টানেলের এপার-ওপার ও নিয়তি নির্ভরতা

এলিজাবেথান পিরিয়ডের নাটক ও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় ডেসটিনি বা নিয়তির খুব বড় একটি ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়। ম্যাকবেথ নাটকের প্রথম দৃশ্যেই দর্শকেরা দেখতে পান তিন ডাইনি এক ঊষর প্রান্তরে মিলিত হন। তাঁরা স্থির করেন যে, তাঁরা দেখা দেবেন ম্যাকবেথকে। রাজা ডানকানের দুই সেনানায়ক ম্যাকবেথ ও ব্যাঙ্কো নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডের যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করে যখন ফিরছিলেন, তখন সেই ঊষর প্রান্তরে ডাইনিরা তিনটি ভবিষ্যৎ বাণী করেন। তার মধ্যে একটিতে সেনাপতি ম্যাকবেথকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল, ‘বি কিং হিয়ার আফটার।’ (তোমার রাজা হওয়া অত্যাসন্ন।) আরেক সেনাপতি ব্যাঙ্কো যখন এ ভবিষ্যৎবাণীতে কিছুটা বিষণ্ন ও সন্দিগ্ধ, তখন তাঁকে ডাইনিরা বলে ব্যাঙ্কো নিজে রাজা না হলেও রাজবংশের জনক হবেন।
এই ভবিষ্যৎ বাণীগুলো শুনিয়ে দুই সেনাপতিকে অবাক করে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান ডাইনিরা। এর পর ভবিষ্যৎ বাণীকে সত্য প্রমাণিত করে ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করে রাজা হয়েছিলেন। হত্যার পর হত্যা। অপরাধের পর অপরাধ। লোভ, লালসা ক্ষমতার চূড়ান্ত দাপট নাটকটিতে দেখা যায়। এমন ভবিষ্যৎ বাণী বা নিয়তির কথা আমরা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব মাধ্যম যাত্রাপালাতেও দেখতে পাই। যাত্রাপালাতে এই ভবিষ্যৎ বাণী আমরা শুনতে পাই ‘বিবেক’-এর মুখ দিয়ে।
এলিজাবেথান যুগ পেরিয়ে আধুনিক, উত্তরাধুনিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। সাহিত্যের কোনো শাখায় এখন আর ডাইনি, ভূত বা নিয়তিবাদী কোনো চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় না। পৃথিবী এখন বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের সময় পার করছে। তাই যুক্তিবিহীন ভবিষ্যৎ বাণী এখন আর শুনতে পাওয়া যায় না। যুক্তির ধারাবাহিকতা পেরিয়ে অনেক বিষয়ের অনুমান শোনা যায় মাঝেমধ্যে। যে অনুমানে ডাইনি, ভূতের মতো কল্পিত, সংস্কারাচ্ছন্ন চরিত্রের উপস্থিতি নেই। তবে এ কথাও ঠিক, এলিজাবেথান পিরিয়ডের সাহিত্যে ডাইনিদের আমরা ইতিবাচক ও নির্মোহ ভূমিকাতেই দেখেছি বেশি। তাদের উপস্থিতি নির্মোহ, কোনো প্রভাব বিস্তার করার মতো কোনো উপাদান তাদের চরিত্রে দেখতে পাওয়া যেত না।
ভূমিকাহীনভাবে হঠাৎ করে অদৃষ্ট, নিয়তি, ডাইনি, এলিজাবেথান পিরিয়ড, ম্যাকবেথ নাটকের অবতারণা কেন? অদৃষ্ট, নিয়তির কথা যখন মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখন ম্যাকবেথ ও অন্য নাটকের নিয়তির কথা, ডাইনিদের কথা, আমাদের ‘বিবেক’ চরিত্রের কথা মনে হচ্ছে বারবার। চিন্তারও একটা লজিক্যাল সিকোয়েন্স বা যৌক্তিক রেখা আছে। তাই নিয়তির চিন্তাও এসেছে আরেকটি ভাবনাসূত্র থেকে। ভাবনাসূত্রটি হলো, বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে কয়েক দিন থেকে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে কিছু প্রতিবেদন প্রচার করা হচ্ছে। প্রতিবেদনগুলোর শিরোনাম হচ্ছে এ রকম, ‘টিকতে না পেরে ঢাকা ছাড়ছেন মানুষ’, ‘ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটিয়ারা বাড়ি ছাড়ছেন’।
