন্থী। এভাবে গবেষণার স্বীকৃতি আদায় করতে চাওয়া, সাধারণ মানুষের কাছে ভুলভাবে বিজ্ঞানকে উপস্থাপনা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের ভাষা বোঝে না। তারা বোঝে কিছু আবিষ্কার হয়েছে কি হয়নি। না হয়ে থাকলেও আবিষ্কার হতে আরও কত দিন।
যেমন, বর্তমানে করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরাও খোলাসা করে কিছু বলছেন না, কারণ, তারা এখনো সাধারণ মানুষের মতো করে ফলাফল প্রকাশ করার পর্যায়ে আসেননি। তারা হুট করে কিছু বলে ফেললে সেটা জনমনে ভুল ধারণা জন্ম নিতে পারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার সঠিক প্রোটোকল না মেনে গণমাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ফলাফল প্রকাশ করা যে কতটা অবৈজ্ঞানিক সেটা স্বনামধন্য ‘সায়েন্স’ সাময়িকীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলছি ‘…reporting the main findings of a paper in the mass media can compromise the novelty of the work and thus its appropriateness for a Science Journal. Therefore, authors should feel free to present their data at scientific meetings but should not overtly seek media attention or give copies of the figures or data from their manuscript to any reporter…’ [তথ্যসূত্র ৩ ]। অর্থাৎ, সংক্ষেপে বলা যায়, ‘সায়েন্স’ সাময়িকীতে পাঠানোর আগে গবেষণার কোন ফলাফল মিডিয়াতে উন্মুক্ত করলে গবেষণা কর্মের নতুনত্ব থাকে না, যেটা ওই সাময়িকীর সঙ্গে যায় না। তবে কোন বিজ্ঞান সভায় গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করায় বাধা নেই। তাই, গবেষণার ফলাফল সেটা প্রাথমিক হোক আর চূড়ান্ত হোক, গণমাধ্যমে আনার আগে বৈজ্ঞানিক প্রটোকলগুলো মেনে আসা কাম্য।
এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও গবেষণার চর্চা করা মানুষদের আরও বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত। আর সাধারণ মানুষের বুঝতে হবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশে-বিদেশের বিজ্ঞানী গবেষকেরা কাজ করেন। তারা যোগ্য সম্মান চান, যোগ্য পারিশ্রমিক চান, জীবনের নিশ্চয়তা চান আরও আট/দশটা মানুষদের মতো। কিন্তু, তারকা হওয়ার খ্যাতি অর্জনের চেষ্টা কখনই একজন যোগ্য ও সৎ বিজ্ঞানী বা গবেষকের কাজ না।