টিকতে না পেরে মানে হঠাৎ করে আয় রোজগারহীন হয়ে বাড়ি ভাড়াসহ দৈনন্দিন খরচের আয় না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে ঢাকা ছাড়ছেন। কৌতূহল ও উদ্বেগের বশে গ্রহণযোগ্য তথ্য খুঁজতে থাকি, কতজন, কত পরিবার এ পর্যন্ত ঢাকা ছেড়েছেন, কোন পেশার মানুষ তাঁরা বোঝার চেষ্টা করি। আস্থায় নেওয়া যায়—এমন তথ্য খুঁজে পাই না কোথাও। পেশার কারণে তিন বছর অবস্থান করেছি উত্তরবঙ্গে, যেহেতু উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্যের হার এখনো বাংলাদেশের অন্য এলাকাগুলো থেকে বেশি। তাই পরিচিত সহকর্মীদের কাছ থেকে তথ্য নিতে চেষ্টা করি।
বিভিন্নজনের কাছ থেকে জানতে পারি, যারা ঢাকা ছেড়ে উত্তরবঙ্গে ফিরেছেন, তাঁরা হলেন ফুটপাথের হকার, রেলওয়ের মাস্টাররোলের চাকরিজীবী, বাবুর্চি, হোটেল রেস্তোরাঁর কর্মচারী, গার্মেন্টস কর্মী, গৃহকর্মের সহযোগী, ডেকারেটার্সের কর্মচারী ও মালিক, রিকশা ও ভ্যানচালক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাঁটাই হওয়া শিক্ষক, রেলস্টেশনের কুলি, শপিংমলের বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী, ফুটপাথের পাশের দোকানদারসহ অসংখ্য পেশার মানুষ। মনে পড়ে সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকের প্রথম দৃশ্যের কথা। মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। মানুষ জীবন বাঁচাতে ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে। সতেরো গ্রামের মানুষ মাতব্বরের আঙিনায় একত্রিত হয়ে জানাচ্ছে—‘মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/মানুষ আসতে আছে মহররমের ধুলার সমান।’ সে সময় সরাসরি প্রাণের ভয় ছিল, অত্যাচারের ভয় ছিল, নির্যাতনের ভয় ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে সংগত কারণেই সে রকম ভয়ের পরিস্থিতি এখন আর নেই। আর মানুষ এখন পালাচ্ছে না টিকতে না পেরে।
তবে ভয় আছে, ভিন্ন রকমের ভয়। জীবন থেমে যাওয়ার ভয়, জীবিকা হারানোর ভয়। জীবিকা হারিয়ে অনেকেই ইতিমধ্যে অনিশ্চিত জীবন তরীর যাত্রী হয়েছেন। তাঁরা কোনোভাবেই জানেন না বা অনুমান করতে পারছেন না তাঁদের জীবন তরী কোথায় গিয়ে নোঙর ফেলবে। এখানেই অদৃষ্ট, এখানেই নিয়তীনির্ভরতা। তাঁদের অনেকেই হয়তো স্বল্প সঞ্চয় ভেঙে কিছুদিন চলবেন। তারপর নিয়তি তাঁদের জীবন তরীকে কোথায় নোঙর ফেলতে বলবে, তাঁরা কোনোভাবেই অনুমান করতে পারবেন না। যারা বাড়িতে ফিরেছেন, তাঁদের অনেকেই এখন আর একটি দুর্যোগের মুখোমুখি। সেটি হলো বন্যা। ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র নদী হুংকার দিচ্ছে, আঙিনায় পানি, ঘরের ভেতরে পানি, ফসলের মাঠে পানি। সামান্য যা সম্বল ছিল তাদের, সে সম্বলও বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে অনেকের। ম্যাকবেথের ডাইনিদের মতো নিয়তির লিখন বলারও কেউ নেই। যদি থাকত, তাহলে অন্তত তাঁরা ভবিষ্যৎ বাণী পেতেন এবং সে অনুযায়ী জীবনকে নিয়ে এগোতে পারতেন। এই মুহূর্তে জীবন অনিশ্চিত। নিয়তির কুয়াশার চাদর দিয়ে মোড়ানো।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৮৩ শতাংশ কমে গেছে, যার অধিকাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশে ‘লকডাউন’-এর ফলে কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা হারিয়ে পরিবারসহ ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করা শুরু করেছে। ‘ব্র্যাক ইনস্টিটিউট ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন’ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ বলছে, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলে দিনে তিনবার খাবার খেতে সক্ষম পরিবারের সংখ্যা যথাক্রমে ২৪ শতাংশ ও ১৪ শতাংশ কমেছে। জীবিকা হারানো, আয় রোজগার কমে যাওয়ার কারণে নিরুপায় হয়ে মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। একাত্তরের পর এমন করে আর কখনো ঢাকা ছাড়েনি মানুষ। ঢাকা হলো বাংলাদেশের আয় রোজগারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহর। ঢাকা মানুষের জীবনকে ধারণ করার সুযোগ দেয়। ঢাকা সম্পদ সৃষ্টির উপায় বাতলে দেয়। ঢাকার ইতিহাসে কখনো মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার নজির নেই। ঢাকা হয়তো তিলোত্তমা নয়। কিন্তু ঢাকা বাংলাদেশের সব মানুষকে ধারণ করার মতো সক্ষমতা দেখিয়েছে সব সময়।
এত কিছুর পরও আমরা নৈরাশ্যবাদী নই। আমরা জানি, আমদের সরকার প্রধান অত্যন্ত বিচক্ষণ ও লড়াই করার মতো দুর্দান্ত সাহস আছে তাঁর। মাত্র কয়েক দিন আগে যখন সংসদে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মী যারা করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের এক মাসের খাওয়া বাবদ অস্বাভাবিক খরচ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তিনি তখন বলেছেন, এমন খরচ অস্বাভাবিক। তদন্তের প্রয়োজনীয়তা যে আছে তাও সরাসরি বলেছেন তিনি। স্বচ্ছতার ব্যাপারে তাঁর এমন অবস্থান নেওয়া আমাদের অনেক মনোবল জোগায়। ক্যাবিনেটকে যদি আমরা একটা দল হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে আমদের দলনেতা অসাধারণ।
শঙ্কার বিষয় দলনেতাকে যারা সহায়তা করবেন তাঁদেরকে নিয়ে। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেখানে বলেন, ‘যারা এ পর্যন্ত ভেন্টিলেটর লাগিয়েছে, তারা কেউ বাঁচতে পারেনি’, তখন সারা দেশের মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেখানে করোনার ঘোর দুর্যোগে যুদ্ধকালের মতো তৎপর, সেখানে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়তি নির্ভর ও সংস্কারাচ্ছন্ন। তাঁর কাছ থেকে এই মহামারি নির্মূলের কোনো মিশন, ভিশন দেখতে পাই না। আমাদের বিশ্বাস এমন অনিয়ম, দায়িত্বহীনতা, নিবেদনের ঘাটতির বিষয়গুলো আমাদের স্বপ্নচারী, কঠোর পরিশ্রমী, কৌশলী প্রধানমন্ত্রীর নজরে আছে। তিনি তাঁর দলের সদস্যদের পথের দিশা দেবেন, প্রয়োজনে ক্যাবিনেটে পরিবর্তন নিয়ে আসবেন।
আমরা আশা করব এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি হবে। জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় হবে পরিকল্পনা নিয়ে। দলের যোগ্য সদস্য যারা আছেন, মন্ত্রিপরিষদে কিংবা এর বাইরে তাঁরা সবাই টিম স্পিরিট নিয়ে কাজ করবেন। বিপন্ন মানুষদের নিয়তির ভেলায় ছেড়ে দেওয়া হবে না। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে পারব আমরা। বিপন্ন মানুষেরা যে যেখানে আছেন, নতুন নতুন সৃজনশীল কর্মে যুক্ত হয়ে তাঁরা সবাই সম্পদে পরিণত হবেন। আমাদের অর্থনীতিবীদেরা জাতির এই ঘোর লাগা সময়ে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল সামাজিক ব্যবসার ধারণা দেবেন। করোনা মোকাবিলায় সফল দেশগুলোর কৌশলকেও অনুসরণ করব আমরা। অন্যের কাছ থেকে শেখাকে আধুনিক পৃথিবী প্রশংসার চোখেই দেখে। আমরা নিয়তি নয়, আমদের যোগ্যতা, দক্ষতা, দেশ প্রেম দিয়ে অভাবিত উদাহরণ তৈরি করব সারা পৃথিবীর সামনে।